সাক্ষাতকার
'মানুষকে ভালোবাসলেই দেশকে ভালোবাসা হয়'
প্রকাশ : ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৮:৩৭
'মানুষকে ভালোবাসলেই দেশকে ভালোবাসা হয়'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

ডা. ফওজিয়া মোসলেম। পেশায় চিকিৎসক। তবে পরিচয়ে আরও বড় একজন তিনি। ছেষট্টির ছয় দফা, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে রাজপথে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন সংগঠকের ভূমিকায়।


গেরিলা বাহিনীর (ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন) পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ফওজিয়া আগরতলা ক্যাম্পের অসুস্থ মানুষ ও আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন চিকিৎসাসেবা। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এর সভাপতি।


বিবার্তা প্রতিবেদকের সাথে সাক্ষাৎকারে তার বেড়ে ওঠা, ছাত্র রাজনীতি, মুক্তিযুদ্ধ, মহিলা পরিষদসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন, সেসবের চুম্বুকাংশ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো।


বিবার্তা : আপনার ছোটবেলা সম্পর্কে জানতে চাই।


ডা. ফওজিয়া মোসলেম : আমার ছোটবেলার গল্পটা অন্যরকম না- সাধারণ মানুষের সাধারণ পরিবারের গল্প। বাবা ছিলেন কাস্টমস এক্সাইজ ডিপার্টমেন্টের অফিসার। ভারতবর্ষের বর্ধমান জেলার আদিবাসী আমরা। ওখানেই আমাদের আদিবাড়ি। বর্ধমানে কাটোয়া বলে সাবডিভিশন আছে, এক অজপাড়াগাঁয়ে আমাদের বাড়ি। বাবার চাকরিসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি, আমার জন্ম বীরভূমে। সেসময়ের কথা মনে নেই। মনে আছে, যখন বাবা বহরমপুরে চাকরি করতেন, মা আমাদের নিয়ে কলকাতায় থাকতেন।


আমি যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি তখন বাবা মারা যান। যখন বাবা মারা যান তখন আমার বড়ো ভাই ক্লাস টেনে পড়েন আর ছোটভাইয়ের এগারো মাস বয়স। মাঝখানে আমরা চারটা বোন। কী হবে আমাদের! তখন আমরা গ্রামে চলে গেলাম।


বিবার্তা : গ্রামে চলে যাওয়ার পর কী হলো?


ডা. ফওজিয়া মোসলেম : ১৯৪৬ সাল থেকেই আমার মামারা ঢাকায় থাকতেন। মামা আমার বড় ভাই আর বোনকে নিয়ে ঢাকায় চলে এলেন। আমরা মায়ের সাথে গ্রামে থেকে গেলাম।


আমাদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। বাড়ি থেকে তিন মাইল দূরে স্কুল ছিল আর বাড়ি থেকে পাঁচ মাইল দূরে বড় স্কুল। তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। এত দূরের স্কুলে একটা মেয়ে হেঁটে যাবে, এটা গ্রামে কীভাবে দেখবে, তাই আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল! দুই বছর বাড়িতেই পড়াশোনা করলাম। এরপর চাচা চেষ্টাচরিত্র করে আমাকে সেই আড়াই ক্রোশ দূরের স্কুলটাতেই ভর্তি করে দিলেন, ক্লাস সেভেনে। কিন্তু অন্য ভাইবোনরাও তো আছে। তাদের পড়াশোনা হচ্ছে না বলে মা অস্থির হয়ে গেলেন। তারপর তিনি চাচাদের না জানিয়েই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলেন, মামাদের কাছে। এখানে এসে আবার পড়ালেখা শুরু হলো।


বিবার্তা : ছাত্র রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টতা কীভাবে?


ডা. ফওজিয়া মোসলেম : এখানে এসে আমি ক্লাস নাইনে ভর্তি হলাম সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে। ১৯৬২ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেই। ১৯৬৪ সালে যখন ইডেন কলেজে ভর্তি হই, ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা জন্মাতে শুরু করে।


আমার মামারা খুব সংস্কৃতমনা ছিলেন। আমাদের বেড়ে ওঠাটাও তাই খুব সাংস্কৃতিক ও রুচিশীল পরিবেশে, বইপত্রের মাঝে। আমার ছোটো মামা সৈয়দ খলিলুল্লাহ বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি চিকিৎসক ছিলেন। ২০০১ সালে মারা যান।


মূলত তাকে নিয়েই আমাদের ভেতরে বেশ আগ্রহ ছিল। তিনি কী করতেন, তার চিন্তাভাবনা চলাফেরা আমাদের বেশ প্রভাবিত করত, আমরা তাকে অনুসরণ করতাম। তখন বাংলাবাজারে থাকতাম। কলেজে ভর্তি হলাম, বাসে করে ইডেনে যেতাম। যাওয়ার সময় দেখতাম ছেলেমেয়েরা মিছিলে জড়ো হচ্ছে, আন্দোলন করছে।


'৬৪ সালের কথা। একটা মেয়ে এসে বলল সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী একটা মিছিল ছিল, তাতে যাওয়ার জন্য। রাশেদ খান মেননের স্ত্রী লুৎফুন্নাহার বিউটি খবরটা দিলো। কলেজে যাওয়ার পর আমরা সেই মিছিলে গেলাম। এই আমার প্রথম ছাত্র মিছিলে যোগ দেওয়া।


বিবার্তা : মুক্তিযুদ্ধে সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের গল্প জানতে চাই।


ডা. ফওজিয়া মোসলেম : মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের জন্য কাজ করতে পেরেছি, এটা আমার জন্য বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নির্মাণ-পর্বে আমি ছাত্র ইউনিয়নে কর্মী হিসেবে যুক্ত ছিলাম।


তাই মুক্তিযুদ্ধে কিছু একটা করার আকাঙ্ক্ষা অনেক আগে থেকে মনের মধ্যে ছিল। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে মার্চের শুরু থেকেই দেশের মানুষদের একটা প্রস্তুতি ছিল।


মার্চের ১ তারিখ সংসদের বৈঠক স্থগিত করার কথা শোনার পর মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে। এখন যেমন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে নেতারা বললে কর্মীরা রাস্তায় নামে। তখন কিন্তু মানুষ নেতার জন্য অপেক্ষা করেনি। ১ মার্চ হাসপাতালের কাজ শেষ করে যখন বাসায় ফিরি, তখন গুলিস্তানের মোড়ে অনেক মানুষকে জড়ো হতে দেখি। সে সময় অসহযোগ আন্দোলন মানে অসহযোগ আন্দোলন। কেউ অফিস–আদালত কোথাও যাচ্ছেন না, কোনো কাজ করছেন না। যেটা আমার স্মৃতি হয়ে আছে, সেটা হলো ঢাকা শহরে মানুষ বাসায় থাকত না। সবাই বোধহয় রাস্তায় থাকত। কেউ রাস্তার বসে গান, কেউ মিছিল, কেউ কেউ আবার স্লোগান দিচ্ছে। বাদাম, মুড়ি বিক্রেতারাও কিন্তু বেচা-বিক্রি বাদ দিয়ে রাস্তায় বসে থাকত। যুদ্ধের মাসে ঢাকা শহরের চেহারা ছিল অন্যরকম। এরপর এল ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। আমি তখন সন্তানসম্ভবা হয়েও লুকিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম।


আমার ছোট মামা যুদ্ধে যান। ছোটমামা কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় আমাকে আগরতলায় নিয়ে যান। আমরা তিনজন ঢাকা থেকে রওনা দিই। আমার সঙ্গে ছিলেন রত্না, আর ফরিদা আপা।


২৫ মার্চের রাত থেকে শুরু হলো অপারেশন সার্চলাইট। আমাদের বাসা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের কাছে ছিল। তাই রাতে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন ঢাকা শহরের অধিকাংশ বাড়ি ছিল ইটের দেয়ালের একতলা টিনের বাড়ি।


তাই গুলির শব্দে সবাই ভয় পায়। পরদিন ২৬ মার্চ সকালে রাস্তায় দেখলাম—সবাই দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। বাসায় গিয়ে রেডিও স্টেশন ঘোরাতে ঘোরাতে একসময় শুনলাম, ঢাকায় গণহত্যা হয়েছে।


একটা সময়ের পর রেডিওতে সামরিক শাসন জারির কথা শুনলাম। সেই সময়টাতে ঢাকা শহরকে মৃত্যুর নগরী মনে হয়েছিল। কোনো সাড়াশব্দ ছিল না। কাকের ডাক আর কুকুরের চিৎকারের পাশাপাশি শুনতে পাই গুলির শব্দ। এভাবেই ২৬ মার্চ কাটালাম।


এরপর ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ তুলে দেওয়া হয়। যেহেতু আমি শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম, তাই মায়ের সঙ্গে আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমার শ্বশুর বাড়ি আর বাবার বাড়ির লোকেরা ছিলেন প্রগতিশীল।


আমার স্বামী সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক ২৭ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। তখন আমি ডা. ফিরোজা বেগমের অধীনে কাজ করতাম। তাই ওনার ক্লিনিকে চলে যাই।


ক্লিনিকে কয়েকদিন থাকার পর একদিন ফিরোজা আপা এসে বলেন, ‘এখানে যেকোনো সময় আর্মির আক্রমণ হতে পারে। তুমি হাসপাতালে চলে যাও। আমি হাসপাতালের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’


এরপর আমি মিটফোর্ড হাসপাতালে (এখন স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ) ভর্তি হই। ২ এপ্রিল আমার ফুটফুট কন্যা সন্তান হয়। সে সময় পরিবারের কারও সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। মা আর আমার খুবই অস্থির সময় কাটতে থাকে।


ছোট বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। তারপরও এপ্রিলের ৫ তারিখ মাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথে সিদ্ধেশ্বরীতে ছোট মামির সঙ্গে দেখা হয়। মামির সঙ্গে তার বাসায় গেলাম। ওই বাসায় আমি আগরতলা যাওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলাম।


মে মাসের শুরুর দিকে এক মাসের ছোট সন্তান নিয়ে আগরতলার ক্যাম্পে পৌঁছাই। যেহেতু আমি চিকিৎসক, আগরতলায় পৌঁছে চিকিৎসকের দায়িত্ব পাই। সেখানকার হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখাশোনা করতাম।


এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতার জন্য আগরতলায় জনমত সংগ্রহের জন্য নারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। সেখানে আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করতাম। ডিসেম্বরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত আমরা আগরতলায় ছিলাম।


বিবার্তা : নারী অধিকার নিয়ে সচেতনতা কখন আপনার মধ্যে জাগ্রত হলো?


ডা. ফওজিয়া মোসলেম: ছাত্রজীবনে শেষের দিকে এসে মনে হলো, এতগুলো বছর যে একটা অঙ্গীকারের সাথে থাকলাম, এই অঙ্গীকারটা আগামী জীবনে কীভাবে রক্ষা করবো? তখন ছাত্র সংগঠন থাকতে পারবো না, মূল রাজনৈতিক দলে থাকাটা সেটাও আমার জন্য কঠিন কাজ। যেহেতু আমি মেয়ে কোথায় বিয়ে হবে, কোথায় থাকবো, তাছাড়া আমার ব্যক্তিত্ব আমাকে সাহায্য করবে কি না। সেসময়েই ভাবনা এলো মহিলাদের নিয়ে কিছু করা যায় কি না।


আমরা যখন এসব ভাবছি, তখন ফরহাদ ভাই বললেন, একমাত্র মহিলা রাজবন্দি মতিয়া চৌধুরীর মুক্তিতে মহিলাদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটা প্রতিবাদ পত্রিকায় দেন। সেসময় সুফিয়া কামালের সান্নিধ্য পাওয়া। তখন তিনি বললেন, শুধু মহিলা নয়, সাধারণ রাজবন্দিদের পরিবারও অনেক কষ্টে আছে, তাদের জন্যও কিছু করো। তখন ব্যাপক অর্থে কাজ শুরু হলো। এবং তিনিই বললেন, তোরা একটা মহিলা সংগঠন কর। আমরাও পথ খুঁজছি তিনিও প্রস্তাব দিলেন।


বিবার্তা : আমরা যে বলি, দেশপ্রেমের চেতনা- এটা আসলে কী?


ডা. ফওজিয়া মোসলেম: যখন মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলাম, তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নানা নেতৃবৃন্দ হাসপাতালে আসতেন, তাদের সাথে কথা বলতে যেতাম। তাদের খোঁজখবর নিতাম। তাদের মধ্যেই একদিন ময়মনসিংহের যতীশ চক্রবর্তী এলেন। তিনি বলছিলেন যে দেশপ্রেম কী বলত, দেশপ্রেম মানে কী দেশের পাখি, ফুল, গাছ, লতাপাতা? দেশ মানে মানুষ। মানুষকে ভালোবাসা মানে দেশকে ভালোবাসা।


আমিও সেরকম বলি, তুমি তোমার মা-বাবাকে ভালোবাসো, ভাই-বোনকে ভালোবাসো, এই ভালোবাসাটাকে একটু ব্যাপৃত করো। মানুষকে ভালোবাসলেই দেশকে ভালোবাসা হবে। মানুষকে ভালোবাসলেই প্রকৃতিকে ভালো রাখা হবে।


বিবার্তা: আপনাকে ধন্যবাদ।


ডা. ফওজিয়া মোসলেম: বিবার্তাকেও ধন্যবাদ।


বিবার্তা/অলক/এসবি/রোমেল/এমজে

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com