রাজনীতি
‘প্রোডাক্টিভ রমাদানে’র আড়ালে ক্যাম্পাসগুলোতে সক্রিয় হচ্ছে শিবির
প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৩৮
‘প্রোডাক্টিভ রমাদানে’র আড়ালে ক্যাম্পাসগুলোতে সক্রিয় হচ্ছে শিবির
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতাকারী দল জামায়াত ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গোপনে সক্রিয় আছে। ক্যাম্পাসগুলোতে রাষ্ট্রবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলনে ইন্ধন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে শিবিরের বিরুদ্ধে। পবিত্র রমজান মাসকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিবিরের সক্রিয়তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মহানগরী, জেলা ও থানা পর্যায়ের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মসজিদগুলোতে ইফতার পার্টির নামে প্রতিদিন ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক আলোচনা সভার আড়ালে কর্মী সভা করছে শিবির। ধর্মীয় অনুভূতি পুঁজি করে এমন মসজিদ কেন্দ্রীক কার্যক্রম পরিচালনা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীতাকারী দলটির ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে।


সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের প্রবেশকে কেন্দ্র করে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উস্কে দিয়ে আন্দোলনে নামানোর পিছনেও শিবিরের হাত রয়েছে। জানা গেছে, বুয়েটে সাংবাদিক সমিতি নামে একটি সংগঠন রয়েছে, তবে সেখানে কোন পত্রিকা বা টেলিভিশনের সাংবাদিক নেই। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মইনউদ্দিনসহ আরো ৪ জন টাঙ্গুয়ার হাওরে রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছিল। সাংবাদিক সমিতির পেজ ব্যবহার করে গত ২৮ মার্চ সেহরির সময় গুজব ছড়িয়ে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের উস্কানি দেয়া হয়েছিল।


এদিকে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ইফতার পার্টি আয়োজনের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সুযোগ নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে ছাত্র শিবির। ইতোমধ্যে গণইফতারসহ বিভিন্ন ব্যানারে ক্যাম্পাসগুলোতে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে সংগঠনটি। প্রথম রমজানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পায়রা চত্বরে গণইফতারের আয়োজন করে একদল শিক্ষার্থী।


সূত্র জানায়, ওই গণইফতার আয়োজনের নেতৃত্ব দিয়েছে শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার বিভিন্ন স্তরের নেতারা। এছাড়া সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইফতার আয়োজন করে শিবির। তবে সরাসরি শিবিরের ব্যানারে না হওয়ায় তেমন কোন বাধার মুখে পড়ছে না তারা।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০ রোজা পর্যন্ত দেশের অর্ধশতাধিক কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এবং ন্যূনতম ৯টি জেলা ও ১৫টি থানা পর্যায়ে শিবিরের এই আয়োজন অনুষ্ঠিত হয়েছে।


বুয়েটসহ অন্যান্য ক্যাম্পাসে শিবিরের তৎপরতার বিষয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের নেতারা বলছেন, সব ক্যাম্পাসে যদি সব ছাত্র সংগঠনের সহাবস্থান নিশ্চিত করা যেতো, তাহলে তাদের (শিবির) রাজনীতি করার অবকাশ কমে আসতো।


ইফতার ও আলোচনা সভা


গণইফতারের পাশাপাশি ক্যাম্পাসগুলোতে ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক আলোচনা সভা করছে ছাত্র শিবির। এই প্রোগ্রাম সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোন একটি মসজিদে আয়োজন করছে শিবির। সেখানে কর্মীরা ইসলাম প্রচারের নামে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মসজিদে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে উগ্রপন্থায় ধাবিত করছে শিবির। গত ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু টাওয়ার মসজিদে ‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ শীর্ষক আলোচনা সভার আয়োজন করে একদল শিবির কর্মী। পরবর্তীতে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বাধায় সেই প্রোগ্রাম পণ্ড হয়ে যায়।


এবারের রোজায় রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক পর্যায়ে ‘রমাদান ফুডপ্যাক উপহার’ নামে আরেকটি কর্মসূচি রয়েছে ছাত্রশিবিরের। এর আওতায় গরিব-দুঃখী মানুষের মাঝে ইফতার সামগ্রী বিতরণসহ বিভিন্ন উপায়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে।


রমজানকে স্বাগত জানিয়ে এবং ৫৪তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে র‌্যালির আয়োজন করেছে শিবির। শিবিরের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একজন নেতা সূত্রে জানা যায়, গত ১৭ রমজানে দেশব্যাপী ঐতিহাসিক বদর দিবস উপলক্ষে র‌্যালি ও আলোচনা সভা করা হয়েছে। তবে এগুলো নতুন নয়, প্রতিবছর রমজানে এ আয়োজন করা হয়।


‘ইফতার বিতর্ক’ ইস্যুকে কাজে লাগিয়েছে শিবির


সাধারণ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের দাবি- সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইফতার নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটা বেশ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছে শিবির। আরাফাত শান্ত নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী ও সাংস্কৃতিক কর্মী বলেন, প্রতিবছর স্বাভাবিকভাবেই ক্যাম্পাসে বন্ধুরা মিলে কমবেশি সবাই ইফতার পার্টি করে। এবার ইফতার নিয়ে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ বাড়াবাড়ি। এই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে শিবির ও অন্যান্য ইসলামী সংগঠন। এতদিন তারা লুকিয়ে থাকতো। কিন্তু এই সুযোগে ওপেন প্লেসে বিভিন্ন জায়গায় তারা প্রোগ্রাম করছে।


শিবিরের কার্যক্রম সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী (ছাত্রশিবিরের সদস্য) বলেন, তাদের কার্যক্রম সবসময় চলমান ছিল, আছে ও থাকবে। রমজানে এর গতিশীলতা বেড়েছে বিষয়টা এমন না। এখন ইফতার আয়োজন ও গরিব-দুঃখী মানুষকে সহযোগিতা করার যে কর্মসূচি সেটা চলমান আছে। এ কাজ নতুন নয়, শিবিরের পক্ষ থেকে সবসময় এমনটা হয়ে আসছে।


‘ইফতার বিতর্ক’ নিয়ে শিবিরের এ সদস্য বলেন, ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে যদি রমজান উপলক্ষে শিক্ষার্থীরা ওপেন ইফতারের আয়োজন করতে পারে তাহলে আমাদের ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশে ইফতার আয়োজন ও ধর্মীয় আলাপ-আলোচনা করতে সমস্যা কোথায়? বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আমরা সবসময় সম্প্রীতি বজায় রেখেছি। অন্য ধর্মের শিক্ষার্থীরা যখন তাদের ধর্মীয় উৎসব ক্যাম্পাসে জাঁকজমকভাবে পালন করে, তখন তো তাদের কেউ বাধা দেয় না। বরং তাদের আমরা সহযোগিতা করি। তাহলে আমাদের ধর্মচর্চায় বাধা কেন?


‘প্রোডাক্টিভ রমাদান’ প্রোগ্রামের বিষয়ে শিবিরের এই সদস্য বলেন, হ্যাঁ, এটা শিবিরেরই প্রোগ্রাম। এই প্রোগ্রামে ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরা হয়। এর সঙ্গে রাজনীতি কোনও যোগসূত্র নেই। আমরা যেহেতু মুসলিম, ইসলাম সম্পর্কে আমাদের পুরোপুরি ধারণা থাকা প্রয়োজন। ইসলাম শুধু নিজে জানার জন্য না। ইসলামে কী আছে না আছে- সেটা সবার জানা উচিত।


বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সক্রিয় শিবির


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিবিরের আরেক সদস্য বলেন, প্রত্যেকটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের শক্ত অবস্থান আছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রচার-প্রচারণার ক্ষেত্রে শিবির আলাদা স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করে। যেমন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের যে কার্যক্রম চলমান আছে, এর সঙ্গে জগন্নাথ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বুয়েটে কর্মকাণ্ডের মিল নেই।


বুয়েটে শিবিরের কার্যক্রম চলমান আছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে শিবিরের এই সদস্য বলেন, নিশ্চয়ই আছে। তবে এ ক্ষেত্রে অন্যান্য জায়গায় যেরকম ব্যানার পোস্টার টানিয়ে প্রোগ্রাম করা হয়, বুয়েটে সেটা হয় না। বুয়েটের স্ট্র্যাটেজি অন্যরকম। সত্যি বলতে আমি নিজেও জানি না বুয়েটে আমার সংগঠনের স্ট্র্যাটেজি কী। কারণ এটা গোপনীয়।


তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিবিরের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সক্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা। সপ্তাহে আলোচনা সভা, মাসিক আলোচনা সভা, নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করার ক্ষেত্রে এরা যথেষ্ট অ্যাক্টিভ।


বিবার্তা/লিমন/রোমেল

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com