সাক্ষাতকার
ছোটবেলা থেকেই সুর করা নেশা ছিল : শিবু রায়
প্রকাশ : ৩১ মে ২০২৪, ২২:০৮
ছোটবেলা থেকেই সুর করা নেশা ছিল : শিবু রায়
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক মুক্তিযোদ্ধা শিবু রায়। নিজের জীবনের গল্পসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কথা বলেছেন বিবার্তা প্রতিবেদকের সাথে। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো-


বিবার্তা : আপনার সংগীত জীবনের শুরু কীভাবে হয়েছিল?


শিবু রায় : আমার জন্ম ১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। স্কুলজীবন থেকেই আমি গান গাইতে পছন্দ করতাম। সেসময় আমার বড় দাদা চিত্তরঞ্জন রায়, তিনি কলকাতায় থাকতেন। বড় দাদা কলকাতা থেকে বার বার চিঠি লিখতেন তোকে দেখতে পাই না, এইরকম। তার ডাকেই ১৯৬১ সালে আমি কলকাতা যাই।


মজার বিষয়, সেসময় এখান থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত সরাসরি টিকেট ছিল ১৪/১৫ টাকা। সেখানে যাওয়ার পর খুব গান শুনতাম, রেকর্ডের গান, আধুনিক গান, সিনেমার থেকে শুরু করে নানা রকম গান, আর ভাবতাম এরা কীভাবে গান করে? হেমন্ত, শ্যামল মিত্র, মান্না দে সবার গান শুনতাম।


গান শুনি আর ভাবি এরা কীভাবে গায়। একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, বৃষ্টি এসে গেল। দাদা থাকতেন যাদবপুরে ইব্রাহিমপুর। বৃষ্টির মধ্য একটা বারান্দার মতো জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার সাথে আরো কয়েকজন গিয়ে দাঁড়াল। সেসময় ভেতর থকে এক মেয়ের গান শুনতে পেলাম। সাথে আরেকজনও গাইছে। গান থামছে, আবার হচ্ছে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে চলছে। এক পর্যায়ে গান থেমে গেল, ওস্তাদজী বের হয়ে গেলেন। এর মধ্যে আমার সাথে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা চলে গেছে, বৃষ্টিও থেমে গেছে, আমার কিন্তু হুঁশ নেই, আমি গানের তালেই আছি। ওস্তাদজী বের হয়ে যাওয়ার পর একজন দরজা লাগাতে এসে আমাকে বললেন, এই ছোকড়া তুমি কী করছো এখানে? আমি বললাম, ভেতরে গান হচ্ছিল, গান শোনা যাবে একটু? ওস্তাদজীও আমার কথা শুনে ঘুরে তাকালেন। ওস্তাদজী বললেন, কী বলে এ? পাগল নাকি? আবার ইশারা করে দেখালেন যে মাথায় সমস্যা আছে নাকি। বললেন কোথা থেকে এসেছ? আমি বললাম বাংলাদেশ থেকে, এখানে আমার এক কাকা সিনেমায় সাইড অভিনয় করেন সে থাকেন তার কাছে এসেছি। তখনো বাংলাদেশ হয়নি।


সেসময় মেয়েটিও ভেতর থকে এসে দরজায় দাঁড়াল। আর তার বাবাকে বলল, বাবা ও বোধহয় বুঝতে পারছে না, ওকে ভেতরে আনো। ভেতরে গেলাম। মেয়েটি বলল, তুমি গান শুনবে? আমি হ্যাঁ বলতেই সে একটা গান গাইল। আমি মন দিয়ে শুনছি আর ভাবছি কীভাবে গলা থেকে গান বের হয়। শেষে মেয়েটিকে বললাম, দিদি এভাবেই গান গাইতে হয়? এই কথা শুনে মেয়েটিও হাসছে, তার বাবাও হাসছে।


সেসময় মেয়েটি বলল, তুমি গান গাও? শিখো না কেন? সেস্ময় আমার গান শেখার ইচ্ছাটা চেপে গেল।


বিবার্তা : গান শেখা শুরু করলেন কবে?


শিবু রায় : সময়টা ছিল, ১৯৬৪ সাল। যেদিনের কথা বললাম, সেদিনের পর মনে হলো গান শিখতেই হবে, খুঁজতে শুরু করলাম কোথায় শেখায়? হঠাৎ দেখি এক জায়গায় লেখা বাণী চক্র সংগীত একাডেমি। একাডেমির প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন শ্যামল মিত্র। আরো ছিলেন মানবেন্দ্র, ধনঞ্জয়, সব স্টার যারা তারা ছিলেন।


আমি একাডেমিতে গেলাম। ঢুকতে যাবো দারোয়ান আমাকে আটকে দিল, বলে কোথায় যাচ্ছো? আমি বললাম, আমি গান শিখতে এসেছি, ভেতরে যাবো। দারোরান বলল, আজকে বন্ধ, রবিবারে আসো। এরপর তো রবিবার আসার অপেক্ষা, আমার দিন কাটে না।


এরপর রবিবার এলো। আমি সেখানে গেলাম। একাডেমির ভেতরে গিয়েছি, আমার কপালটা খুব ভালো সেদিন শ্যামল মিত্র ছিলেন। আমি একটা স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম, ভর্তি হলাম কার সাথে কথা বলবো।


ছেলেটি শ্যামল মিত্রকে দেখিয়ে বলল, উনি আমাদের প্রিন্সিপাল, আমি এরপর সোজা শ্যামল মিত্রের রুমে গেলাম। গিয়েই তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করে বললাম, দাদা আমি আপনার কাছে গান শিখবো। তিনি বললেন, নিচে অফিস রুম আছে সেখানে যোগাযোগ করো। আমি তো গান গাই, গান শেখাই না, আমার কাছে কী শিখবে তুমি? আমি বললাম, দাদা আমি আপনার কাছেই গান শিখবো। তিনি আমাকে মানাতে পারছিলেন না। তিনি বললেন, পাগল নাকি এই ছেলে? কিন্তু আমি নাছোড়বান্দা। এরপর তিনি আমাকে একটা কার্ড দিয়ে তার বাসায় দেখা করতে বলেন, আমি পরদিনই তার বাসায় গেলাম।


বিবার্তা : আপনি কি এরপর শ্যামল মিত্রের কাছে গান শিখলেন?


শিবু রায় : আমি শ্যামল মিত্রের সাথে দেখা করার পর তিনি আমকে বললেন, তুমি স্কুলে গান শিখতে থাকো, এরপর একটা পর্যায়ে এলে আমি তোমাকে গান শেখাবো। তিনি স্কুলে বলে দিলেন। যে ছেলেটিকে বলে দিলেন স্কুলে যাওয়ার পর সেই ছেলেটি আমাকে বলল, তুমি গান শখবে, তুমি কতদিন এখানে থাকবে? আমি বললাম দু'মাস। ছেলেটি বলল। এই ছেলা পাগল নাকি। শ্যামলদার কাছে বিচার দিলো, তিনি বললেন, আরে একটু পাগল
আছে, যতদিন শেখে শেখাও।


আরেকটা মজার বিষয়, শ্যামল মিত্র আমাকে যে কার্ডটা দিলেন সেটাতে তিনি সাইন করে দিয়েছিলেন। আমি তার বাসায় গেলাম, গিয়ে দেখি অনেক লোক বসা। তখনো শ্যামল মিত্র আসেননি, তো অন্যরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন এসেছো? তুমি কি ওনার ছাত্র?


আমি বললাম, আমি হতে এসেছি, আমাকে নিয়ে হাসির রোল পড়ে গেল। এরপর শ্যামল মিত্র এলেন, আমাকে দেখে বললেন কী রাতে ঘুম হয়নি চলে এসেছো? এরপর আমাকে বসিয়ে অন্যদের সাথে কথা বলে আমকে সময় দিলেন। আমি গান শিখতাম, পাশাপাশি শ্যামল মিত্রের বাসায় চলে যেতাম। বৌদি খুব ভালোবাসতেন। দাদকে বলতেন, ওকে শেখাও, শেখাও না কেন? দাদা বলতেন আরে ওর এই অবস্থা। উনারা হাসতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের সাথে খুব সখ্যতা হলো।


বিবার্তা : ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আপনি কোথায় কীভাবে ছিলেন?


শিবু রায় : ২৫ মার্চকে কালরাত বলেই আমরা জানি। সেই রাতে বাংলাদেশ টেলিভিশনে আমাদের প্রোগ্রাম ছিল। একটা গ্রুপ গান। মুসা ভাইকে সবস্ময় বলতাম প্রোগ্রাম দেওয়ার কথা। উনি একদিন হঠাৎ করে বললেন, ১০/১২ জনকে নিয়ে একটা গান রেডি কর, প্রোগ্রাম দেই।


আমিও লেগে পড়লাম। আমার ছোটবেলা থেকেই সুর করার নেশা ছিল। গানটা এই মুহূর্তে মনে নেই, পাণ্ডুলিপিও নেই। যুদ্ধের সময় বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম , তখন সব লুটপাট হয়ে যায়। তো, আমরা অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছি, তখন সাড়ে নয়টা দশটা বাজে।


মুসা আহমেদ বললেন, খুব দ্রুত বাড়ি চলে যাও। আমি বললাম, কেন ভাই? সবাই গল্পগুজব করি। উনি বললেন, যা বললাম তা করো। টেলিভিশন থেকে বের হবো দেখি একজন বলছে, আসসালামু আলাইকুম। তাকিয়ে দেখি এক আর্মি।


আবারও বলল, স্লামালাইকুম, চালিয়ে চালিয়ে, কাহা যানা হে আপলোগ? আমরা বললাম ব্যাপারটা কী? এরপর সুলিস্তান সিনেমা হলের সামনে এলাম, সেই একই সুর, চালিয়ে চালিয়ে। এরপর ববাবপুর রেললাইন এলাম, দেখি একই অবস্থা।


সব সুনিসান, গাড়ি নেই, লাইন ধরে সব দাঁড়ানো। আমরা আসলে তখনও গানের মধ্যে কী হচ্ছে বুঝতে পারছি না। বাসায় ফিরতে রাত বারোটা বেজে গেল। বাব খুব রাগ করলেন। খেতে বসেছি, প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আগুন তো দেখা যায় না, অনেকদূর পর্যন্ত ধোয়া। সেই রাত এভাবেই কাটল।


বিবার্তা : যুদ্ধের সময়ের কথা বলুন।


শিবু রায় : ২৫ মার্চের পর আমরা বাবা বাসায় থাকাটা আর নিরাপদ মনে করলেন না। আমরা ভূলতা গাউছিয়া চলে গেলাম। যেদিন গেলাম সেদিনের কথা- আমরা যাচ্ছি। ডেমরা ঘাটে আসতে মিলিটারিরা ধরল আমাদের। এখনো মনে আছে আমার গলায় রাইফেল ঠেকাল। এখনো ভাবলে গা শিউরে ওঠে। কিন্তু কপাল খুব ভালো ছিল। সেসময় এক বিদেশি সাংবাদিক গাড়ি চালিয়ে মিলিটারিদের গাড়ির সামনে এলেন। তাকে দেখে ওরা আমাদের ছেড়ে দিল। এরপর ভূলতা যাওয়া, বর্ডার পার হয়ে ওপারে যাওয়া। যাওয়ার আগে রাজাকারের হাতে পড়লাম। আমরা বর্ডার পার হওয়ার আগে যেখানে থাকলাম, রাজাকাররা এসে বলে পাঁচশ টাকা করে দেন, নাহয় আর্মি ডাক দিবো। আমাদের কাছে টাকা নেই, দুশ দিতে পারবো। যাই হোক, সেই যাত্রা পার পেলাম। এরপর, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করার সুযোগ ঘটল।


বিবার্তা : সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।


শিবু রায় : আপনাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/এসবি/সউদ

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com