নারী সাংবাদিকের আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড়, নেপথ্য কী?
প্রকাশ : ২০ অক্টোবর ২০২৫, ০০:০৩
নারী সাংবাদিকের আত্মহত্যা নিয়ে তোলপাড়, নেপথ্য কী?
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

সম্প্রতি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা করা অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’ এর এক কর্মীর মৃত্যু ঘিরে সোশাল মিডিয়ায় শোরগোল পড়েছে।স্বর্ণময়ী বিশ্বাস নামের ২৮ বছর বয়সী ওই তরুণী আত্মহত্যা করেছেন বলেই স্বজন ও পুলিশের ধারণা।


তবে কেউ কেউ তার মৃত্যুর পেছনে অনেকাংশে দায় দেখছেন সংবাদমাধ্যমটির শীর্ষ এক কর্তার; যার বিরুদ্ধে ‘যৌন নিপীড়ন’, ‘বাজে আচরণের’ মতো গুরুতর অভিযোগ এনেছিলেন স্বর্ণময়ীসহ ২৬ কর্মী।


তিন মাসে আগে লিখিত অভিযোগ করা সেই কর্মীদের মধ্যে তিনজনের চাকরির মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কয়েক দিন আগেই জানানো হয়েছে।


এ নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় নানা আলোচনার মধ্যে ঢাকা স্ট্রিম রোববার এক বিবৃতিতে বলেছে, স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওঠা ‘অভিযোগের কোনো সম্পর্ক নেই’। তিন মাস আগের অভিযোগকে কেন্দ্র করে বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অপপ্রচার’ চালানো হচ্ছে।


স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃতদেহ শনিবার রাতে ধানমন্ডির পপুলার হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করা হয় বলে জানিয়েছেন তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার ইবনে মিজান।


তিনি জানান, ওই তরুণী সোবহানবাগ এলাকার নাভানা টাওয়ারের ১৫ তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাই-ভাবির সঙ্গে থাকতেন। শনিবার বিকালে স্বর্ণময়ীর চাচি ওই বাসায় বেড়াতে আসেন।


স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে পোশাক পরিবর্তনের কথা বলে নিজের কক্ষের দরজা আটকান স্বর্ণময়ী। দীর্ঘ সময় কোনো সাড়া শব্দ না পাওয়ায় পরিবারের সদস্যরা দরজা ভেঙে তাকে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখেন। দ্রুত পপুলার হাসপাতালে নিলে স্বর্ণময়ীকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক।


পুলিশ কর্মকর্তা ইবনে মিজান বলেন, “আমরা রাতে মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠিয়েছি।”


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তার মাইগ্রেনের সমস্যা ছিল। তার বাঁ হাতে কব্জির কাছে ব্লেডের মত ধারালো কিছু দিয়ে কাটার দাগ- রক্তাক্ত দেখা গেছে। তবে মৃত্যুর আগে কোনো নোট ছিল না।”


স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যুর খবর রাত সোয়া ৩টায় প্রকাশ করে তার কর্মস্থল ‘ঢাকা স্ট্রিম’। এ খবরে ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। তার মৃত্যুতে ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক গোলাম ইফতেখার মাহমুদ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বলে জানানো হয়।


‘ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক্স ডিজাইনার স্বর্ণময়ী বিশ্বাস মারা গেছেন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, স্বর্ণময়ী বিশ্বাস চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা স্ট্রিমে শিক্ষানবিস গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।


স্বর্ণময়ীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকার কথা জানিয়েছেন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক মৌসুমী আচার্য্য।


তিনি বলেন, “স্বর্ণ আমার হাজবেন্ডের মাসতুতো বোন; হয় না যে- পরিবারে দুই-একটা বাচ্চা থাকে, যে খুব আদরের। ও ওর ভাইদের সবার কাছে খুব পাখির মত আদরের, ও পরিবারে খুব আদরের। সবার কাছে এবং আমার খুব ভালো বন্ধু; ও গতকাল মারা গেল! তার চারদিন আগেও আমার সাথে দেড় ঘণ্টা কথা হয়েছে ভিডিও কলে।”


বাংলা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট সম্পাদক আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে সংবাদমাধ্যমটিতে ‘বিষাক্ত সংস্কৃতি’ তৈরি করার অভিযোগ স্বর্ণময়ী ‘করে গেছেন’ মৌসুমীর কাছে।


তিনি বলেন, “ওর আট মাস চাকরির বয়স। প্রথম কয়েক দিন তো যে কারও নতুন অফিসে একটু অনভ্যস্ত লাগে, বাট তারপরে ধরেন মোটামুটি সাড়ে সাত মাসের বেশিরভাগ দুঃখ, হতাশা, এবং বিরক্তির কারণই ওই ভদ্রলোক (আলতাফ শাহনেওয়াজ) । এটা তার (স্বর্ণময়ী) শুরু থেকেই অভিযোগ ছিল।


“‘উনি সবসময় এইভাবে কেন আক্রমণ করে? এই ভাষা কেন হবে’… ও প্রথম থেকে বলে আসছিল।”


মৌসুমী বলেন, স্বর্ণময়ীর কাছ থেকে শোনা সাম্প্রতিক অভিযোগ অনুযায়ী, আলতাফ শাহনেওয়াজ ‘কথার মাধ্যমে যৌন হয়রানি’ করতেন।


“তার (আলতাফের) বক্তব্য ছিল যে, তার (স্বর্ণর) বাংলাটা গোছানো না, ভচকানো; ‘যার ব্রেস্টের শেপ এরকম ভচকানো, তার বাংলাটা ভচকানো হবে’। দ্যাট ওয়াজ হিজ টাইপ টু প্যাটার্ন অব ক্রিটিসাইজ, অ্যান্ড এটা রেগুলার বেসিস এবং এটা তার অফিস জানত।”


তবে স্বর্ণময়ী কোনো শারীরিক নিপীড়নের শিকার হওয়ার কথা বলেননি জানিয়ে মৌসুমী বলেন, “আমি এটা স্পষ্ট করলাম যে, ও ওর গায়ে হাত দিয়ে কখনো অ্যাটাক করেননি। বাট, তার ভাষা এবং তার শাব্দিক অবস্থানগুলো এমন, যেটা একটা মেয়ের আত্মসম্মানকে এবং তার শারীরিক অস্তিত্বকে আঘাত করার পক্ষে যথেষ্ট। এবং এটা খুবই নিয়ম করে হয়ে যাচ্ছিল।”


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিসের পরিবেশের পাশাপাশি পারিবারিক কিছু সমস্যা ছিল স্বর্ণময়ীর।


“হয়তো শুধু অফিসের কারণেই ও আত্মহত্যা করেনি, কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিতে সেটি প্রভাব ফেলেছে।”


মৌসুমীর ভাষ্য, একটা পর্যায়ে স্বর্ণময়ী তার ভাই সৌরভ বিশ্বাস ও খালাত ভাই সঞ্জয় অধিকারী (মৌসুমীর স্বামী) সহায়তা চান।


যোগাযোগ করা হলে একটি টিভি স্টেশনের সাংবাদিক সঞ্জয় অধিকারী বলেন, কেবল স্বর্ণময়ী নয়, বাংলা স্ট্রিমের অনেকেই আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছিলেন। স্বর্ণময়ী সহায়তা চাইলে সঞ্জয় ঢাকা স্ট্রিমের সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমটির অন্য কর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর সমস্যাটি সমাধান হয়েছে বলে ধরে নিয়েছিলেন।


আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ‘যৌন হয়রানি, বাজে আচরণ, বুলিং’সহ আটটি অভিযোগ এনে গত ১৩ জুলাই ঢাকা স্ট্রিমের মানবসম্পদ বিভাগে অভিযোগ দিয়েছিলেন সব নারী (৭ জন) কর্মীসহ ২৬ জন।


ওই নারীদের একজন বলেন, পেশাগত কোনো কারণ ছাড়াই আলতাফ শাহনেওয়াজ ‘গভীররাতে’ নারী সহকর্মীদের ফোন দেন। সিঁড়িতে আলাদা ডেকে কথা বলতেন। ছেলেবন্ধু আছে কি না, সম্পর্ক কতখানি গভীর, শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে কি না—এমনসব ব্যক্তিগত বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন। নতুন প্রতিষ্ঠান হওয়ায় নিয়োগপত্র ছাড়াই অনেকে কাজ শুরু করেন। এমন নারী কর্মীদের গভীররাতে ফোন করে শাহনেওয়াজ বলতেন, ‘ঠিকঠাক কাজ না করলে নিয়োগপত্র দেওয়া হবে না’। তাছাড়া অফিসে যৌক্তিক কারণ ছাড়াই নারীদের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতেন। কখনো কখনো মেজাজ হারিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করতেন।


অভিযোগকারী সেই নারী বলেন, কর্মীদের লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর প্রতিষ্ঠানের তরফে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। সেই সঙ্গে বিষয়টি বাইরে ‘শেয়ার’ না করতে বলা হয়। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও তিন মাসেও তদন্ত শেষ হয়নি।


ওই নারী কর্মী বলেন, অভিযোগ দেওয়ার পর সম্পাদক সাত নারী সহকর্মীর সঙ্গে একসঙ্গে কথা বলেন। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষে প্রবেশে বারণ করা হয়। সেই সঙ্গে নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করা হয়। তবে কয়েক দিন পর থেকে এসব বিধিনিষেধ ভাঙতে শুরু করেন শাহনেওয়াজ।


“উনি সেকেন্ডম্যান হওয়ায় আর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি অফিস।”


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, স্বর্ণময়ী চাপা স্বভাবের ছিলেন, ব্যক্তিগত বিষয়ে খুব বেশি বলতেন না। তবে ব্যক্তিগত সংকটও ছিল তার।


জানতে চাইলে ঢাকা স্ট্রিমের মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের ব্যবস্থাপক পি এম সজল আহমেদ বলেন, গত ১৩ জুলাই মানবসম্পদ বিভাগে ‘লজিং কমপ্লেইন্ট এগেইন্সট ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট বিহেভিয়ার ইন দ্য ওয়ার্কপ্লেস’ শিরোনামে একটি অভিযোগপত্র জমা পড়ে। অভিযোগ পাওয়ার পর আলতাফ শাহনেওয়াজকে তাৎক্ষণিকভাবে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয় এবং অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি করা হয়।


ওই কমিটির মাধ্যমে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত করে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা হয় বলে দাবি করেন তিনি।


সজল আহমেদ বলেন, “আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে বাজে আচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তিনি যৌন হয়রানি করেছেন, এমন কোনো তথ্য-উপাত্ত হাজির করতে পারেননি অভিযোগকারীরা।”


বিবার্তা/এসএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com