
জমকালো বিয়ের আয়োজন। কিন্তু মানুষের নয়, গাছের। জগতের মঙ্গল কামনায় ও মানুষকে অমঙ্গল থেকে রক্ষার বিশ্বাস থেকে দুটি গাছের বিয়ে দেয়া হয়েছে ঠাকুরগাঁওয়ে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সামাজিক আচার ও ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার সবই অনুসরণ করা হয় আলোচিত এই বিয়েতে।
বছর চার আগে স্থানীয় স্কুল শিক্ষক জীতেন চন্দ্র সিংহ গ্রামের এক শ্মশান ঘাটে একটি বটগাছ এবং দুই বছর আগে একটি পাকুড়গাছ রোপন করেছিলেন।
ওই শিক্ষকের উদ্দেশ্যে ছিলো শ্মশানে বটবৃক্ষ ছায়া দেবে এবং পাকুড়গাছের পাতা মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধের সময় কাজে লাগবে। এভাবেই দিন, মাস ও বছর কেটে যায়। কিন্তু কয়েক দিন আগে তিনি স্বপ্নে নির্দেশ পান যে তার রোপণকৃত সেই গাছ দুটোর বিয়ে দিতে হবে! এরপর স্বপ্নের কথা গ্রামবাসীকে জানান তিনি। পরে সবাই মিলে উৎসবমুখর পরিবেশে ঢাকঢোল বাজিয়ে স্বপ্নপূরণ করলেন তিনি।
মঙ্গলবার (১৮ জুন) বিকেলে জেলার বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার ধনতলা ইউনিয়নেরঝুকুরঝাড়ী গ্রামের শ্মশান ঘাটে এ বিয়ের আয়োজন করা হয়। হিন্দুধর্মের রীতি অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিক কার্য সম্পাদন করেছেন ওই গ্রামের ঠাকুর জগদীশ চক্রবর্তী। বিয়েতে অতিথির তালিকায় ছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ।
দুই বৃক্ষের বিয়েতে আয়োজনের কোনো কমতি রাখেনি গ্রামের মানুষজন। কনে পাকুড়গাছের নামকরণ করা হয় স্বর্ণলতা, আর বর বটগাছের নামকরণ করা হয় গৌরব।
রীতি অনুসারে, কনের বাবা ঝুকুরঝাড়ী গ্রামের কার্তিক চন্দ্র সিংহ করেন সব আয়োজন এবং বরের বাবার হাতে কন্যাদান করেন। অন্যদিকে বরের বাবা জীতেন চন্দ্র সিংহ গ্রহণ করে নেন পুত্রবধূকে। এছাড়া কন্যার সাত ভাই এবং বরের দুই ভাই এক বোন বিবাহ অনুষ্ঠানে রীতির সব নিয়ম পূরণ করেন। বিয়ের অনুষ্ঠান দেখতে দূরদূরান্ত থেকে এসেছিলেন অনেকেই।
আয়োজকদের একজন বলেন, প্রকৃতি ও ব্যক্তির মঙ্গল কামনায় এ ধরনের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ের বেশির ভাগ ব্যয় বহন করেছেন বর-কনের বাবা-মায়েরা। পাশাপাশি দান-দক্ষিণাও আছে।
দুই গাছের বিয়েতে ঘটকালি করেছেন ধুকুরঝাড়ী গ্রামের কৃষক অলিন চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘প্রথমে বরের বাবার প্রস্তাব কনের বাবাকে দিই। এরপরে দুজনে রাজি হওয়ার পর বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। জীবনে অন্য কোনো বিয়ের ঘটকালি করার অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই বিয়ের অভিজ্ঞতায় বেশ আনন্দিত।
বিয়ের আয়োজন শুরু হয় মূলত গতকাল মঙ্গলবার সকালে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। দুপুরে বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে দেখা যায়, শ্মশান ঘাটে থাকা বট ও পাকুড়গাছ দুটিকে লাল- শাড়ি ও ধূতি পরানো হয়েছে। গাছ দুটিকে পারানো হয় ফুলের মালা। বিয়ের মণ্ডপে আঁকা হয়েছে আলপনা। তাতে ধান-দুর্বা-হলুদ, সিঁদুর, ধূপকাঠি, কলা, দই, সন্দেশসহ বিভিন্ন পদের মিষ্টান্ন রাখা হয়েছে। বর-কনের বাবা-মাকে বসানো হয়েছে বেদির সামনে। পুরোহিত মন্ত্র পড়ছেন। চলছে উলুধ্বনি। অদূরে বাজছে বিয়ের সানাই, ঢাক, ঢোল, কাঁসর।
বিকেলের দিকে সনাতন ধর্মীয় রীতিতে মন্ত্রোচ্চারণের পরই সাত পাকে বাঁধা পড়ে বর-কনে। আমন্ত্রিত অতিথিরা বর-কনেকে আশীর্বাদ করেন।
বিয়েতে পুরোহিতের দায়িত্বে থাকা জগদীশ চক্রবর্তী বলেন, একসঙ্গে বেড়ে ওঠায় বৃক্ষ দুটির বিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত ব্যক্তির মোক্ষলাভ ও প্রকৃতি বিনাশের হাত থেকে রক্ষা করা এবং মানুষকে বৃক্ষপ্রেমী করে তোলার উদ্দেশ্যেই এই বিয়ের আয়োজন।
বিয়েতে নিমন্ত্রিত অতিথি সূচনা রানী রায় (২৫) বলেন, বট-পাকুড়ের বিয়ের কথা এত দিন শুনেছি। এবার প্রথম নিজের চোখে দেখলাম। মানুষের বিয়ের মতোই আয়োজন করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ির আয়োজনে শরিক হতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।
বর বটগাছের বাবা জীতেন চন্দ্র বলেন, স্বপ্নের কথা গ্রামের লোকজনকে জানালে সবাই রাজি হয়ে যায়। দ্রুত দিনক্ষণ ঠিক করে ছেলের বিয়ে দিলাম। বিয়ে উপলক্ষ্যে গ্রামের অনেকেই উপোস রয়েছে।
পাকুড়গাছ স্বর্ণলতা রানীর বাবা কার্তিক চন্দ্র সিংহ বলেন, আমি মেয়ের বাবা হিসেবে কন্যাদান করেছি। এই বিয়ে এবং গাছ দুটি আমাদের মঙ্গল বয়ে আনবে, সমাজের অশান্তি দূর করবে।
ধনতলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সমর চ্যাটার্জি নূপুর বলেন, বিয়ে উপলক্ষ্যে দাওয়াত পালন করতে এসেছি। এর আগেও পাশের ইউনিয়নে একই রকম দুটি বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সেগুলো দেখার সুযোগ হয়নি। বিয়েতে আপ্যায়ন ব্যতীত সবকিছুই অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের বিয়ের মতোই হয়েছে।
বিবার্তা/মিলন/লিমন
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]