যশোরের মণিরামপুর উপজেলার পাড়দিয়া গ্রামে সন্ত্রাসী হামলায় পণ্ড হয়ে গেলো ফকির মন্টু শাহের লালন স্মরণোৎসব। সোমবার (২৫ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টার দিকে অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার কথা থাকলেও দুপুরে হামলার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়।
এই অঞ্চলের বাউল শিল্পীদের নিয়ে প্রতিবছর (২৫ নভেম্বর) ফকির মন্টুশাহ (এস এম ফজলুর রহমান) তার নিজ বাড়িতে আয়োজন করেন দুই দিনব্যাপী সাধু সংঘ।
সোমবার দুপুরে মণিরামপুর উপজেলার শ্যামকুড় ইউনিয়নের পাড়দিয়া গ্রামে সেই সাধু সংঘের অনুষ্ঠানে হামলা চালায় স্থানীয় যুবদল ও ছাত্রদলের তিন জন নেতাকর্মী।
মন্টু ফকিরের অভিযোগ, রবিবার (২৪ নভেম্বর) স্থানীয় শ্যামকুড় ইউনিয়নের বিএনপি নেতা ফারুক হোসেন তাকে সাধু সংঘ বন্ধ করতে বলেন। তিনি ওই নেতাকে জানিয়েছিলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে বাউলরা তার বাড়িতে আসবে, কয়েকজন এসেছেনও। হঠাৎ করে বন্ধ করা যাচ্ছে না। তখন বলা হয়, যারা আসছে তাদের খাওয়াদাওয়া করিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু আজ দুপুরে ইউনিয়ন ছাত্রদলের সহসভাপতি শামিম খাঁ, জগন্নাথ ওরফে জগোসহ তিন জন একটি মোটরসাইকেলে তার বাড়িতে গিয়ে চড়াও হয়।
মন্টু ফকিরের স্ত্রী মনোয়ারা খাতুন জানান, এই তিন জন বাড়িতে ঢুকে তাদের টিনের বাড়িসহ আখড়ায় দা দিয়ে কোপাতে থাকে। ওই সময় তারা প্যান্ডেলের শামিয়ানা, চেয়ার, হাঁড়ি-পাতিল ভাঙচুর করে। তারা আখড়াঘরে থাকা কাঁথা-বালিশ ফেলে দেয় এবং ঘরে থাকা নগদ টাকা লুটে নেয়। ওই সময় তাদের ছেলে-বউয়ের দুইটি ছাগল নিয়ে টানাটানি করতে থাকে। নিষেধ করলে তারা টাকা দাবি করে। তখন তিনি একজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা ধার করে তাদের দিলে তারা হুমকি দিয়ে চলে যায়।
ফকির মন্টুশাহ বলেন, ‘আগের দিন রাতে স্থানীয় বিএনপি নেতা ফারুক হোসেন আমাকে বাউল গানের আসর বন্ধ করতে বলেন। আজ সকালে শফি নামে আরেকজন এসে গানবাজনা বন্ধ করতে বলে যান। আমি তার কাছে আগত মেহমানদের জন্যে আয়োজন করা খাবার খাওয়ানোর অনুমতি চাইলে তিনি রাজি হন। কিন্তু দুপুর দেড়টার দিকে ছাত্রদল নেতা শামিম খাঁ, জগোসহ তিন জন মোটরসাইকেলে এসে খিস্তিখেউড় করতে করতে আমার বাড়িতে হামলা চালায়। তখনও বাউলরা সবাই এসে পৌঁছায়নি। তারা হামলা চালায় ও খানকায় থাকা মালামাল ছুঁড়ে ফেলে, দা দিয়ে বেড়ায় কোপায় আর সেখানে থাকা কিছু টাকা লুটে নেয়।’
তিনি অভিযোগ করেন, তারা আমার ছোট ছেলে শাহনেওয়াজকে ফোনে শাসায়। রাতে এসে তারা দশ হাজার টাকা নিয়ে যাবে। না দিলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। এ ঘটনার পর আমিসহ পরিবারের লোকজন জীবন নিয়ে শঙ্কায় রয়েছি। ভয়ের কারণে থানায় অভিযোগও দিতে পারছি না।
এদিকে, ঘটনার পর থেকে ভুক্তভোগী পরিবারসহ সাধু সংঘে আগত বাউল শিল্পীদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
খুলনার চুকনগর থেকে সাধু সংঘে অংশ নেওয়া রফিক বাউল বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে সাধু সংঘে আসি। এবারও এসে দেখি অনেক সাধু এসেছে। তবে মন্টু ফকিরের বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে। লালনের ঘর, ফকিরের খানকাঘরও ভাঙচুর, লুটপাট করা হয়েছে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।’
যশোর বাউলিয়া সংঘের সাধারণ সম্পাদক পরিতোষ বাউল জানান, এখানে জমজমাট সাধু সংঘ বসে। খুলনা বিভাগের অনেক সাধু এখানে আসর জমায়। বাউলরা মুক্তমনের মানুষ। তারা ধর্ম, জাত, রাজনীতি বোঝে না। অথচ সন্ত্রাসীদের এই হামলায় পণ্ড হয়ে গেলো সাধু সংঘের বাউল গান।
ঘটনার বিষয়ে জানতে শামিম খাঁকে ফোন করা হলে পরিচয় জানার পর তিনি তার ভাই পরিচয়ে জহির নামে একজনকে ধরিয়ে দেন। জহির তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে বলেন।
হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মন্টু ফকিরের ওখানে গাঁজার আসর বসে। তিনি সেখানে গাঁজা বিক্রিও করেন। স্থানীয় মুরুব্বিরা তাকে এসব বন্ধ করতে বললেও তিনি অব্যাহত রাখেন।’
ভাঙচুর ও টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই অনুষ্ঠানের জন্যে শামিম মন্টু ফকিরকে ১৩ হাজার ৯০০ টাকা দেয়। যেহেতু অনুষ্ঠান হচ্ছে না, সেকারণে সে টাকা ফেরত চাইতে গিয়েছিল।’ এই কথা বলার পর তিনি ফোন কেটে দেন।
এসব বিষয়ে বিবর্তন যশোরের সভাপতি নওরোজ আলম খান চপল বলেন, ‘আমাদের যে বাঙালি সংস্কৃতি, তার শিকড় উপড়ে ফেলার দীর্ঘ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আজ এই গ্রামে হামলা এবং বাউলদের অনুষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে। একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা এবং প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’
জানতে চাইলে মণিরামপুর থানার ইন্সপেক্টর পলাশ বিশ্বাস বলেন, ‘ঘটনার বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনও অভিযোগ দেয়নি। তবে ঘটনা শুনে সেখানে পুলিশ ফোর্স পাঠানো হয়েছিল। স্থানীয় কয়েকজন লোক তাদের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলে। বড় ধরনের কিছু না।’
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]