শিরোনাম
রাজারবাগ দরবার শরীফের ৬ ব্যক্তি নিখোঁজ
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ২১:৫৪
রাজারবাগ দরবার শরীফের ৬ ব্যক্তি নিখোঁজ
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীর রাজারবাগ দরবার শরীফের অনুসারী ৬ ব্যক্তি নিখোঁজের অভিযোগ উঠেছে। তবে কে বা কারা এ ঘটনা ঘটাচ্ছে তা এখনো বের করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। উদ্ধার হননি নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরাও।


জানা গেছে, প্রথমে ২১ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে নিখোঁজ হন শাকেরুল কবির (৩৮) ও তার গাড়ি চালক শাওন (২৫)। এরপর শাকেরুল কবিরের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহজাহানপুর থানায় জিডি (নং-১১৩৪) করেন তার শ্যালক মাহমুদুল হাসান সুমন। এরপর ২৬ সেপ্টেম্বর জিডির অগ্রগতি জানতে থানায় যান মাহমুদুল হাসান সুমন (৩০) ও তার সহযোগী নুরুল গনি ফারুক (৪৩)। রাত সাড়ে ১১টায় থানা থেকে ফিরে আসার পথে শাহজাহানপুর থানার মাত্র ৩০ গজের মধ্যে ওই দুইজনকে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাতরা। পরবর্তীতে ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ অপহৃতদের কাপড় ও ধস্তাধস্তির আলামত উদ্ধার করে। এরপর শাহজাহানপুর থানাধীন শান্তিবাগ এলাকা থেকে ইহসানুল করিম উজ্জল (৩৫) ও তার সহযোগী জহিরুল ইসলামকে (৩৮) একদল অজ্ঞাত ব্যক্তি কালো গ্লাসের মাইক্রোতে তুলে নিয়ে যায়, যা সিসিটিভি ফুটেজে দৃশ্যমান হয়।


অপহৃত শাকেরুল কবিরের স্ত্রী মুসলিমা সুমী বলেন, আমার স্বামী ও ভাইকে গুম করার পর বিভিন্ন নম্বর থেকে ফোন করে আমাকে কান্না ও চিৎকারের আওয়াজ শোনায়। মনে হচ্ছে, তাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন করা হচ্ছে। এমন শব্দ শুনে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি।
মাহমুদুল হাসান সুমনের বাবা মুহম্মদ মোস্তফা বলেন, জিডিকারীকে যদি থানার ৩০ গজের মধ্যে নিখোঁজ হতে হয়, তবে আমরা কার কাছে নিরাপত্তা চাইবো?


গুম হওয়া নুরুল গনি ফারুকের স্ত্রীর ভাই আমিনুল ইসলাম জানান, আমার দুই শিশু ভাগিনার প্রচণ্ড জ্বর, ডেঙ্গুর লক্ষণ। আমার বোন দুই বাচ্চাকে নিয়ে হাসপাতালে দৌড়াচ্ছে, এর মধ্যে ভগ্নিপতি নেই। কি যে একটা অবস্থা তা বলে বোঝাতে পারবো না। আমার ভগ্নিপতিও উচ্চমাত্রার ডায়বেটিকসের রোগী।


আমিনুল ইসলাম আরো বলেন, কারা তাদের অপহরণ করছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। আমরা প্রশাসনের কাছেই বিষয়টি জানতে চেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোন সদুত্তর পাই নাই।
তিনি বলেন, আমি ২ দিন ধরে থানায় দৌড়াদৌড়ি করছি। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কারো তেমন গুরুত্ব দেখছি না। ‘এখন না তখন, তখন না এখন’ বলে থানা আমাদের ঘুরাচ্ছে। থানায় বিচার চাইতে গিয়ে মানুষ গুম হয়ে গেলো, আর সেটাকে যদি গুরুত্ব সহকারে না নেয়া হয়, তবে দেশের প্রশাসনের কাছে আমরা কিভাবে আস্থা রাখবো?
গুম হওয়া ইহসানুল করিম উজ্জলের ভাই শামসুল আলম মাসুদ বলেন, আমার ভাই খুব সহজ সরল মানুষ। সিসিটিভি ফুটেজে আপনারা দেখেছেন, কিভাবে তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যারা তুলে নিয়েছে তাদের চেহারাও স্পষ্ট। যে গাড়িতে করে তুলে নিয়েছে তার নম্বর প্লেটও (ঢাকা মেট্রো চ–৫৩-৩৭১৮) দেখা যাচ্ছে। ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা হয়ে গেলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী আমার ভাইকে উদ্ধার করতে না পারায় আমি হতাশ।


গুম হওয়া ব্যক্তিদের সুস্থ অবস্থায় দ্রুত ফিরে পেতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তাদের স্বজনরা।


এদিকে রাজারবাগ দরবার শরিফের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। পাশাপাশি দরবার শরিফ বা পীরের অনুসারীদের কোনো অংশ জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত কি না, তা খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে।


১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লুর রহমানের ‘অনুসারীদের’ করা মানবপাচারসহ বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় নাকাল আট ভুক্তভোগীর রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়।


এর আগে রাজারবাগ দরবার শরিফ ও পীর দিল্লুর রহমানের সম্পদ ও ব্যাংক হিসাব তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট আবেদন করেন আট ব্যক্তি।


তারা হলেন- মো. আব্দুল কাদের, মাহবুবুর রহমান খোকন, ফজলুল করিম, জয়নাল আবেদিন, মো. আলাউদ্দিন, জিন্নাত আলী, আইয়ুবুর হাসান শামীম, নাজমা আক্তার ও নারগিস আক্তার।


তাদের অভিযোগ, পীর দিল্লুর রহমানের অনুসারীরা দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাদের বিরুদ্ধে মানবপাচারসহ ফৌজদারি মামলা করে হয়রানি করছে।


এসব মামলা কারা করেছে, তাদের চিহ্নিত করে আদালতে প্রতিবেদন দিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রতিবেদনটিও ৬০ দিনের মধ্যে দিতে বলেছে আদালত।


এছাড়া হয়রানি, অপদস্ত করতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফৌজদারি মামলাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।


পীর দিল্লুর রহমানের অনুসারী চক্রের ‘অস্তিত্বহীন’ বাদীর মামলা চ্যালেঞ্জ করে গত ৭ জুন হাইকোর্টে রিট করেন ঢাকার শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চন।


সেই আবেদনের প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট এসব ‘অস্তিত্বহীন’ মামলার বাদীকে খুঁজে বের করতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছিল। নির্দেশ অনুযয়ী সিআইডি অনুসন্ধান প্রতিবেদন দিলে গত ৬ সেপ্টেম্বর সেটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়।


সে প্রতিবেদনে শান্তিবাগ এলাকার বাসিন্দা একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, অ্যাসিড নিক্ষেপ, মানবপাচারের মতো নানা অভিযোগে ৪৯টি মামলার পেছনে রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের সম্পৃক্ততা উঠে আসে।


ওই প্রতিবেদন দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে বিচারপতি ইনায়েতুর রহিম সেদিন বলেছিলেন, বাংলাদেশে পীর সাহেবের কাণ্ড দেখেন! জায়গা জমি দখলের জন্য পীর সাহেব কী করেছেন দেখেন! সম্পত্তির জন্য তথাকথিত মুরিদ দিয়ে মামলা করিয়েছেন। পীর সাহেবের কেরামতি দেখেন!


সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের তিন ভাই এক বোন। তাদের বাবা চিকিৎসক আনোয়ারুল্লাহ ১৯৯৫ সালে মারা যান।


বাবার মৃত্যুর পর কাঞ্চনের বড় ভাই আক্তার-ই-কামাল, মা কোমরের নেহার ও বোন ফাতেমা আক্তার রাজারবাগের পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হন। কিন্তু একরামুল আহসান কাঞ্চন ও তার আরেক ভাই কামরুল আহসান বাদলকে বিভিন্ন সময় প্ররোচিত করেও মুরিদ করা যায়নি। কামরুল আহসান বাদল পেশায় চিকিৎসক।


রাজারবাগ দরবার শরিফের পেছনেই ৩ শতাংশ জমির উপর তিন তলা পৈত্রিক বাড়ি কাঞ্চনদের। পীর দিল্লুর রহমানের মুরিদ হওয়ার পর কাঞ্চনের মা, ভাই-বোনের কাছ থেকে তাদের পৈত্রিক জমির বেশিরভাগ অংশ পীরের দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করা হয়।


কাঞ্চন ও বাদলের অংশও দরবার শরিফের নামে হস্তান্তর করার জন্য পীর দিল্লুর ও তার অনুসারীরা বিভিন্নভাবে চাপ দেয়। কিন্তু কাঞ্চন ও তার ভাই সম্পত্তি হস্তান্তর না করায় পীর দিল্লুর রহমান ও তার অনুসারীরা ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় ‘হয়রানিমূলক’ মামলা দায়ের করেন।


সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, একরামুল আহসান কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় মোট ৪৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে জিআর (পুলিশি মামলা) মামলা ২৩টি এবং সিআর (নালিশি মামলা) মামলা ২৬টি। ইতোমধ্যে ১৫টি জিআর মামলা এবং ২০টি সিআর মামলায় কাঞ্চন আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন। বর্তমানে ১৪টি মামলা আদালতে বিচারাধীন, যার মধ্যে আটটি জিআর এবং ছয়টি সিআর মামলা।


প্রসঙ্গত, ৪৯ মামলায় ৮ বছর জেল খেটেছেন কাঞ্চন।


বিবার্তা/আবদাল

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com