আইআরজিসি নামে পরিচিত ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি এখন বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত সমরবিদ। নিজ দেশে ভক্তদের কাছে যাঁর পরিচিতি হাজি কাসেম নামে। শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, পুরো সমরজগতের বিশেষ মনোযোগে রয়েছেন তিনি। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্তা মোসাদের হিটলিস্টেও আছেন তিনি।
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস্ ফোর্স’ তাঁর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় । ২১-২২ বছর হলো বাহিনীটি গড়ে তুলছেন তিনি। অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি একটা বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশান ইউনিট’ বলা যায় একে; যার প্রধান কর্মক্ষেত্র এখন ইরানের বাইরে। দেশটির বৈশ্বিক উত্থানে বর্শার ফলকে পরিণত হয়েছেন কুদস ফোর্সের সদস্যরা, যাঁদের ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে ইতিমধ্যে সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছেন হাজি কাসেম। যে তৎপরতার তাপ লাগছে পৃথিবীর অন্যত্রও; বিশেষ করে অর্থনীতিতে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন সোলাইমানিকে আক্রমণ করে না?
আমেরিকার বনেদি জার্নাল ‘ফরেন পলেসি’ এ বছর বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যে তালিকা করেছে, তাতে সমর খাতে জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে প্রথম স্থানে রাখা হয় । পাশাপাশি এও সত্য, আমেরিকার প্রশাসন এই জেনারেলকে একজন ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবেই দেখে । তাঁকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জারি করা একাধিক নিষেধাজ্ঞা আছে। এও মনে করা হয়, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞা মূলত সোলাইমানির তৎপরতা নিয়ে ক্ষোভ থেকে। তাঁকে নিয়ে সৌদদের বিরাগও সকলের জানা। যুক্তরাষ্ট্র এই বিরাগকে যৌক্তিক মনে করে। তবে ইসরায়েলের গোয়েন্দাদের অনুযোগ, অন্তত দুবার আমেরিকা সোলাইমানিকে সুযোগ পেয়েও মারেনি । কারণ, ‘দায়েশ’কে নিয়ন্ত্রণে সোলাইমানির অপরিহার্যতা। তাঁকে হত্যা করা মানেই ইরানের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতার পথ বহুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া, যা ইরাক ও আফগানিস্তানে ওয়াশিংটনের জন্য দীর্ঘমেয়াদে অসুবিধাজনক হতে পারে। সোলাইমানির প্রতি আঘাতকে আলী খামেনি সরাসরি তাঁর ওপর আঘাত হিসেবেই যে নেবেন, সেটা সিআইএর জানা। তাই ওসামা বিন লাদেনের হদিস জেনে যত সহজে অভিযানে যাওয়া যায়, সোলাইমানিকে নিয়ে সেটা সম্ভব নয়। যে যুদ্ধ শেষ করা যাবে না, তেমন যুদ্ধে ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের আগ্রহ আগের চেয়ে অনেক কম। সিআইএর সূত্রে এ তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জানা, ইরানিরা বছরের পর বছর প্রতি রাতে ঘুমাতে যায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের হামলার শঙ্কা নিয়ে। সোলাইমানিকে খুন করা হবে অসন্তোষের সেই আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো।
হাজি কাসেম ইরান সীমান্ত টেনে এনেছেন ইসরাইলেরপাশে
সোলাইমানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথাই বেশি। ইরানের এই জেনারেলকে তারা প্রকাশ্যেই ‘এক নম্বর শত্রু’ বলে। ইসরায়েল মনে করছে লেবানন, সিরিয়া, গাজা থেকে সোলাইমানির অদৃশ্য সৈনিকেরা ক্রমে তাদের ঘিরে ফেলছে। এভাবে ইরান সীমান্তকে সোলাইমানি টেনে নিয়ে এসেছেন ইসরায়েলের বাড়ির পাশে। অথচ তেহরান-জেরুজালেমের মাঝে দূরত্ব ১৫০০ কিলোমিটারের বেশি।
প্রতিবেশী সিরিয়ায় ইরানের কুদস ফোর্সের সামরিক দপ্তর থাকা ইসরায়েলের কাছে তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই অসহনীয় কিছু। ইসরায়েলের জেনারেলরা এটা কখনোই গোপন করেন না যে মোশাদের হিটলিস্টে সোলাইমানি সর্বাগ্রেই আছেন। ইরানেরও তা অজানা নেই। হয়তো এ কারণেই আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সোলাইমানিকে অভিহিত করেন ইরানের ‘জীবন্ত শহীদ’ হিসেবে।
কোনো কোনো ইসরায়েলি জেনারেল অবশ্য সোলাইমানির পরিবর্তে কেবল কুদস ফোর্সকে আক্রমণের পক্ষে। তাদের ভাষায়, ‘ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করলে মশা এমনিতেই মরে যায়। মশা মারা থেকে জঙ্গল পরিষ্কার করা ভালো।’ তবে অনুমান করা হয়, ব্যক্তিগতভাবে সোলাইমানির ব্যাপারে কঠোর হতে ইসরায়েলের ওপর সৌদদের চাপ আছে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ ২০১৮ সালের নভেম্বরে এমন রিপোর্টও করেছে যে, সাংবাদিক খাসোগিকে হত্যার অন্তত এক বছর আগে একই খুনে দল ইসরায়েলের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে মিলে সোলাইমানিকে নিয়ে অনুরূপ কিছু পরিকল্পনা করছিল। এ কাজের বাজেট ছিল দুই বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্য হাসিলে ভাড়াটে কোনো শক্তিকে ব্যবহারের কথা ছিল। অজ্ঞাত কারণে তা সফল হয়নি।
ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে দুঃসাহসিকতার বর্ণনা দিলেন সোলাইমানি
ইরানের ইসলামী বিপ্লবী গার্ডসের কুদস বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ও হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছিল ইসরাইলি বিমান। ২০০৬ সালের দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের সময় বৈরুতে এমন ঘটনা ঘটেছিল।
ইরানি টেলিভিশনকে দেয়া নিজের প্রথম সাক্ষাৎকারে তিনি এমন দাবি করেন। বৈরুত থেকে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধের তদারকির দায়িত্ব ছিল তার।-খবর টাইমস অব ইসরাইল ও এএফপির
১৩ বছর আগের ওই প্রাণঘাতী লড়াইয়ে তিনি দৈনিক ভিত্তিতে তেহরানকে প্রতিবেদন দিতেন এবং খামেনির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন।
৩৪ দিনের ওই যুদ্ধের পুরোটা সময় তিনি লেবাননে ছিলেন। ইমাদ মুগিয়ার সঙ্গে সিরিয়া থেকে লেবাননে প্রবেশ করেন তিনি। ইরান-সমর্থিত শিয়া আন্দোলন হিজবুল্লাহর কমান্ডার ইমাদ মুগিয়া ২০০৮ সালে গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন। ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ও সিআইয়ের অভিযানে তিনি নিহত হন।
বৈরুতের পার্শ্ববর্তী দাহিয়া গ্রামের ওপর দিয়ে ইসরাইলি গোয়েন্দা বিমান অবিরত উড়ে যাচ্ছিল। গ্রামটিকে হিজবুল্লাহর ঘাঁটি বলা হয়ে থাকে।
অঞ্চলটির মূলকেন্দ্রে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে হিজবুল্লাহর একটি কক্ষ ছিল। সেখান থেকে প্রতিটি মুহূর্তে ইসরাইলিদের পর্যবেক্ষণ করা হতো।
সোলাইমিন বলেন, কোনো একটি শেষ রাতে তিনি এবং মুগিয়া অনুভব করেন, অভিযান কক্ষ থেকে নাসরুল্লাহকে সরিয়ে দেয়া দরকার।
দ্বিতীয় একটি ভবনে নাসরুল্লাহকে সরিয়ে নেয়ার পর তারাও সেখানে যান। কাছেই দুটি ইসরাইলি বোমা বিস্ফোরিত হয়।
সোলাইমানি বলেন, আমরা অনুভব করতে লাগলাম, দুটি বিস্ফোরণের পর তৃতীয় আরেকটি আসছে। কাজেই সেই ভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আমাদের কাছে কোনো গাড়ি ছিল না। চারদিকে সুনসান নীরবতা। কেবল ইসরাইলি বিমান দানিয়া গ্রামের আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছিল।
তিনি এবং নাসরুল্লাহ একটি ড্রোন থেকে গাছের আড়ালে পালানোর চেষ্টা করছিলেন। তখন তারা একটি গাড়ির খোঁজে মুগিয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সেই গাড়িটিও শনাক্ত করে ফেলে ড্রোন। কাজেই গাড়িটি শাঁ করে ঘুরিয়ে তারা একটি ভূগর্ভস্থ গ্যারেজে আশ্রয় নেন।
নাসরুল্লাহকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দেয়ার পর তিনি এবং মুগিয়া ফের কমান্ড সেন্টারে ফিরে যান।
ইসরাইলি চ্যানেল ১৩-এর এক বিশ্লেষক বলেন, পশ্চিমাদের কাছে কোনো আত্মসমর্পণ নয়, মুসলিম বিশ্বে এমন বাণী পৌঁছাতেই তিনি এই সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দেশের বাইরে ইরানি তৎপরতার দায়িত্ব কাসেম সোলাইমানির কাঁধে।
দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধে এক হাজার ২০০ লেবানিজ নিহত হয়েছেন। যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। এ ছাড়া ইসরাইলির ১৬০ সেনা নিহত হয়েছেন।
বিবার্তা/আবদাল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]