শিরোনাম
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ৭ জমিদার বাড়ি
প্রকাশ : ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০৯:৩৩
ইতিহাস-ঐতিহ্যের ৭ জমিদার বাড়ি
বিবার্তা ডেস্ক
প্রিন্ট অ-অ+

ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের ঘুরে বেড়ানোর কোনো কারণ লাগে না। সময় পেলেই বেড়িয়ে পড়েন, সেইসঙ্গে ইতিহাস হাতড়ে বেড়ান জানার উদ্দেশে। সারাবিশ্বে ইতিহাস সাক্ষী এমন স্থানের জায়গা কম নয়। সেই তালিকায় পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাক্ষী এসব স্থান আজো অপেক্ষায় ভ্রমণপ্রিয় মানুষের।


তাই সুযোগ পেলেই দেখে আসতে পারেন দেশের (কালের সাক্ষী) ঐতিহ্যবাহী কিছু জমিদার বাড়ি। প্রাচীন স্থাপত্যশৈলী ও শৈল্পিক কারুকাজে এসব জমিদার বাড়ি আজও কালের ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ভরপুর।


১. হরিপুর জমিদার বাড়ি: হরিপুর জমিদার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। প্রায় ১৭৫ বছর পূর্বে ১৮শ শতাব্দীতে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী (১৮৭০-১৯৩৬) জমিদার বাড়িটি নির্মাণ করেন।


তিতাস নদীর পূর্ব পারে অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। হরিপুরে অবস্থিত বলে অনেকে হরিপুর বাড়িও বলে থাকেন। নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ঘেটুপুত্র কমলাও এ জমিদার বাড়িতেই হয়েছিলো। ত্রিতল বিশিষ্ট জমিদার বাড়িটি ঐতিহাসিক যুগের শৈল্পিক নৈপুণ্যের স্বাক্ষর বহন করে। ৫ একর জমি নিয়ে বানানো প্রাসাদটিতে ৬০ টি কক্ষ আছে। নাট্যশালা, দরবার হল, গুদাম, গোশালা, রন্ধনশালা, প্রমোদের কক্ষ, খেলার মাঠ, মঠ, মন্দির, মল পুকুর ইত্যাদি বিদ্যমান।


দ্বিতলে আরোহণের জন্য ছয়টি সিঁড়ি ও ত্রিতলে আরোহণের জন্য দুইটি সিঁড়ি আছে। এর উত্তরপশ্চিম দিকে ছয়টি শয়ন কক্ষ, চারটি পূর্ব দিকে ও চারটি আছে পুকুরের পশ্চিমে। বাড়িটির পশ্চিম পাশে সান বাঁধানো ঘাট আছে, যা নদীতে গিয়ে নেমেছে। এ অঞ্চলের জনপদ যাতায়তের সুবিধা ও আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য নদীপথ ব্যবহার করতো। তাই মূল ফটক হিসেবে আকর্ষণীয় ঘাটটি নির্মিত হয়েছিলো।


বর্ষা মৌসুমে যখন পানিতে চারদিক ভরে উঠে তখন এর সৌন্দর্য দেখার জন্য দর্শনার্থীদের আগমন বেড়ে যায়। ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়িটির খুব কাছে গেলে বোঝা যায়, বাড়ির জীর্ণ ও ভগ্নদশা। মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বাস করছেন জমিদারের পুরোহিতদের বংশধররা।


২. তেওতা জমিদার বাড়ি: মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন একটি জমিদার বাড়ি ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা। এটি উপজেলার তেওতা নামক গ্রামে অবস্থিত। এখানে আছে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিচিহ্ন। এ প্রাসাদেই নজরুল, প্রমীলা দেবীর প্রেমে পড়েন। বাড়িটির পাশেই ছিলো প্রমীলার বাড়ি।


ইতিহাসবিদদের মতে, ১৭শ শতকে জমিদার পঞ্চানন সেন বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। পঞ্চানন সেন এক সময় খুবই দরিদ্র ছিলেন। তিনি দিনাজপুর অঞ্চলে তামাক উৎপাদন করে প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হওয়ার পর প্রাসাদটি নির্মাণ করেন। পরে এখানে জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে জয়শংকর ও হেমশংকর নামে দুজন ব্যক্তি। ভারত বিভক্তির পর দুজনেই ভারত চলে গেলে বাড়িটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।


তেওতা জমিদার বাড়িটি মোট ৭.৩৮ একর জমি নিয়ে স্থাপিত। মূল প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা ও একটি বড় পুকুর। প্রাসাদের মূল ভবনটির নাম লালদিঘী। আছে নটমন্দির এ ছাড়াও এখানে আছে নবরত্ন মঠ ও আরো বেশ কয়েকটি মঠ। সবগুলো ভবন মিলিয়ে এখানে মোট কক্ষ আছে ৫৫টি। অযত্ন আর অবহেলায় পরিত্যক্ত অবস্থায় টিকে আছে বাড়িটি। বাড়ির প্রায় সম্পূর্ণ অংশই দখলদারীদের হাতে চলে গেছে।


৩. নাগরপুর জমিদার বাড়ি: টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় অবস্থিত একটি জমিদার বাড়ি। জমিদার সুবিদ্ধা খাঁ-র হাত ধরে নাগরপুরে চৌধুরী বংশ জমিদারি শুরু করেন। এই বংশের প্রথম পুরুষ যদুনাথ চৌধুরী প্রায় ৫৪ একর জমিতে তার জমিদারি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে নাগরপুরের জমিদার বাড়ির সুখ্যাতি ছড়ায় তৃতীয় পুরুষ উপেন্দ্র মোহনের ছেলে সতীশ চন্দ্র রায় চৌধুরীর শাসনে।


কথিত আছে, কলকাতার আদলে নাগরপুরকে সাজানোর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এখান থেকেই তিনি জমিদারি পরিচালনা করতেন। রঙ্গমহলের পাশে ছিল সুদৃশ্য চিড়িয়াখানা। সেখানে শোভা পেত- ময়ূর, কাকাতোয়া, হরিণ, ময়না ইত্যাদি। জমিদার বাড়ির অন্যান্য স্থাপনার মধ্যে ছিলো ঝুলন দালান। প্রাচীন ভারতে বিভিন্ন শিল্প কর্মে মন্ডিত চৌধুরী বংশের নিত্যদিনের পূজা অনুষ্ঠান হত এই ঝুলন দালানে।


বিশেষ করে বছরে শ্রাবনের জ্যোৎস্না তিথিতে সেখানে ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের নাটক, যাত্রা হত। বর্তমানে চৌধুরী বাড়ির এই মূল ভবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রী কলেজ।


৪. করটিয়া জমিদার বাড়ি: করটিয়া জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার অন্তর্ভুক্ত করটিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি।


আটিয়ার চাঁদ” নামক গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, আফগান অধিপতি সোলায়মান খান পন্নী কররানির ছেলে বায়েজিদ খান পন্নী ভারতে আগমন করেন। তার পুত্র সাঈদ খান পন্নী আটিয়ায় বসতি স্থাপন ও ১৬০৮ খ্রিঃ সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে আটিয়ার বিখ্যাত মসজিদ নির্মাণ করেন। এই বংশেরই ১১তম পুরুষ সা'দত আলী খান পন্নী টাঙ্গাইলের করটিয়ায় এসে পন্নী বংশের ভিত প্রতিষ্ঠা করেন।


প্রাকৃতিক এবং নিরিবিলি পরিবেশ বিরাজমান এই জমিদার বাড়ির চারপাশে। প্রাচীরঘেরা বাড়িটিতে আছে লোহার ঘর, রোকেয়া মহল, রানির পুকুরঘাট, ছোট তরফ দাউদ মহল ও মোঘল স্থাপত্যের আদলে গড়া মসজিদ ও ঐতিহাসিক স্থাপত্য।


মোঘল ও চৈনিক স্থাপত্যের মিশেলে নির্মিত জমিদার বাড়িটি প্রথম দর্শনেই আপনার মন হারিয়ে যাবে বাড়ির সৌন্দর্যের। সীমানা প্রাচীরের ভেতরে অবস্থিত মোঘল স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন রোকেয়া মহল; যা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মর্যাদা পাওয়ার দাবি রাখে। অথচ এটি বিদ্যালয় ও কোচিং সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।


৫. বালিয়াটি জমিদার বাড়ি: বালিয়াটি প্রাসাদ বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের ১৯ শতকে নির্মিত অন্যতম প্রাসাদ। একে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বা বালিয়াটি প্রাসাদ বলেও ডাকা হয়।


মোট সাতটি স্থাপনা নিয়ে এই জমিদার বাড়ি অবস্থিত। যদিও সেখানকার সবগুলো ভবন একসঙ্গে স্থাপিত হয়নি। এই প্রাসাদের অন্তর্গত বিভিন্ন ভবন জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকার বিভিন্ন সময়ে স্থাপিত করেছিলো। বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্লকটি যাদুঘর।


গোবিন্দ রাম সাহা বালিয়াটি জমিদার পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লবণের বণিক ছিলেন। জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারের মধ্যে “কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, রায়বাহাদুর হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী তৎকালীন শিক্ষাখাতে উন্নয়নের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।


ঢাকার জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিশোরিলাল রায় চৌধুরীর পিতা এবং যার নামানুসারে উক্ত প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয়। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি নামে পরিচিত, এই প্রাসাদ চত্বরটি প্রায় ১৬ হাজার ৫৫৪ বর্গমিটার জমির উপর ছড়িয়ে থাকা ৭টি দক্ষিণমুখী দালানের সমাবেশ। এই প্রসাদের পেছনের প্রাসাদকে বলা হয় অন্দর মহল যেখানে বসবাস করতো তারা।


উত্তরদিকে কিছু দূরে অবস্থিত পরিত্যক্ত ভবনটি কাঠের কারুকার্য সম্পন্ন। এই ভবনে প্রাসাদের চাকর বাকর, গাড়ি রাখার গ্যারেজ, ঘোড়াশাল ছিল বলে ধারণা করা হয়। বিশাল প্রাসাদটির চারপাশ সুউচ্চ দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। প্রাসাদের তিনটি প্রবেশপথ আছে। যার প্রত্যেকটিতে অর্ধবৃত্তাকার খিলান আকৃতির সিংহ খোদাই করা তৌরণ বিদ্যমান। এই প্রাসাদটি বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক সংরক্ষিত ও পরিচালিত।


৬. বেতিলা জমিদার বাড়ি: বেতিলা জমিদারবাড়ি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার বেতিলায় অবস্থিত। এ বাড়ির সঠিক ইতিহাস তথ্যগত অভাবের কারণে তেমন জানা যায়নি। বেতিলার মাঝখানে বয়ে গেছে বেতিলা খাল।


ব্যবসা ও যাতায়াতের জন্য বেতিলা খাল বেঁছে নেন বড় বড় বণিকরা। লোককথায় জানা যায়, জ্যোতি বাবু নামের এক বণিক ছিলেন এই জমিদার বাড়ির পূর্বপুরুষ। জমিদার বাড়িটি সবুজে ঘেড়া। প্রাসাদটির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে তুলে জনসাধারণদের।


৭. মহেরা জমিদার বাড়ি: মহেরা জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুরে অবস্থিত কয়েকটি ঐতিহাসিক স্থাপনার মধ্যে একটি। ১৮৯০ দশকের পূর্বে স্পেনের করডোভা নগরীর আদলে জমিদার বাড়িটি তৈরি হয়েছিলো।


স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকবাহিনী মহেড়া জমিদার বাড়িতে হামলা করে এবং জমিদার বাড়ির কূলবধূ সহ পাঁচজন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে (১৯৭১)। পরবর্তীতে তারা লৌহজং নদীর নৌপথে এ দেশ ত্যাগ করেন। এখানেই তখন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। এ জমিদার বাড়ি পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় (১৯৭২)। পুলিশ ট্রেনিং স্কুলকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত করা হয় (১৯৯০)।


প্রবেশ পথের আগেই আছে ‘বিশাখা সাগর’ নামে বিশাল এক দীঘি ও বাড়িতে প্রবেশের জন্য আছে ২টি গেট। এ ছাড়াও মূল ভবনের পেছনের দিকে পসরা পুকুর ও রানি পুকুর নামে আরো দুটি পুকুর ও ফুলের বাগান আছে। বিশাখা সাগর সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে আছে বিশাল আম্র কানন ও বিশাল তিনটি প্রধান ভবনের সঙ্গে আছে নায়েব সাহেবের ঘর, কাছারি ঘর, গোমস্তাদের ঘর, দীঘিসহ আরো তিনটি লজ।


বিবার্তা/এমবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com