শিরোনাম
সাদা-কালোয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ভাষা শহীদদের
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ০০:১৭
সাদা-কালোয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ ভাষা শহীদদের
মডেল : নীলুফার বানু লিলি, আমির পারভেজ ও জাকিয়া ইমি, পোশাক: রঙ বাংলাদেশ
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ফাল্গুন যেমন তারুণ্যের উৎসব, তেমনি তা যেন প্রতিবাদের-প্রতিরোধেরও শপথ। এই ফাল্গুনেই মাতৃভাষার জন্য লড়াই করে রাজপথে রক্ত ঝরিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা। শীতের বিদায়ের ধ্বনি যখন ঋতুর পালাবদলে গেল কিছুদিন ধরেই বেশ মূর্ত হয়ে উঠেছে, তখন এবারের একুশের আয়োজনে টি-শার্ট আর ফতুয়ার মতো পোশাকগুলোই অনেক বেশি আয়াসের সাথে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হবে একুশের চেতনাকে।


সেই অমর একুশের চেতনা আমাদের সংস্কৃতিতে এতটাই গভীর যে, এই দিনে শুধু মায়ের মুখের ভাষাতেই নয়, আমরা যেন আপাদমস্তক নিজেকে সাজাতে চাই মাতৃভূমির রঙে-রূপে। তাই একুশের দিনে, এই ফাল্গুনে, পোশাকেও থাকে একুশ।



একুশ মানেই শুধু ভাষার জন্য লড়াই নয়, একুশ মানেই শুধু পলাশ-শিমুলে ভরা ফাল্গুনের কোনো দুপুর নয়। ভাই হারানোর বেদনা আর শোক ছাপিয়ে একুশ আমাদের অনেক পাওয়ার একটি দিন। একুশের চেতনাই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলা ভাষাকে নিয়ে গেছে বিশ্ব দরবারে।


গোটা বিশ্ব আজ গর্বের সঙ্গে স্মরণ করে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের মত সকল ভাষা সৈনিকের আত্মত্যাগকে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয় বিশ্বের প্রতিটি দেশে। ভাষা আন্দোলনের পুরোটাই আমাদের অর্জনের। ভাই হারানোর বেদনা নিয়ে আমরা সাদা-কালোয় শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি ভাষা শহীদদের।


বাংলা ৮ ফাল্গুন, ১৩৫৯ অথবা ইংরেজি ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২। দিনটি এখন রক্তের লাল ও শোকের কালো রঙের ইতিহাস। ভাষার জন্য জীবন ত্যাগের আর কিছু বর্ণমালার ইতিহাস। শ্রদ্ধায় মাথা নত করার সঙ্গে গর্বিত বাঙালি হয়ে জেগে উঠি আরেকবার। সে গর্ব ফুটে ওঠে দেশীয় পোশাকের ডিজাইনে।


একুশের পোশাক নিয়ে সর্বপ্রথম কাজ শুরু হয় ষাটের দশকে। মূলত একুশের চেতনা শুধু ফেব্রুয়ারি মাসের নয়। এই গর্ব আমাদের সারাজীবনে। আর পোশাকের মাধ্যমে সহজেই সে চেতনা প্রকাশ করা যায়।'


একুশের চেতনাকে ধারণ করে সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলে নানা আয়োজন। একুশের চেতনার ধারা শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বুকে যে সুপ্রবাহের সৃষ্টি করেছে সাম্প্রতিককালে একুশের চেতনার ছোঁয়া লেগেছে দেশের ফ্যাশন ট্রেন্ডেও। বাঙালির দৈনন্দিন জীবনে পোশাক একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। যে অনুষঙ্গের গহীনে এখন চলছে দেশীয় আধুনিকবোধের প্রকাশ। বিভিন্ন উৎসবের পাশাপাশি নগরবাসীরা একুশের চেতনায় উত্কীর্ণ পোশাকের প্রতিও তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদানের মধ্যদিয়ে শহীদ দিবসের মর্মগাঁথাকে প্রতিবছরের ফেব্রুয়ারিতে শরীরে জড়িয়ে নেন গভীর ভালোবাসায়।



দেশীয় ফেব্রিকে তৈরি একুশের পোশাক আউটলেট থেকে সংগ্রহের উদ্যোগ শুরু হয় ফেব্রুয়ারির গোড়া থেকে। ঢাকার প্রায় শতাধিক খ্যাতনামা ফ্যাশন হাউস নাগরিক জীবনের পরম এই অনুষঙ্গকে অত্যন্ত নান্দনিকরূপে উপস্থাপনের লক্ষ্যে গ্রহণ করে বিপুল আয়োজন। এই আয়োজনে থাকে পাঞ্জাবি, শার্ট, ফতুয়া, শাড়ি, থ্রিপিস, টি-শার্ট, পট, শোপিস, টিপট, মগসহ নানাদ্রব্য।


একটা সময় ছিল যখন, ফাল্গুন আর একুশের আয়োজনে মেয়েদের প্রথম পছন্দ ছিল শাড়ি। শাড়ির প্রতি সেই পক্ষপাত হয়তো এই সময়ের মেয়েদের মাঝেও কমবেশি বিদ্যমান।


সাদা-কালো কিংবা নীলের পটভূমিতে একুশের বর্ণমালাকে ধারণ করা মেয়েদের শাড়িতে সুতির প্রাধান্যই বেশি। এ ছাড়া নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একুশের অন্যান্য যে অনুষঙ্গগুলো যোগ হতে পারে পরিধেয়র সঙ্গে তার মধ্যে প্রথমেই বলতে হয় মেয়েদের মাথা আর গলায় গাঁদা ফুলের সাজের কথা।


সাদা এবং কালো রঙের সমন্বয়ে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য দ্রব্য সংগ্রহের ক্ষেত্রেও থাকে ক্রেতাদের একটি বিয়োগাত্মক দিনের স্মরণগাথা। তাই বিয়োগ-ব্যথার বেদনার্ত রঙ কালোই মূলত সবক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। পোশাকে ও অন্যান্য দ্রব্যে বর্ণমালা, শহীদ মিনার, একুশের পঙক্তিমালা, শহীদদের প্রতিকৃতিও থাকে বিভিন্ন দ্রব্যের অবয়বজুড়ে।


এ ছাড়া থাকে বাঙালির চেতনাবাহী বিবিধ বিষয়; যা আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে।


ভাষার প্রতি বাঙালির যে টান যে মমত্ববোধ তা যেমন উত্কীর্ণ হয় লেখায়, রেখায় এবং দৈনন্দিন জীবন যাপনে তেমনি ফ্যাশনের ভুবনেও একুশের মর্মার্থকে শ্রদ্ধার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস থাকে প্রতিবছর, প্রতিনিয়ত গহীন ভালোবাসায়।



রং ও কাপড়


একুশের চেতনার সঙ্গে মিলিয়ে পোশাকে সাদা-কালো রঙের প্রাধান্য থাকলেও এখন আর তা এই দুটি রঙের মধ্যে আটকে নেই। একুশ এখন সর্বজনীন। তাই রঙের ব্যবহারও সর্বজনীন। সাদা, কালো, লাল, সবুজ, হলুদ, নীল সব রঙেই সাজছে একুশের পোশাক। কাপড়ের ক্ষেত্রে সুতির প্রাধান্য থাকলেও তাঁত, মসলিন, সিল্ক প্রভৃতির ব্যবহারও বাড়ছে।




নকশা ও পোশাকের ধরন


এ বছর একুশের পোশাকের নকশায় বর্ণমালা, ভাষা ও ভাষাশহীদদের পাশাপাশি দেশজ চেতনা ও ঐতিহ্যের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। পোশাকের মধ্যে নকশিকাঁথা ফোঁড়, ব্লক, স্প্রে-ব্লক, অ্যাপলিক, ক্যাটওয়াক, স্ক্রিন, হ্যান্ডপেইন্ট, এমব্রয়ডারির কাজ চোখে পড়ার মতো।


পোশাক হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে ছেলেদের নানা রঙের টি-শার্ট, ফতুয়া, পাঞ্জাবি, চাদর এবং মেয়েদের ফতুয়া, টপস, সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি। শিশুদের জন্যও রয়েছে নানা আয়োজন। এসব পোশাকের জমিনে নানা রঙে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বাংলা ভাষা ও আন্দোলনের ইতিহাস।


একুশের প্রভাত ফেরিতে আমাদের চোখে পড়ে সাদা-কালো নানা ঢংয়ের বর্ণের পোশাকে আচ্ছাদিত নর-নারী শিশু ছুটছেন। কারো শাড়িতে বর্ণমালা, কারো পাঞ্জাবিতে, কারো সাদা জামায় লাল-কালো আল্পনা। কারো ফ্রকে পাবেন সাদা ও কালোর খেলা।


একুশের ভাবনার সঙ্গে মিল রেখে পোশাকে বর্ণমালার ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়। সমপ্রতি যুক্ত হয়েছে একুশের গান, কবিতা, স্লোগান ও বাংলা ভাষায় রচিত বিভিন্ন পঙক্তিমালা। যেখানে ফুটে উঠেছে বাঙালির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা গৌরবগাথা। এ ছাড়া শহীদ মিনার, মানচিত্র, পতাকাসহ একুশের বিভিন্ন চিত্রের নান্দনিক প্রকাশ ঘটেছে এবারের পোশাকে।



একুশের পোশাকে সবার প্রথমে আসবে রঙ, বিভিন্ন দিবসে বিভিন্ন মুড আর থিম আছে। একুশের প্রধান বিষয় হচ্ছে শোকের সঙ্গে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো। এটি বৈশাখ বা অন্য দিবসের মতো নয়, এটি ভাবগম্ভীর একটি বিষয়। সেটিকে বোঝাতেই কালো সংযুক্ত হয়েছে।


আর সাদার অর্থ হচ্ছে শুদ্ধতা ও শ্রদ্ধা। ৫২ এর ভাষা আন্দোলনের দিনেও আমরা সাদা পোশাকের ব্যবহার দেখেছি। তখন থেকেই শুদ্ধ সাদা।
এর সঙ্গে শোক যুক্ত হয়েছে। এ দুটো রঙ ছাড়া একুশকে কোনওভাবেই বোঝানো সম্ভব নয়। আর যেহেতু আমাদের আত্মত্যাগ আর লড়াই ছিল ভাষার জন্য, সেহেতু ভাষা ও বর্ণমালা এখানে অনেক বেশি সংযুক্ত। একুশের পোশাকে সাদাকালোর সঙ্গে বর্ণমালা কিংবা কোনও পঙ্ক্তিমালা ছাড়া ভাবাই যায় না।


একদিকে একুশের শহীদ বেদীতে গাঁদা কিংবা গোলাপের শ্রদ্ধার্ঘ আর অন্যদিকে একুশের চেতনায় সামিল হওয়া কোনো তরুণীর মাথায় শোভা পাওয়া গাঁদার মালা যেন একুশের ছন্দটাকেই নিয়ে আসে সকলের মাঝে।


আবার মাথায় বাংলাদেশের পতাকার রঙের কোনো ফেট্টি বা হাতে লাল-সবুজের কোনো ব্রেসলেটও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় ভিন্ন এক অনুভূতির সাথে। সেই সাথে ছোট-বড় সকলের গালে রংতুলির ছোঁয়ায় জন্ম নেওয়া বর্ণমালা আর একুশের মিনারও যেন সবাইকে মনে করিয়ে দেয়—আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। মনে করিয়ে দেয় আজকের দিনটি শোককে শক্তিতে পরিণত করে ভাষার জন্য ভালোবাসা প্রকাশের দিন।


বিবার্তা/শারমিন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com