শিরোনাম
স্বামীর হাত ধরে সফল উদ্যোক্তা সালমা নেহা
প্রকাশ : ২১ ডিসেম্বর ২০২১, ১১:৩৪
স্বামীর হাত ধরে সফল উদ্যোক্তা সালমা নেহা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ছোটবেলায় গ্রামে যখন দেখতেন কেউ ডাক্তার হয়ে মানুষের চিকিৎসাসেবা করছেন, তখন তার মনে হতো ডাক্তার হবো। যখন কেউ শিক্ষকতায় ভালো করছেন, তখন মনে হতো ডাক্তার না শিক্ষকই হবো। অন্যদিকে পারিবার থেকেও সবাই চাইতো তিনি যেন ডাক্তার হন। সায়েন্স বিভাগ থেকে এসএসসি পাস করেন।


একটা সময়ে এসে মনে হলো সায়েন্স বিষয়টা তার চিন্তার সাথে যায় না। কারণ পড়ে মনে কোনো আনন্দ পান না। তখন এইচএসসিতে কমার্স নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। বুঝতে পারেন এটাই তার জন্য উপযুক্ত বিষয়। এটা তার চিন্তার সাথে যায়। মাঝে কেটে যায় বেশ কিছু সময়। পরে হন অনলাইন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা। আজ তিনি নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছেন।


বলছিলাম অনলাইন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তা ‘টেস্টবিডি’-এর প্রতিষ্ঠাতা এবং কর্ণধার সালমা নেহার কথা। জীবনে সবাই সফল হতে চান। নিজের মতো করে কিছু করতে চাওয়ার স্বপ্ন মনের গভীরে অনেকেই লালন করেন। কিন্তু এই মানুষগুলোই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে টাকা নেই, পরিবারে ব্যবসা করতে দেবে না, আমার দ্বারা ব্যবসা হবে না, আমি কী পারব? আমার জিনিস কে কিনবে? এসব নানান কথা ভেবে এক ধাপ এগিয়ে তিন ধাপ পিছিয়ে যান। কিন্তু সালমা নেহা পিছপা হননি। তাই তিনি আজ সফল।


এই সফলতা তার এক দিনে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে নানান কাঠখড় পোড়ানোর কথা। জীবনের বাঁকে বাঁকে রয়েছে চড়াই-উৎরাই পেরোনোর গল্প।


সালমা নেহার জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জে। বাবা ছিলেন ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট নেহা। সবার ছোট বলে তিনি ছিলেন ভীষণ আদরের।



কিশোরগঞ্জে মাধ্যমিকের পর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনার জন্য চলে আসেন রাজধানী ঢাকায়। তেজগাঁও কলেজ থেকে অ্যাকাউন্টটিং বিভাগে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। কলেজে পড়ার সময় পরিবারের সবাইকে দেখতেন সকালে অফিসে যায়, আসে সন্ধ্যার সময়। পরিবারের কোনো অনুষ্ঠান, বিশেষ দিবস, কোনো কিছুতেই তাদের চিন্তা নেই। মাথা ব্যথা নেই। সবাই কেমন যেন যন্ত্রের মতো জীবনযাপন করছে। তার চিন্তা ছিল চাকরি, পরিবার, সংসার সবকিছু মিলিয়ে মানুষের জীবন। আমি কেন চাকরির জন্য সবকিছু সেক্রিফাইস করবো। তখন মনে হলো যে আমি চাকরি করবো না। নিজে থেকে কিছু করবো। এমন কিছু করবো যাতে নিজে ভালো থেকে আরো ১৫-২০ জন বেকার, অসহায় নারীর কর্মসংস্থান করতে পারি।


বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পথ খুঁজতে থাকেন। সময় পেলেই সংবাদপত্রে বিভিন্ন সফল উদ্যেক্তাদের জীবনের গল্প পড়েন। সফল উদ্যোক্তাদের জীবনী দেখেন টিভিতে, ইউটিউবে, অনলাইনে, ফেসবুকে। দেখতেন কত মানুষ বিভিন্ন পণ্য নিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানে অনেকে কাজ করছেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে দেশিপণ্যের উদ্যোক্তা ছিল না।


নেহা বলেন, তখন আমার মনে হলো যে আমি উদ্যোক্তা হবো। চাকরি করলে অন্যের অধীনে থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ৯-৫টা কাজ করতে হবে। আর উদ্যোক্তারা স্বাধীন। নিজের ব্যবসা। মালিক হয়ে নিজের মতো করে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করবো।


দুচোখ ভড়া স্বপ্ন ছিল বড় ব্যবসায়ী হবেন। কিন্তু বিধি বাম। পরিবার ছিল ভীষণ রক্ষণশীল। কোনো মেয়ে ব্যবসা করবে এটা ভাবনার মধ্যেই ছিল না কারো। যেহেতু বাবা ছিল না। কেউ যদি কিছু বলে ফেলে। এই ভয়ে পরিবার থেকে ব্যবসার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই ব্যবসা করা তো দূরের কথা, শুধু সায়েন্স ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ডটা বদল করেন আত্মপ্রত্যয়ী এই নারী।



যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি সায়েন্স থেকে কমার্সে আসেন সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পরিবারের সদস্যরা। সবার কথা- যেহেতু তুমি কমার্সে পড়ছো তোমাকে ব্যাংকার হতে হবে। সেভাবে পড়ো। বা বিসিএস ক্যাডার হতে হবে। সবার পীড়াপীড়িতে অনার্সে পড়ার সময় চাকরির চেষ্টা করেন। ক্যারিয়ারভিত্তিক পড়াশোনা করেন। অনার্সের ফাইনাল ইয়ারে পড়ার সময়ই পরিবারের সবার পছন্দে বিয়ে করেন। বিয়ের পর নিজস্ব মতামত প্রকাশের জায়গা তৈরি হয়। দুই পরিবারের সবাই সার্ভিস হোল্ডার হওয়ায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে জয়েন করেন তিনি।


নিজের স্বামী সংসার সামলে চাকরি করেন নেহা। কিছুদিন চাকরি করার পর অন্যের অধীনে থেকে কাজ করাটা তার আর ভালো লাগছিল না। নিজে থেকে কোনো একটা ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। সাথে সারথী হিসেবে পান স্বামীকে। বিশ্বাস চাকরির পাশাপাশি ব্যবসাটা ভালো করলে একটা সময় সবাই মেনে নেবেন। ঠিক তাই। একটা সময়ে এসে শ্বশুরবাড়ির সবাই বুঝতে পেরেছেন যে নেহাকে দিয়ে চাকরি আর হবে না। আসলে তিনি চাকরির মানুষই না। সময়ের মধ্যে আটকে থাকার মানুষ নন তিনি। মানুষ হিসেবে একটু স্বাধীনচেতা। নিজের মতো করে চলতে পছন্দ করেন।


২০১৬ সালে অনলাইনে ক্লথিং আইটেম নিয়ে স্বামীর সহযোগিতায় বিজনেস শুরু করেন নেহা। স্বামী, সংসার, চাকরি সব সামলে নানান বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে একটু একটু করে এগিয়ে যেতে থাকে তার স্বপ্নের বিজনেস। চলছিল মন্দ না। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি এসে তার ব্যবসার ইতি টানতে হয়েছিল। গলব্লাডারে স্টোন ধরা পড়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতে যান তিনি।


২০১৯ সালের অক্টোবরে নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) জয়েন করেন তিনি। সেখানে পরিচয় হয় ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক সভাপতি রাজিব আহমেদের সাথে। রাজিব আহমেদ ছিলেন তখন উইয়ে প্রধান মেন্টর।


নেহা বলেন, আমি রাজিব আহমেদ স্যারের সাথে পরিচয়ের পর আমার ব্যবসার অবস্থার কথা খুলে বলি। সব শুনে তিনি আমাকে বলেন, যখন আগের ব্যবসাটা ভালো যাচ্ছে না তাই আপনি নতুন কিছু নিয়ে কাজ শুরু করতে পারেন। নতুন কিছু ভাবেন। যেটাতে আপনি ভালো করতে পারবেন এমন কিছু করেন। তখন উই গ্রুপে বেশির ভাগ নারী ক্লথিং আইটেম নিয়ে কাজ করতেন। ফুড আইটেম নিয়ে তেমন কেউ ছিলেন না। তখন রাজিব স্যার বললেন, আপনি ফুড নিয়ে কাজ করতে পারেন। এই মাঠ খালি। আপনি চাইলে এই মাঠটাকে কাজে লাগাতে পারেন। ভাবলাম কাকলি আপু যেমন জামদানি নিয়ে আছেন, নিগার আপু খেশ নিয়ে আছেন। তাহলে আমিও এ সেক্টরটা নিয়ে কাজ করতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ শুরু করি।



চাঁপাই নবাবগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী আদি চমচম, অন্যান্য আঞ্চলিক মিষ্টি নিয়ে কাজ শুরু করেন নেহা। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ফল যেমন চাঁপাইয়ের আম, লিচু, মিষ্টি, রাজশাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করছেন তিনি। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রামের পনিরও রয়ছে তার ব্যবসার পণ্য হিসেবে। বাপের বাড়ি কিশোরগঞ্জ ও শ্বশুরবাড়ি চাঁপাই নবাবগঞ্জ। এ দুটি জেলার ঐতিহ্যবাহী সব পণ্য নিয়ে কাজ করছেন তিনি।


সাফল্যের বিষয়ে নেহার ভাষ্য, টেস্টবিডি থেকে আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো সাড়া পেয়েছি এবং এখনো পাচ্ছি। আমি আমার ব্যবসায় আন্তরিকতা, সততা, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় দিয়ে এ পর্যন্ত ৩০ লাখের বেশি টাকার পণ্য বিক্রি করেছি। কাস্টমাররা আমার লক্ষ্মী। সবাই অনেক আন্তরিক। সবাই একাধিকবার পণ্য নিয়েছেন। এখনও নিচ্ছেন।


মাহামারি করোনার সময়ই অনেক টাকার পণ্য বিক্রি করেন এই উদ্যোক্তা। নেহা বলেন, ২০২০ সালে লকডাউনের সময় আমার সিগনেচার পণ্য আদি চমচম, যেটা মোস্ট সেলিং প্রোডাক্ট ছিল। লকডাউনে ফুড ডেলিভারি নিয়ে নির্দেশনা আসার পর আমাদের লিচু আর আম যুক্ত হয়। প্রায় ২ লাখ টাকার লিচু বিক্রি করেছি এবং আমের সেল সাড়ে ১০ লাখ টাকার বেশি। এভাবে আমার পণ্য বিক্রি হতে থাকে।


উদ্যোক্তা হওয়ার জার্নি এবং বর্তমান সময় সবকিছুর জন্য মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানান নেহা। গর্ব করে নেহা বলেন, এখন গর্ব হয় বলতে যে আমি একজন দেশীয় পণ্যের উদ্যোক্তা। আমার এ পর্যন্ত আসার নেপথ্যের কারিগর হলেন প্রিয়তম স্বামী। তিনি ডেলিভারি থেকে পণ্য কালেকশন; সব কাজে সহায়তা করে থাকেন। পাশাপাশি এখন পরিবারের সবাই মোটামুটি সাহায্য করেন। সেই সাথে সফলতার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমার কাস্টমার ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তাদের সাপোর্ট আর ভালোবাসা না থাকলে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করা খুব কষ্টদায়ক হতো। তাই আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।



নিজের সন্তানতুল্য উদ্যোগ নিয়ে নেহার স্বপ্ন আকাশ ছোঁয়া। চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা পণ্যকে সারাদেশে পরিচয় করিয়ে দিতে চান তিনি। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করছেন। এটাকেও সারাদেশে পৌঁছে দিতে চান তিনি। এটা শুধু দেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও একটা ভালো মার্কেট তৈরি হবে সে স্বপ্ন দেখেন তিনি। সেটা হতে পারে বিদেশে সরাসরি মার্কেটে রফতানি করে। কিংবা প্রবাসীরা আমাদের পণ্য নিয়ে মার্কেট তৈরি করতে পারে। ঐতিহ্যবাহী সিল্ক নিয়ে কাজ করার জন্য নিজের প্রতিষ্ঠানে একদল স্মার্ট ও দক্ষ কর্মীবাহিনী রয়েছেন। পরিকল্পনা রয়েছে ব্যবসার পরিধি বাড়ানোর সাথে সাথে স্থানীয় বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার।


বিবার্তা/গমেজ/কেআর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com