শিরোনাম
রবির কিরণে শরৎ
প্রকাশ : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৫৮
রবির কিরণে শরৎ
অনামিকা রায়
প্রিন্ট অ-অ+

ঋতু বৈচিত্রের শ্যামল বাংলার প্রতিটি প্রান্তরে একরাশ অনাবিল মুগ্ধতা নিয়ে বারবার ফিরে আসে শরৎ। শরতের নরম আলো, কোমল সকাল, বহুরূপী আকাশ, ধবল শাদা কাশ, তরতাজা শিউলি ফুল, বহু রঙে সাঁজা নানান পাখপাখালী- সবই যেন শিল্পীর তুলির ছোঁয়ায় অঙ্কিত নয়নাভিরাম এক চিত্রকর্ম! প্রকৃতির অজস্র বৈচিত্রতার মধ্যেও নিজ রূপে, সৌন্দর্যে শারদ-প্রকৃতি যেন বঙ্গমাতার আদরের ষোড়শী কন্যা; অনন্য সুন্দর যার সর্বাঙ্গ।


এই শরৎ নিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-


"এসেছে শরৎ হিমের পরশ
লেগেছে হাওয়ার পরে
সকাল বেলায় ঘাসের আগায়
শিশিরের রেখা ধরে।
আমলকীবন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু
পেয়েছে খবর পাতা খসানোর
সময় হয়েছে শুরু।
শিউলির ডালে কুঁড়ি ভরে এলো
টগর ফুটিল মেলা
মালতীলতায় খোঁজ নিয়ে যায়
মৌমাছি দুই বেলা।"


শরতের বিচিত্র রূপে কখনো বৃষ্টি, কখনো রোদ্রের খেলা চলে। এ সময়ও বৃষ্টি হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষ হতেই ঝলমলিয়ে ওঠে রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির এ অপরূপ রূপের বর্ণনা দিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-


"আবার শরৎকাল আসিয়াছে। এই শরৎকালের মধ্যে আমি একটি নিবিড় গভীরতা, একটি নির্মল নিরতিশয় আনন্দ অনুভব করি। এই প্রথম বর্ষা অপগমে প্রভাতের প্রকৃতি কী অনুপম প্রসন্ন মূর্তি ধারণ করে। রৌদ্র দেখিলে মনে হয় যেন প্রকৃতি কী এক নূতন উত্তাপের দ্বারা সোনাকে গলাইয়া বাষ্প করিয়া এত সূক্ষ্ম করিয়া দিয়াছেন যে, সোনা আর নাই কেবল তাহার লাবণ্যের দ্বারা চারিদিক আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে।"


বর্ষার কালো মেঘের ঘনঘোর কেটে গিয়ে যখন স্বচ্ছ কাঁচের মতো শাদা মেঘরাশি দল বেঁধে উড়ে বেড়ায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, তখন কবির মনও যেন একঘেয়েমি বৃষ্টির বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে আয়নার মতো স্বচ্ছ আকাশ দেখে চঞ্চল হয়ে ওঠে। শরতের এই রূপ যেন অস্থির করে তোলে রবীন্দ্রনাথকে। তিনি লেখেন-


"অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/
দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া/
কোন্ সাগরের পার হতে আনে কোন্ সুদূরের ধন/
ভেসে যেতে চায় মন/
ফেলে যেতে চায় এই কিনারায় সব চাওয়া সব পাওয়া।/
পিছন ঝরিছে ঝরো ঝরো জল, গুরু গুরু দেয়া ডাকে/
মুখে এস পড়ে অরুণকিরণ ছিন্ন মেঘের ফাঁকে।/
ওগো কা-ারী, কে গো তুমি, কার হাসিকান্নার ধন/ ভেবে মরে মোর মন/
কোন্ সুরে আজ বাঁধিবে যন্ত্র, কী মন্ত্র হবে পাওয়া।"


শরতে হাজারো সুখ স্মৃতির মাঝেও তো মনে ভর করে অতীতের কোনো বিরহ কাহিনী! স্বচ্ছ নীল আকাশ দেখে প্রিয় মুখখানি ভেসে ওঠে সুপ্ত মাছের মতো। সেও তো এক রূপ। তাও এড়িয়ে যায়নি তাঁর বিচক্ষণ চোখ। তিনি এই বিরহকথা তুলে আনলেন নিবিড় পরিচর্যায়-


"আজি শরৎতপনে প্রভাতস্বপনে/ কী জানি পরাণ কী যে চায়!/ ওই শেফালির শাখে কী বলিয়া ডাকে/ বিহগবিহগী কী যে গায়!/ আজি মধুর বাতাসে হৃদয় উদাসে,/ রহে না আবাসে মন হায়!/কোন্ কুসুমের আশে কোন্ ফুলবাসে/ সুনীল আকাশে মন ধায়!/ আজি কে যেন গো নাই, এ প্রভাতে তাই/ জীবন বিফল হয় গো!/ তাই চারি দিকে চায়, মন কেঁদে গায়/ ‘এ নহে, এ নহে, নয় গো’। কোন্ স্বপনের দেশে আছে এললাকেশে/ কোন্ ছায়াময়ী অমরায়!/ আজি কোন্ উপবনে বিরহবেদনে/ আমারি কারণে কেঁদে যায়!/ আমি যদি গাঁথি গান অথির-পরাণ/ সে গান শুনাব কারে আর!/ আমি যদি গাঁথি মালা লয়ে ফুলডালা/ কারে পরাব ফুলহার!/ আমি আমার এ প্রাণ যদি করি দান/ দিব প্রাণ তবে কার পায়!/ সদা ভয় য় মনে পাছে অযতনে/ মনে মনে কেহ ব্যথা পায়!"


শরতের আলো যেন এক অন্য ভাষা নিয়ে হাজির হয় এই বাংলায়। এটা যেন এই ঋতুর প্রাণের রং।কোমলতার রং। সেই রং যেন দেখা যায় বাংলার বিস্তৃর্ণ সবুজ প্রান্তরে, ঘাসে, পাতায়। রবীন্দ্রনাথের কথায়,


"শরতের রঙটি প্রাণের রঙ। অর্থাৎ তাহা কাঁচা, বড় নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজি কচি। নীলটি তাজা।"


আবার কখনো তিনি শরতের আলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন-


"শরৎ তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি
ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি।
শরৎ তোমার শিশির-ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি"


যেন অনাবিল আনন্দের ঝর্ণা হয়ে সুনীল আকাশে শিমুল তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ নিয়ে আসে শরৎ। আর এই সাদা মেঘমালা যেন কোমল আনন্দের বার্তা পৌঁছে দেয় মানুষের মনে। রপময়, নির্মল শরৎ প্রকৃতির সাথে সাথে মানুষের মনকেও করে তোলে কাব্যিক। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন-


"তোমার মোহন রূপে কে রয় ভুলে
জানিনা কি মরণ নাচে,
নাচে গো ওই চরণমূলে
শরৎ আলোর আঁচল টুটে
কিসের ঝলক নেচে ওঠে ”


শরতে আসে নবান্ন। কৃষকের মনে জাগে নতুন ধানের আশা। এ সময় কিশলয়ের মতো সজিব হয়ে ওঠে প্রকৃতি। সবুজে সবুজে ভরে ওঠে মাঠ-প্রান্তর, গ্রাম-গঞ্জ। এ এক অপরূপ দৃশ্য। যা মানুষের মনকে উতলা করে তোলে ভিতরে বাহিরে। রবি ঠাকুর মানুষের হাসি কান্না আনন্দ উল্লাস দেখেছেন। তিনি দেখেছেন হাওয়ায় মাঠের সবুজ ধান দুলে উঠলে কত আনন্দে নেচে ওঠে কৃষক। সে আনন্দ তাঁকেও যেন নাচিয়ে গেছে। তিনি অনন্য আনন্দে লিখেছেন -


"আজি ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা/
নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই- লুকোচুরি খেলা/
আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে/
আজ কিসের তবে নদীর চওে চখা-চখীর মেলা।/
ওরে, যাব না আজ ঘরে রে ভাই, যাব না আজ ঘরে।/
ওরে, আকাশ ভেঙে বাহিরকে আজ নেব রে লুট করে/
যেন জোয়ার জলে ফেনার বাঁশি বাতসে আজ ছুটছে হাসি,/
আজ বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা/"


শরৎকালে মন নেচে ওঠে উৎসবের আমেজে। মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলকে নবান্নের প্রতীক্ষার সাথে শিশিরে কুসুমে বাংলার প্রকৃতিও হেসে ওঠে তখন। বাঙালি হিন্দুর প্রাণের উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা তো আছেই। সাথে শিউলি ফুল। কাশফুলের দোলের সাথে তাল মিলিয়ে ঢাকের বোল।


রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন-


"আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ,
আমরা গেঁথেছি শেফালি মালা-
নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে
এনেছি ডালা
এসো গো শারদলক্ষ্ণী,
তোমার শুভ্র মেঘের রথে"


শরতে প্রকৃতিও নানান বাহারী ফুলের সজ্জায় সাজিয়ে তুলে তার অঙ্গ। শিউলি, বেলী, কাশফুল, মলি­কায় বিমোহিত হয় তৃষ্ণার্ত নয়ন। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। তাই তো কবি মন বলে ওঠে-


"ওগো শেফালি-বনের মনের কামনা,
কেন সুদূর গগনে গগনে
আছ মিলায়ে পবনে পবনে।
কেন কিরণে কিরণে ঝলিয়া
যাও শিশিরে শিশিরে গলিয়া।"


আবার কখনো তিনি লিখেছেন-


"আমার নয়ন ভুলানো এলে,
আমি কী হেরিলাম হৃদয় মেলে,
শিউলি তলায় পাশে পাশে ঝরা ফুলের রাশে রাশে
শিশির ভেজা। ঘাসে ঘাসে অরুণ রাঙা চরণ ফেলে—
নয়ন-ভুলানো এলে।"


ঝকঝকে কাঁচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর তার মধ্যে তুলোর মতো সাদা মেঘমালা- এসব নিয়েই প্রকৃতি বরণ করে নেয় শরৎকালকে। শুভ্রতার ঋতু শরতের বর্ণনা দিতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-


"আজিকে তোমার মধুর মুরতী
হেরিণু শারদ প্রভাতে
হে মাতা বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ
ঝরিছে অনল শোভাতে।"


বর্ষার অবিরাম বাদলধারা যখন বিরহকাতর প্রেমিক হৃদয়ের কান্না হয়ে ঝরে, তখনই সজীব প্রকৃতি এই বিরহব্যথায় প্রশান্তির প্রলেপ দিতে নিয়ে আসে শরৎ-শুভ্রতার কোমল ছোঁয়া। আর এই স্পর্শে শুদ্ধ হয় প্রতিটি হৃদয় মন।


শরতে মুগ্ধ রবি লিখলেন-


"শরতে আজ কোন্‌ অতিথি
এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়,
আনন্দগান গা রে।
নীল আকাশের নীরব কথা
শিশির-ভেজা ব্যাকুলতা
বেজে উঠুক আজি তোমার
বীণার তারে তারে।"


শরৎ ও প্রকৃতি যেন অভিন্ন সত্ত্বা। শরৎকালকে বাদ দিয়ে বাংলার প্রকৃতি অসম্পূর্ণ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর চিন্তাচেতনায় ও লেখনী হতে শরৎকে বাদ দিতে পারেন নি। বরং শুভ্র ঋতুটি নিয়ে তাঁর ছিলো সীমাহীন আগ্রহ। তাঁর অসংখ্য কবিতায়, গানে ও গল্পে শারদ বন্দনা রয়েছে। শরৎ নিয়ে লেখা রবির সমগ্র বিষয়বস্তু যেমন বাংলার অমূল্য সম্পদ, তেমনি বাঙালির প্রাণের খোরাক।


বিবার্তা/বিআর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com