ছোটবেলায় সবার জীবন নিয়ে একটা স্বপ্ন থাকে। সেই স্বপ্ন পূরণে পড়ালেখা করে। বড় হলে কারো সে স্বপ্ন পূরণ হয়। আবার কারোটা পূরণ হয় না। আর পাঁচটা তরুণের মতো তারও মনে স্বপ্ন ছিল। বড় হয়ে হবেন অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। বড় চাকরি করবেন। অনেক টাকা আয় হবে। জীবন হবে সুন্দর। কিন্তু ভাগ্যদেবী তার প্রসন্ন হয়নি। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও মেলেনি কোনো চাকরি। পরে হলেন ফ্রিল্যান্সার। তিনি আজ সফল ফ্রিল্যান্সার।
বলছিলাম আত্মপ্রত্যয়ী সফল ফ্রিল্যান্সার, ২৯ বছর বয়সী তরুণ রেজওয়ান করিমের কথা। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও চাকরি না পেয়ে শুধু মনের জোর ও অদম্য ইচ্ছাশক্তির ফলে তিনি আজ ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ারে সফল হয়েছেন। বর্তমানে ফিনল্যান্ডের একটি স্টার্টআপের সঙ্গে ডাটা অ্যানালিস্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন সফল এই ফ্রিল্যান্সার।
রেজওয়ান করিমের শৈশব-কৈশোর কেটেছে ঢাকার কাফরুলে। বাবা ইঞ্জিনিয়ার। বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে কর্মরত। মা গৃহিনী। ছোট বোন বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিষয়ে পড়াশোনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
রেজওয়ান মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন গাজীপুর প্রাইভেট ক্যাডেট কলেজ খ্যাত গাজীপুর রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে। এরপর অ্যারোনটিকাল ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ থেকে অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষ করেন ২০১৫ সালে।
অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রেজওয়ানের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পর এখন তার দরকার একটা চাকরি। ক্যারিয়ার জীবন শুরুর বিষয়ে তার ভাষ্য, ২০১৬ সালে ‘অ্যারোনটিক্যাল ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ’ থেকে ইন্টার্নশিপ শেষ করলাম। তারপর চাকরি নামক সোনার হরিণের খোঁজ করেছি। অনেক চেষ্টা করেছি, পাচ্ছিলাম না। তখন চিন্তা করি চাকরির জন্য অপেক্ষা করবো না। নতুন কিছু শেখা শুরু করবো। ছোটবেলা থেকেই প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক ছিলো বেশি। ২০০০ সালের শেষের দিকে অনুমতি মেলে বাবার কম্পিউটার চালানোর। কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহটা তৈরি হয় সেখান থেকেই।
ছোটবেলাকার টেকনোলজির প্রতি ঝোঁকটাকে পুঁজি করেই ক্যারিয়ার ডেভেলপের জন্য ইন্টারনেটে ঘাটাঘাটি শুরু করেন রেজওয়ান। এটাকে কিভাবে পেশাগত কাজে ব্যবহার করা যায়। দিন-রাত এক করে ইন্টারনেটে দফায় দফায় রিসার্চ করার পর ২০১৬ সালে সিদ্ধান্ত নেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে ক্যারিয়ার ডেভেলপ করার। অনেক ভেবে-চিন্তে দেখেন ফ্রিল্যান্সিংয়ের শুরুতে তার জন্য সবচেয়ে সহজ ক্যাটাগরি হলো ওয়েব রিসার্চ। ফ্রিল্যান্সিং কাজ করার জন্য ওয়েব রিসার্চকে নির্বাচন করেন রেজওয়ান। ইউটিউবে টিউটোরিয়াল দেখে দেখে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান অর্জন করেন। একদিন অ্যাকাউন্ট তৈরি করেন আপওয়ার্কে। পরে প্রথম তিন মাস শুধু বিড করেন। এরফলে কাজের অভিজ্ঞতা হয়। প্রোফাইলটাও একটু ভারি হয়। একদিন হঠাৎ করে একটা প্রজেক্টের কাজ পান তরুণ এই ফ্রিল্যান্সার। প্রথম কাজটা ছিলো ৭৫ ডলারের। কাজটা সম্পূর্ণভাবে করে দিতে সাতদিন সময় লেগেছিল তার। সেই যে ফ্রিল্যান্সিং শুরু হয় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এভাবে ধারাবাহিকভাবে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কাজ চলতে থাকে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজের অর্ডারগুলো আসে সাধারণত একজন ফ্রিল্যান্সারের কাজগুলো কমিটমেন্ট মতো নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে করে দেয়া, বায়ারের সাথে সঠিক উপায়ে, সময় মতো কথাবার্তা বলা, কৌশলগতভাবে যোগাযোগ করা, যে বিষয়ে কাজ করা সে বিষয়ে বেশি দক্ষ হওয়া এসব কারণে। ২০১৯ সালে এসে হঠাৎ করেই রেজওয়ানের প্রজেক্টের কাজ আসা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন, যে কাজ করছেন সে বিষয়ে তার আরো দক্ষতা বাড়াতে হবে। হতাশ না হয়ে যেসব বায়ারের কাজ করেছেন সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করেন। কোন কাজে কোথায় দুর্বলতা ছিল। কী কী সমস্যা ছিল। আর কী করলে বায়ার হ্যাপী হতো। কাজটা আরো কোয়ালিটিফুল হতো। সব খুঁজে বের করে মনোবল বাড়িয়ে আবারো নিজেকে তৈরি করেন তিনি। এরপর ২০২০ সাল থেকে ধারাবাহিক কাজ আসতে শুরু হয়। তখন কাজ করেই যেনো শেষ করতে পারছিলেন না অধ্যবসায়ী এই ফ্রিল্যান্সার।
পাঁচ বছরে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের প্রজেক্টে কাজ করেছেন রেজওয়ান। তার মধ্যে ব্লুমবার্গ, আপকাউন্সিল, ওয়েফেয়ার অন্যতম। সম্প্রতি রেজওয়ানকে টপ রেটেড প্লাস ফ্রিল্যান্সার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আপওয়ার্ক।
অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার হয়েও ফ্রিল্যান্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়াটাকে পরিবারের কেউ অন্যভাবে দেখেননি। বরং নিজের পড়াশোনার বাইরে গিয়ে কাজ করার সময় পরিবারের সহযোগিতা ছিলো আন্তরিক আর ভালোবাসাপূর্ণ। চাকরি হচ্ছে না এই বলে বসে থাকার চেয়ে নতুন কিছু একটা শুরু করার জন্য সবসময়ই অনুপ্রেরণা দিয়েছে পরিবারের বাবা-মা। তাই এ পর্যন্ত আসার পেছনে পুরো কৃতিত্ব দিতে চান বাবা-মাকে। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা ও মানসিক সাপোর্ট না পেলে হয় তো এ পর্যন্ত আসাই সম্ভব হতো না। বললেন রেজওয়ান।
সে দিনগুলির কথা বলুন যখন আপনাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। রেজওয়ান বলেন, আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে ফ্রিলান্সিং করছি, তাদের প্রায় প্রত্যেকেরই আলাদা একটা সংগ্রামের কাহিনী আছে। লোক লজ্জা হোক বা অন্য কোন কারণেই হোক আমারা এসব প্রকাশ্যে বলি না। ফলে বাইরের একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, একটা ডেস্কটপ পিসি আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকলেই সবাই বড় ফ্রিল্যন্সার হয়ে যায়। ফলাফল খালি ডলার আর ডলার। এই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে প্রতারকেরা প্রতারণার, রমরমা বাণিজ্য করে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, কারো কোন গল্প থাকলে বলে ফেলা উচিৎ। অন্তত মানুষ আসল বিষয়টা জানুক। আমারও অনেক দিন ধরেই ইচ্ছা ছিল যে, আমার এই সংগ্রামের কাহিনী বলি।
সংগ্রামের পুরো ঘটনাটা লেখা শুরু করলে আজ হয়তো আর লেখা শেষই হবে না। তবে একদম ছোট করে বলতে গেলে দিন-রাত এক করে, সারারাত জেগে কাজ করেছি। সবাই দিনে চাকরি করে রাতে আরামে ঘুমাচ্ছে। আর আমি রাতজাগা পাখির মতো জেগে জেগে প্রজেক্টের কাজ করছি। কাজ করতে করতে কখন যে সকাল হয়ে গেছে, অনেক সময় সেটা বুঝতেই পারিনি। এভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাজ করে গেছি। খুব কম সময় শরীরটাকে বিশ্রাম দিয়েছি। তবে এর ব্যতিক্রমও হয়েছে। এমন অনেক সময় গেছে যখন হাতে কোন কাজ ছিলো না। টানা ২-৩ মাস হাতে কোনো কাজ আসেনি। খুব হতাশা হতো মনে। যখন কাজ আসতো তখন কাজ করে শেষ করা যেতো না। আর এমন সময়গুলো হতাশা আর কষ্টে কেটেছে। ওই সময়গুলো ভুলতে পারি না। এখনো মনে হলে কষ্ট পাই। তবে ভেঙ্গে পড়িনি। হার মানিনি। অবিরাম চেষ্টা করে গেছি। পরে আবার কাজ পেয়েছি। আর তাই হয়তো আজকে এই অবস্থানে এসেছি।
ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং কেমন? জবাবে রেজওয়ান জানান, আমার অভভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে এটা দারুণ ও স্বাধীন একটা পেশা। নিজের ইচ্ছা মতো কাজ করা যায়। চাকরিতে যেমন নির্দিষ্ট সময়ে প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত যাওয়া, বসের কথা মতো কাজ করা, ভুল হলে বকা খাওয়া, কাজ শেষ হলে বাসায় ফেরা। বসের কথা মতো সব করতে হয়। ফ্রিল্যান্সিংয়ে সব স্বাধীন মতো কাজ করা। যখন ইচ্ছে হলো কাজ করি। যখন ইচ্ছে হলো না করি না। তবে নির্দিষ্ট সময়ে প্রজেক্ট শেষ করে দিতে হয়। কাজের ধরণটা স্বাধীন। আর একজন ফ্রিল্যান্সার ফ্রিল্যান্সিং করে মাসে লাখ টাকা আয় করতে পারেন। এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০% এর বেশি ফ্রিল্যান্সার মাসে ২ লাখের উপর আয় করে। তবে এই সকল মানুষদের জন্যই ফ্রিল্যান্সিং যাদের অতিরিক্ত লোভ নেই, যারা কাজ শেখার যথেষ্ট ধৈর্য রাখে এবং যারা শর্টকাটে টাকা আয় করার জন্য উপায় বের করে না।
২০২০ সালে ফিনল্যান্ডভিত্তিক একটা স্টার্টআপ থেকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাক আসে রেজওয়ানের। সুযোগ মেলে ১ মাস ইন্টার্নশিপের। কাজের দক্ষতা ও অগ্রগতি দেখে ফুল টাইম ডাটা অ্যানালিস্ট হিসেবে যুক্ত করা হয় তাকে। এরপর থেকে সেখানেই কর্মরত আছেন।
দেশের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মান সম্পর্কে অধ্যবসায়ী এই ফ্রিল্যান্সার বলেন, বর্তমানে দেশে ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোতে অসুস্থ একটা প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং শিখলে অনেক টাকা কামানো যাবে। এই লোভ দেখিয়ে স্বপ্নবাজ ও কোমলমতি তরুণদের কাছ থেকে ফ্রিল্যান্সিং শেখানোর নাম করে একটি প্রতারক চক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকার বিনিময়ে তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে কিন্তু ক্লাসে সঠিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ওই সব প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো। কোর্স শেষ হলে স্টুডেন্টদের মেন্টরিংয়ের ব্যবস্থা থাকে না। পরে তরুণরা প্রাকটিক্যালি ফাইবার, ফ্রিল্যান্সারডটকম বা আপওয়ার্কে কাজ করতে গিয়ে নানান সমস্যায় পড়ছেন। ফলে কাজ করতে পারছে না। এভাবে হতাশ হচ্ছে হাজার হাজার তরুণ।
যারা ফ্রিল্যান্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান তাদের উদ্দেশে রেজওয়ান বলেন, একজন ফ্রিল্যান্সারের ফ্রিল্যান্সিং কাজ করে টাকা আয় করতে যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকার দরকার, প্রথমত, এক কঠোর পরিশ্রম, দ্বিতীয়ত, মেধা ও তৃতীয়ত ধৈর্য। আর যে বিষয়গুলো বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে সেগুলো হলো, চটকদার বিজ্ঞাপন যুক্ত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে দূরে থাকুন। নিজে শেখার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে গুগল, ইউটিউবের সাহায্য নিন। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে যদি যেতেই হয়, আগে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে জানুন। তারা ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে কতোটা জানে। প্রতিষ্ঠানের সফলতা আছে কিনা। প্রয়োজনে আপনার পরিচিত এই খাতে সফল কেউ থাকলে তার পরামর্শ নিন। অল্প সময়ে হাজার হাজার ডলার আয় করার কথা যারা বলে তাদের এড়িয়ে চলুন। আপনার দক্ষতাকে গুরুত্ব দিন। আর দক্ষতা বৃদ্ধি করুন।
রেজওয়ান শুধু অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ার, ফ্রিল্যান্সারই না। তিনি একজন সংগীতপ্রেমীও। খুব ভাল পিয়ানো বাজান। সেইসাথে ভালো গায়ক। চমৎকার গান করেন তিনি। তার অবসর সময় কাটে পিয়ানো বাজিয়ে। পিয়ানো বাজানো তার অন্যরকম একটা শখ। বর্তমানে বাবার কিনে দেয়া পিয়ানো নিয়ে অবসর কাটাচ্ছেন। গান তৈরি করে নিজের ভেরিভাইড স্পটিফাই প্রোফাইল ও ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করছেন নিয়মিত।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে রেজওয়ান জানান, আমাদের দেশের তরুণরা অনেক মেধাবি। হাজার হাজার তরুণ রয়েছেন যারা পড়ালেখা করে কোন চাকরি খুঁজে পাচ্ছেন না। এসব শিক্ষিত ও বেকার তরুণদের জন্য বিনামূল্যে ফ্রিল্যান্সিং শেখার ব্যবস্থা করতে চাই। নিজের কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে অবসর সময়ে, সম্পূর্ণ বিনামূল্যে তরুণদের অনলাইনে ট্রেনিং করার পরিকল্পনা আছে। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হবে বেকার যুব-সমাজের কর্মসংস্থান।
বিবার্তা/গমেজ/জাই
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]