শিরোনাম
রোকেয়া আক্তার জামদানিকে নিয়ে যেতে চান বহুদূর
প্রকাশ : ২৩ মার্চ ২০২১, ১৯:০৮
রোকেয়া আক্তার জামদানিকে নিয়ে যেতে চান বহুদূর
বিপাশা দাশ
প্রিন্ট অ-অ+

নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স গ্রুপের (উই) হাত ধরে উঠে এসেছে দেশীয় পণ্যের হাজারো এফ-কমার্স ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা। যারা একাই দেশী পণ্য সেল করে কেউ হচ্ছেন লাখপতি, আবার কেউ বা হচ্ছেন মিলিয়নার। সবাই নিজেদের পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং করার মাধ্যমে নিজ নিজ জেলাকে রিপ্রেজেন্ট করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।


বন্দরনগরী চট্টগ্রামের তেমনি একজন এফ-কমার্স ব্যবসায়ী রোকেয়া আক্তার। এক হাতে স্বামী-সন্তান, পরিবার সব সামলে এগিয়ে নিচ্ছেন জামদানি নিয়ে নিজের উদ্যোগকে।


সব ব্যবসায়ীর জীবনেই একটা পরিচয় তৈরি করার গল্পটা স্বতন্ত্র। কারো থাকে খুবই চ্যালেঞ্জের, কারো থাকে নানান চড়াই-উৎরাই পেরোনোর। রোকেয়া আক্তারের এফ-কমার্স ব্যবসায়ী হয়ে উঠার গল্পটা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। তার ব্যবসায়ী জীবনের গল্প শুনতে গিয়ে উঠে আসে তার জীবন সংগ্রামের পেছনের কথা।


নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম রোকেয়া আক্তারের। গ্রামের সহজ-সরল পরিবেশেই কাটে তার শৈশবের দিনগুলি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা নিতে হয় নিজের জন্মভূমিতেই।



উইয়ের প্রতিষ্ঠাতা নাসিমা আক্তার নিশার সাথে রোকেয়া আক্তার


গ্রামের আর পাঁচটা মেয়ের মতো খুব ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা শেষ করে ব্যাংকে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু বিধি বাম। ভাগ্য তার আর প্রসন্ন হলো না। পড়ালেখা শেষ হতেই পারিবারিকভাবে তাকে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ভেবেছিলেন আর বুঝি তার ব্যাংকে চাকরি করা হবে না।


বিয়ের পর স্বামী-সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন রোকেয়া। সময়ের পালা বদলে সংসারে তার কোল আলো করে আসে ছেলে সন্তান। মা হন তিনি। সংসারে দিনরাত কাজ করলেও ব্যাংকে চাকরি করার মনের ইচ্ছেটা সব সময় তাকে তাড়না দিতো। একদিন মনে সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে নিজের অব্যক্ত ইচ্ছের কথা জানান স্বামীকে। স্বামীও তার ইচ্ছের মূল্য দিলেন। অনুমতি পেয়ে স্বামীর সহযোগিতায় একটা ব্যাংকে চাকরি হয়ে যায় রোকেয়ার। দীর্ঘ দিনের ইচ্ছে পূরণ হয় তার।


শুরু হয় সংসারি স্ত্রীর চাকরির জীবন। স্বামী-সন্তান, সংসার সামলে অফিস করা শুরু করেন। ছেলেকে বাসায় রেখে চাকরিতে যেতেন তিনি। ছোট ছেলেকে বাসায় রেখে এভাবে কিছু দিন কাজ করার পরে আর সেটা এগিয়ে নেয়া সম্ভব হলো না। আসল সমস্যা ছিল ছেলেকে দেখাশুনা করার কেউ ছিল না। ছেলের জন্য তাকে চাকরি ছাড়তে হলো। শুরু হয় তার হতাশার জীবন। এতো দিনের ইচ্ছে পূরণ হতে গিয়েও আর হলো না। জীবন বাস্তবতা তাকে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে থাকে। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দেন সংসারে। ভেবেছিলেন তার দ্বারা জীবনে আর কিছুই করা হবে না। মেনে নেন বাস্তবতাকে।


সংসারের কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে ঘুরে বেড়াতেন। বন্ধু-বান্ধবের সাথে যোগাযোগ, টুক-টাক কথাবার্তা হতো। রোকেয়া এভাবে ফেসবুকে ঘুরতে ঘুরতে ২০২০ সালে হঠাৎ একদিন নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স গ্রুপ (উই) এর দেখা পাই।কৌতুহল নিয়ে যোগ দেন। গ্রুপের নিয়ম-কানুনগুলো পড়ে সে অনুসারে দিনের পর দিন সময় দিয়ে যান। জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ই-কমার্স কী, কীভাবে এই প্লাটফর্মে নারীরা যুদ্ধ করে নিজের পায়ে দাড়াচ্ছেন এসব বিষয়গুলো তাকে আরো কৌতূহলী করে তুলে। উইয়ের হাত ধরে দেখা পান তার জীবনের সেরা শিক্ষক সার্চ ইংলিশ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং ই-ক্যাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদের সাথে। সেই জানার ও শেখা শুরু হয় আর শেষ হয় না।



ই-ক্যাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদের সাথে রোকেয়া আক্তার ও লেখক।


উই গ্রুপে দিন-রাত এক করে নিয়মিত সময় দিয়ে পড়ালেখা করার ফলে ধীরে ধীরে জীবন থেকে হতাশা শেষ হতে থাকে। সংগ্রামী নারীদের জীবন সংগ্রাম দেখে ও পড়ে নতুন প্রেরণা জাগে মনে। নতুনভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করেন রোকেয়া। কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস অধ্যবসায় দেখে গ্রুপের মডারেটরের চোখে পড়েন তিনি। সেই সুবাদে উইয়ের বিভিন্ন ট্রেনিং যেমন, হাইটেক পার্কের ট্রেনিং, কোর্সেরা, ওয়াইফাই, সব ধরনের ট্রেনিংয়ে সুযোগ পান। এসব ট্রেনিং তাকে নতুন করে প্রস্তুত করার সুযোগ করে দেয়। ফিরে পান নতুন উদ্যম, নতুন প্রেরণা, নতুন জগত। এমন সুন্দর সুযোগ করে দেয়ার জন্য রোকেয়া উই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও জননী নাসিমা আক্তার নিশাকে জানান অন্তর থেকে কৃত্জঞতা ও ধন্যবাদ।


উই গ্রুপে দিন-রাত সময় দিয়ে ও বিভিন্ন ট্রেনিং কোর্স করে অনলাইনে ব্যবসা করার প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করে যখন নিজের উপরে আত্মবিশ্বাস তৈরি হয়। তখন তিনি ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন। কী নিয়ে কাজ করা যায়? ভাবেন দেশীয় ঐতিহ্যবাহী জামদানিকে নিয়েই শুরু করা যাক। যেই কথা সেই কাজ। শুরু করেন জামদানিকে নিয়ে লেখালেখি। এর খুঁটিনাটিসব বিষয়ে সবার কাছে লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেন। জামদানির উপরেই ফোকাস করার চেষ্টা করেন। এভাবেই রোকেয়া দেশীয় পণ্য জামদানি শাড়ি নিয়ে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। তার অনলাইন ব্যবসার আইটেম হিসেবে রয়েছে জামদানি শাড়ি, পাঞ্জাবি, টু পিছ, থ্রি পিছ ইত্যাদি। ইতোমধ্যেই বেশ ভাল সাড়া পেয়েছেন। উইতে তার বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ১২ হাজার টাকা।


রোকেয়ার ভাষ্য, আজ আমি যা আমার সব কিছু হয়েছে উইয়ের জন্য। উই হলো আমাদের সবার মনের জানালা। যা আমাদের সবার স্বপ্ন পূরণ করে যাচ্ছে প্রতিদিন। আর এই স্বপূরণে সাহায্য করছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজিব আহমেদ স্যার। উনার শিক্ষায় ও দেখানো পথে চলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা জানাতে চাই নাসিমা আক্তার নিশা আপুকে, আপু আমাদের জন্য উইকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, আপু আমদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের দক্ষ করার জন্য এতো এতো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করেছেন। আপুর প্রতি আমি অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। দোয়া করি আপু যেনো দীর্ঘ জীবন লাভ করেন।



স্বামীর সাথে রোকেয়া।


নিজের পরিবারের প্রত্যেকজনের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন রোকেয়া। তিনি বলেন, আমাকে এ পর্যন্ত এই পর্যায়ে আসতে যাদের সাহায্য ছাড়া অকল্পনীয় ছিল তারা হলেন আমার আম্মা ও আব্বা। আমার চোখের পানি যাদের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে কস্টের কারণ। আমার হাজবেন্ড ও আমার শ্বাশুড়ি আমাকে সব সময় অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। আমি সবার দোয়া নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।


জামদানি নিয়ে আমার স্বপ্ন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যাক আমাদের দেশের এই ঐতিহ্য। আমি চাই জামদানি আমার কোন আলাদা পণ্য নয়। জামদানি আমাদের আমার বাংলাদেশের। তাই সারা দুনিয়ায় এর গৌরব ছড়িয়ে দিতে চাই। ফিরে আসুক জামদানির হারানো দিন। আমি সেই লক্ষ্যে কাজ করে যেতে চাই।আমার স্বপ্ন বিদেশিরা জামদানির ফিউশান পরুক আর বলুক, মেড ইন বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে জামদানি নিয়ে যেসব কাজ করছি এর উপরে অদূর ভবিষ্যতে সব ধরনের ফিউশান থাকবে। সেই সাথে ইচ্ছে আছে মসলিন ও সিল্কের সব ফিউশান নিয়ে কাজ করার।


বিবার্তা/গমেজ/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com