
ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দীপু চন্দ্র দাসকে (২৭) পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। ঘটনার পর স্থানীয় বাসিন্দা ও দীপুর কারখানার সহকর্মীরা কেউ কোনো কথা বলছেন না। কারখানা কর্তৃপক্ষের দাবি, পুলিশ ডাকার পরও ‘মব’ ঠেকানো যায়নি। পুলিশ বলছে, সময়মতো খবর পেলে প্রাণ রক্ষা করা যেত।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে ভালুকার হবিরবাড়ী ইউনিয়নের ডুবালিয়াপাড়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার কর্মী দীপু চন্দ্র দাসকে কারখানা থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকের একটি গাছে বিবস্ত্র করে ঝুলিয়ে মরদেহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
নিহত দীপু চন্দ্র তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে। এ ঘটনায় তাঁর ভাই অপু চন্দ্র দাস বাদী হয়ে গত শুক্রবার অজ্ঞাতপরিচয় ১৪০ থেকে ১৫০ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন।
২১ ডিসেম্বর, রোববার বেলা পৌনে দুইটার কারখানার সামনে গিয়ে অন্তত ১০ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে সেদিনের ঘটনার জানার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু কেউ কোনো কথা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। কেউ বলেন, সেদিন আগেভাগে বাসায় চলে যান। কেউ বলেন, সেদিন কারখানায় আসেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক শ্রমিক জানিয়েছেন, এ নিয়ে কথা বলতে নিষেধ করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ।
কারখানার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে কারখানার বাইরে থেকে একদল লোক ফটক ভাঙার চেষ্টা করছেন। একপর্যায়ে পকেট গেট ভেঙে ভেতর থেকে দীপু চন্দ্র দাসকে তাঁরা নিয়ে যান। কারখানার ভেতরের ঘটনায় ফটকের বাইরে এত লোক কীভাবে জড়ো হলেন, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কারখানার সামনে ১২ বছর ধরে মুদিদোকান চালান আবু তাহের (৫০)। তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় মসজিদ থেকে বের হয়ে কারখানার সামনে লোকজনের হইচই দেখি। কাদের কথায় বাইরের লোক জড়ো হইল, বুঝতে পারছি না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা মানুষরে ধইরা মাইরা ফেলল, এই কামডা ঠিক হয় নাই।’
কারখানার সামনের নূরে মদিনা হোটেলের ব্যবসায়ী জাহিদ হোসেন (৫০) ও মুদিদোকানদার লিটন মিয়া (৫৫) বলেন, কীভাবে লোক জড়ো হয়েছে কিংবা ঘটনা কী হয়েছে, তাঁরা কিছুই দেখেননি।
দীপুকে হত্যার পর কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ধর্ম অবমাননার বিষয়টি খুবই অস্পষ্ট। দীপু কী বলেছিলেন, সেটা খোঁজার চেষ্টা করলেও কেউ বলতে পারেননি। কারও সঙ্গে পূর্বশত্রুতা ছিল কি না, তারা (র্যাব) তদন্ত করে দেখবে। ঘটনার সূত্রপাত কার সঙ্গে হয়েছে, সেটি শনাক্ত করা যায়নি। তবে কারখানার শ্রমিকেরা বলছেন ভিন্নকথা।
কারখানাটিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে জুনিয়র কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর পদে যোগ দিয়েছিলেন দীপু চন্দ্র দাস। তিনি যে ফ্লোরে কাজ করতেন, সেখানে ৪০০ শ্রমিক ছিলেন। বৃহস্পতিবার কারখানায় কাজ করার সময় তিনজন শ্রমিকের কথোপকথনের সময় ঘটনার সূত্রপাত হয় বলে দাবি তাঁদের। কারখানা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা হয়।
ওই শ্রমিকেরা দাবি করেন, সেদিন তাঁদের তিনজনের কথোপকথনের সময় পাশ থেকে দীপু মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করেন। তখন কারখানার এক কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর উল্টাপাল্টা কথা বলতে নিষেধ করে অন্যদিকে চলে যেতে বলেন। পরে বিষয়টি পুরো ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়লে উত্তেজনা শুরু হয়। তবে ঘটনা কীভাবে বাইরে গেল, তাঁরা জানেন না বলে দাবি করেন।
কারখানার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ) উদয় হোসেন বলেন, ‘সেদিন মাগরিবের নামাজের আগমুহূর্তে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিমূলক কথা বলা নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার জেরে পুরো ফ্লোরে উত্তেজনা ছড়িয়ে যায়। এ সময় সবাইকে বুঝিয়ে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করা হয়। সবাইকে স্বাভাবিক করতে মিথ্যা একটি রিজাইন পেপারে সিগনেচার নেওয়া হয়। বিষয়টি বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় শিল্প পুলিশ ও থানা-পুলিশকে বিষয়টি জানাই।’
উদয় হোসেন দাবি করেন, ‘দীপুকে বাইরে বের করে দেওয়া হয়েছে, বিষয়টা এমন নয়। বিষয়টা হচ্ছে, পুরো ফ্লোরে হট্টগোল শুরু হয়ে গেলে তাকে নিরাপদে গেটে নিয়ে যাই বের করে দেওয়ার জন্য, যাতে সে নিরাপদে বাইরে বের হয়ে যেতে পারে। যখন বাইরের লোকজন চলে যাবে, পরিস্থিতি নরমাল হবে, সে বাসায় চলে যাবে। পরিস্থিতি এমন হইছিল যে তাকে বের করার মতো পরিস্থিতি ছিল না, আমরা তাকে বেরও করি নাই। কিন্তু একপর্যায়ে বাইরের উত্তপ্ত জনতা পকেট গেট ভেঙে তাকে বের করে নিয়ে যায়। আমাদের কোনো কিছু করার ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘বাইরের লোক কীভাবে জানল, জানি না। সবার হাতে মোবাইল, প্রযুক্তি থাকার কারণে সেকেন্ডর মধ্যেই একটা জিনিস ছড়িয়ে যায়। কোনোভাবে হয়তো বাইরে ছড়িয়ে গেছে।’
দীপুকে হত্যার পর কারখানার সামনে থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে স্কয়ার মাস্টারবাড়ী বাসস্ট্যান্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিভাজকে একটি গাছে মরদেহ ঝুলিয়ে আগুন দেওয়া হয়। আজ বেলা দেড়টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, গাছে এখনো রশিটি ঝুলছে।
সেখানে ফুটপাতে ভ্যানে বসে সাত বছর ধরে জুতার দোকান চালান গফরগাঁওয়ের মো. নয়ন মিয়া (৪০)। তিনি বলেন, ‘সেদিন হঠাৎ করে দেখি, লোকজন স্লোগান দিয়ে আসতে থাকে। ভয়ে দোকান বন্ধ করে দূরে সরে যাই। পরে শুনতে পারি, মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নাকি কটূক্তি করছে, সে কারণে লোকটারে মারছে। এই কামডা খুব খারাপ হইছে।’
শিল্প পুলিশ-৫ ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার মো. ফরহাদ হোসাইন খান বলেন, ‘আমরা ৭টা ৫০ মিনিটের দিকে খবর পাই। ততক্ষণে রাস্তায় ৮ থেকে ১০ হাজার লোক জড়ো হয়ে যায়। যানজট ঠেলে পৌঁছানোর আগেই শ্রমিককে নিয়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকে বারবার বলা হচ্ছিল, শ্রমিককে যেন বাইরে না দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের ফোর্স সাড়ে আটটার দিকে ওখানে যাওয়ার আগেই শ্রমিককে জনগণের হাতে দিয়ে দেয়। তখনই ঘটনাটি ঘটে। ঘটনা শুরুর সময় কর্তৃপক্ষ ভেতরে মিটমাটের চেষ্টা করেছিল, আগে আমাদের জানায়নি।’ তিনি বলেন, ‘কারখানার ভেতরের ঘটনা বাইরে ছড়িয়েছে ভেতর থেকেই, তা না হলে বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ওই জায়গায় কারখানা কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। যখন বাইরের লোকজন গিয়ে গেট ভাঙার চেষ্টা করেন, তখনই কারখানা রক্ষা করতে গিয়ে শ্রমিককে লোকজনের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়।’
সময়মতো খবর পেলে বাঁচানো যেত উল্লেখ করে ভালুকা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সূত্রপাত যখন, তখন পুলিশে খবর দিলে শ্রমিককে উদ্ধার করা যেত। কিন্তু তাঁদের শেষ মুহূর্তে খবর দেওয়া হয়। তিনি বলেন, এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ১২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
আজ বেলা পৌনে দুইটার দিকে ‘গার্মেন্টস শ্রমিক সংগঠনসমূহ’ ব্যানারে কারখানাটির সামনে থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি এক কিলোমিটার দূরে ঘটনাস্থলে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে মিলিত হয়। ব্যানারে লেখা ছিল, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও। দীপু চন্দ্র দাসের হত্যার বিচার চাই। দীপু চন্দ্র দাসের পরিবারকে একজীবনের আয়ের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’
সমাবেশে গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় সহসভাপতি জলি তালুকদার বলেন, যারা মব করে দীপুকে পিটিয়ে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করে শাস্তি দিতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির ময়মনসিংহের সভাপতি এমদাদুল হক মিল্লাত বলেন, দীপু হত্যার ঘটনাটি মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় যারা দায়ী, তাদের সবার দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে।
সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে গার্মেন্টস ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু, গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সত্যজিৎ বিশ্বাস, গার্মেন্টস শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের সভাপতি শবনম হাফিজ, গার্মেন্টস অ্যান্ড টেক্সটাইল শ্রমিক ফেডারেশনের নেত্রী তসলিমা আক্তার, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন।
এ বিষয়ে কারখানার জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ) উদয় হোসেন বলেন, ‘আমরা এ ঘটনা তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার চাই। আমাদের দিক থেকে যত প্রকার সহযোগিতা দরকার, আমরা সেটা করব। যে–ই দোষী হবে, সে–ই বিচারের আওতায় আসবে। এখানে আমাদের কোনো প্রকার কম্প্রোমাইজ নাই। নিহতের পরিবারকে আমাদের পক্ষ থেকে সব রকমের সহযোগিতা করা হবে।’
বিবার্তা/এসএস
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]