শিরোনাম
মিতুর ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে ওঠার পেছনের কথা
প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২১, ১৯:৪৪
মিতুর ফ্যাশন ডিজাইনার হয়ে ওঠার পেছনের কথা
উজ্জ্বল এ গমেজ
প্রিন্ট অ-অ+

ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের প্রতি আলাদা একটা ঝোঁক ছিল।সময় পেলেই কাগজে আঁকাআঁকি করতাম।ওই আঁকাআঁকিগুলোর বিষয় থাকতো বিভিন্ন জামার ডিজাইন নিয়ে। নিজের জামা নিজেই ডিজাইন করতাম। ছোট থেকেই ইচ্ছা ছিল দেশী পণ্য নিয়ে কিছু করার। অন্যোর অধীনে না থেকে আত্মনির্ভরশীল হয়ে কিছু একটা করার। সব সময় ভেবেছি নিজের একটা আলাদা পরিচিতি থাকবে। নিজের পরিচয়ে সবার কাছে হবো পরিচিত। আর স্বপ্নের মতো কেমন করে সেই ইচ্ছাটা পূরণও হয়ে গেল। আলহামদুলিল্লাহ।


এভাবেই নিজের জীবনের ইচ্ছে পূরণের গল্প বলছিলেন ফ্যাশন ডিজাইনার ও ‘সাজ ফ্যাশন’-এর স্বত্বাধিকারী রাদিকা ইসলাম মিতু। শৈশবের ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের প্রতি তার ভাললাগাটা আজ বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। এর কারণ মিতু কাকতালীয়ভাবে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়ে যান ফ্যাশন ডিজাইনার স্বামী। দুজনের চিন্তা-ভাবনা মিলে যাওয়াতে মিতু আজ স্বাবলম্বী নারী উদ্যোক্তা। নিজের আলাদা পরিচিতি তৈরি হয়েছে।


সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী শাহজাদপুর উপজেলার দ্বারিয়াপুর গ্রামে জন্ম রাদিকা ইসলাম মিতুর। ছোট থেকে এখানেই তার বেড়ে উঠা। বাবা পেশায় একজন ব্যবসায়ী। মা গৃহিণী। তিন ভাই-বোনের মধ্যে মিতু মেজো।


শাহাজাদপুরের স্বনামধন্য স্কুল রংধনু কিন্ডার গার্টেন অ্যান্ড মডেল হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং কলেজ শাহাজাদপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন মিতু। বর্তামানে তিনি ঢাকায় জাতীয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক ২য় বর্ষে পড়াশোনা করছেন।


ফুল বাগানে রাদিকাইসলামমিতু।


এইচএসসি পরীক্ষার পর নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার কথা বলতে গিয়ে মিতু জানান, সবেমাত্র এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। হাতে অনেক সময় ছিল। তাই ঢাকাতে বড় বোনের বাসায় ঘুরতে আসি। বোনকে দেখতে এসে হঠাৎ করেই জীবনে ঘটে যায় এক বড় ঘটনা। আমাকে দেখতে আসেন এক ছেলে। তিনি বুটিকের কাপড়ের ব্যবসা করেন। নিজস্ব বুটিকের ফ্যাক্টরি আছে। কথা হয় তার সাথে বিস্তারিত। আমারও ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশনের প্রতি আগ্রহ আর ভাললাগা কাজ করতো। তাই ভাবনায় যোগ হলো নতুন পালক। শুধু এই ভাবনার মিলের কারণেই কোন ভাবনা-চিন্তা না করে হুট করেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। বিয়ে হয় আনুষ্ঠানিকভাবে।


নিজস্ব বুটিক ফ্যাক্টরির ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ে হওয়াতে মিতুর জীবনের স্বপ্ন পূরণের কাজটা আরো সহজ হয়ে গেল। মিতুর ভাষ্য, স্বামীর ব্যবসাটা ২০০৮ সাল থেকে অফলাইনভিত্তিক ছিল। আমি তার জীবনে আসার পর ভাবলাম এখন তো ই-কমার্সের যুগ। তাহলে শুধু অফ লাইনে কেন? অনলাইনেও শুরু করি ব্যবসাটা। যেই ভাবা সেই কাজ। পরে ফ্যাক্টরির নাম অনুসারেই ফেসবুকে ‘সাজ ফ্যাশন’ নামে একটা পেজ খুলি। শুরু করি প্রচার প্রচারণার কাজ। ব্র্যান্ডিং করি নিজের ব্যবসাকে। পেজে বিভিন্ন কাপড়ের পোস্ট করতে থাকি।


নারী হিসেবে অনলাইনে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে প্রথমে নানান সমস্যায় পড়েন মিতু। তিনি বলেন, আমাদের সমাজে নারীরা কিছু করতে চাইলেই সামাজিক, পারিবারিক কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আমারও হয়েছে। কিন্তু আমি থেমে ছিলাম না। সবসময় বার বার চেষ্টা করেছি। কিভাবে সব আবার ঠিক করা যায়। নিজের আন্তরিক চেষ্টা, নিরলস কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে এখন সব ঠিক হয়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ। এখন আমার কাজে সব থেকে বেশি সাপোর্ট পাই বাবা-মা এবং স্বামীর কাছ থেকে। জীবনের যেকোনো উদ্যোগ বাস্তবায়ন বা ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে পরিবারের সাপোর্ট সবথেকে বড় বিষয়। এটা সাথে না থাকে সংসার সামলে ব্যবসাটা এগিয়ে নেয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে।


মিতুর সব সময় ইচ্ছে ছিল আত্মনির্ভরশীল হওয়ার। নিজে থেকে কিছু করার। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। তিনি বলেন, অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে বসের কথা মতো সব কিছু করতে হবে। নিয়ম মেনে কাজে যেতে হবে। আবার নির্দিষ্ট সময়ের পর বাসায় ফিরতে হবে। আর নিজের প্রতিষ্ঠান হলে স্বাধীনভাবে কাজ করা যাবে। নিজের ব্যবসার উন্নয়নে যত খুশি সময় কাজ করা যাবে। আর যখন ইচ্ছে হবে না তখন কাজ করবো না। আর ভাগ্যচক্রে নিজস্ব একটা প্রতিষ্ঠানও পেয়েছি। আর সে অনুসারে কাজও করছি। এখন সবসময় ভাবি দুজনে মিলে কিভাবে ব্যবসাটাকে আরো উন্নত করা যায়। দেশীয় পোশাক নিয়ে কাজ করে কীভাবে দেশের হারিয়ে যাওয়া কৃষ্টি-সংস্কৃতি ধারক, বাহক দেশীয় পোশাকের ঐতিহ্যকে আবার মানুষের মাঝে ফিরিয়ে আনা যায়। তাই আমাদের ব্যবসার স্লোগান ‘পোশাকে বাংলার ঐতিহ্য’।


২০১৮ সালে মৌচাকে একটা শোরুম চালু করেন মিতু। শোরুমে মূলত দেশীয় থ্রি-পিস, ওয়ান-পিস, টু-পিস,ফোর-পিস, প্লাজো ইত্যাদি বিক্রি করা হয়। কাজের বিষয়ে মিতু বলেন, আমরা সব সময় ক্রেতার কথা মাথায় রেখে আরামদায়ক ফ্রেবিক্স দিয়ে পোশাক তৈরি করে থাকি। যেমন-সুতি, তাঁত, কটোন, মসলিন, তাঁত কটোন, জামদানি, স্পালপ কটোন, লিলিয়েন ইত্যাদি ফ্রেবিক্স ব্যাবহার করে থাকি। পোশাকে সাধারণত ব্লক, বাটিক, কারচুপি, এমব্রয়ডারি, স্নায়েল এমব্রয়ডারি, ম্যানুয়েল এমব্রয়ডারি, কম্পিউটার এমব্রয়ডারি ইত্যাদি কাজ করে থাকি।


নিজ অফিসে ফ্যাশন ডিজাইনার রাদিকাইসলামমিতু।


স্বামী প্রফেশনাল ফ্যাশন ডিজাইনার। প্রথমে দুজনে মিলে পরিকল্পনা করেন। কি ডিজাইন করবেন, কীভাবে করবেন, কতগুলো করবেন ইত্যাদি। সে পরিকল্পনা অনুসারে সব ডিজাইন দুজনে মিলেই করেন। মিতু তার স্বামীর কাজগুলো দেখে প্রতিদিন একটু একটু করে শিখছেন। অন্যদিকে স্বামীও তাকে ফ্যাশন ডিজাইনের কাজগুলো হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন।


২০২০ সালে মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে সারাদেশে চলছিল লোকডাউন।অফিস ফ্যাক্টরি বন্ধ। কাজ নাই। হাতে অনেক সময়। সুযোগ পেলেই ফেসবুকে ঘোরাফেরা করেন মিতু। একদিন ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ তার মোবাইলে ভেসে উঠে দেশীয় নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপটি।


গ্রুপটা কিছুক্ষণ ঘুরে সব কার্যক্রম ভাল লাগাতে সাথে সাথে এড হয়ে যান। এ বিষয়ে মিতু বলেন, গ্রুপে জয়েন করার পর রাজিব আহমেদ স্যার, নাসিমা আক্তার নিশা আপু ও গ্রুপের অন্যান্য সবার অণুপ্রেরণামূলক পোস্ট পড়তে অনেক ভালো লাগে। অনেক অণুপ্রেরণা পাই। ভাবলাম দেশী পোশাক নিয়ে কাজ করছি। আর আমাদের ফ্যাক্টরির সব ড্রেস দেশীয়। অন্যদিকে উই দেশী পণ্যের প্লার্টফর্ম। এখানে সব দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করা হয়। তাই আর অন্য কিছু না ভেবে নিজের কাছে জমানো আট হাজার টাকা দিয়ে ফ্যাক্টরি থেকে কয়েকটা ড্রেস নিয়ে গ্রুপে পোস্ট করা শুরু করি।


উই গ্রুপে সবার অণুপ্রেরণামূলক পোস্টগুলো পড়ে নতুন উদ্যোমে নিয়মিত পোস্ট করতে থাকেন মিতু। কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দিয়ে শুধু কাজ করে যেতে থাকেন। তার হাতের কাজ মানুষের ভাল লাগে। ধীরে ধীরে ক্রেতারা কিনতে শুরু করেন। এর পরে নিয়মিত কিনতে থাকেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই উই গ্রুপে লাখপতি হয়ে যান তিনি। অল্প সময়ের মধ্যে ‘সাজ ফ্যাশন’ এর পোশাক বাংলাদেশের প্রায় সব জেলাতে পৌঁছে যায়।


উই গ্রুপে সবার কাছে পরিচিত হওয়ার পর উদ্যোগের সাথে নতুন কিছু পণ্য যোগ করেন মিতু। যেমন-সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরের ঐতিহ্যবাহী খাঁটি গাওয়া ঘি, সরিষার তেল, কালোজিরার তেল, সুন্দরবনের মধু, কাঠ বাদাম, কাজু বাদাম, পেস্তা বাদাম ও রান্নার বিভিন্ন মসলা।


উই এখন দেশের একমাত্র দেশীয় পণ্যের সবচেয়ে বড় অনলাইন প্লার্টফর্ম। মিতু বলেন, এই গ্রুপের কল্যাণে আমি আজ লাখপতি হয়েছি। একজন উদ্যোক্তা হয়েছি। নিজের পণ্যগুলোর মধ্য দিয়ে সবার কাছে পরিচিত হতে পেরেছি। এর জন্য উইয়ের প্রেসিডেন্ট নাসিমা আক্তার নিশা আপু এবং আমাদের সবার মেন্টর শ্রদ্ধেয় রাজীব আহমেদ স্যারকে অনেক ধন্যবাদ। উদ্যোক্তাদের দেশী পণ্য নিয়ে কাজ করার এমন সুন্দর একটা প্লার্টফর্ম তৈরি করার জন্য। প্রতিনিয়ত নিশা আপু, কবির সাকিব ভাইয়া, শেখ লিমা আপুসহ আরও অনেক আপু ভাইয়াদের পোস্ট পড়ে অণুপ্রেরণা পাচ্ছি এবং অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারছি।



সন্তান নিয়ে রাদিকা ইসলাম মিতু।


উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে প্রত্যেকজন নারীকেই অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। মিতুর তেমন কিছু সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। কিন্তু ধৈর্য ধরে লেগে থেকে সেই সব বাধাকে অতিক্রম করেছেন তিনি। এখন তার স্বপ্নের উদ্যোগে স্বামী হলেন বড় সাপোর্টার। অফিস ফ্যাক্টরি সামলিয়ে শত ব্যস্ততার মাঝেও তার পাশাপাশি উদ্যোগের পণ্যগুলো ডেলিভারি করে দেন স্বামী।


দেশী পণ্যকে দেশসহ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চান মিতু। স্বপ্ন দেখেন ‘সাজ ফ্যাশন'-কে একটা নামকরা দেশীয় ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে। ‘সাজ ফ্যাশন’যেহেতু সম্পূর্ণ দেশী পণ্য নিয়ে কাজ করছে, তাই তার দৃঢ় বিশ্বাস ব্র্যান্ডটি কাজের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একদিন পুরো বিশ্বের কাছে তুলে ধরবে। দেশী পণ্যের জয় হোক। তার মতে, আসুন দেশি পণ্য কিনি এবং দেশের টাকা দেশেই রাখি।


বিবার্তা/গমেজ/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com