টাঙ্গাইলে অবাধে বিষটোপ দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার
প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩৪
টাঙ্গাইলে অবাধে বিষটোপ দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

টাঙ্গাইলের চারান বিল, চাপড়া, মলাদহ, ঝাইতলা, বরকম, পুঁইটা, নেধার বিলসহ বিভিন্ন খাল-বিল জলাধারে এখন অতিথি পাখির কলকাকলীতে মুখর। দেশি-বিদেশি পাখির কিচিরমিচির ডাক ও ঝাঁক বেঁধে আকাশে ওড়ার বিমোহিত দৃশ্য দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করে। জেলার খাল-বিল ও জলাশয়ে এ অপরূপ দৃশ্য অবলোকনে প্রকৃতিপ্রেমীদের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু বেরসিক শিকারীরা বিশেষ কায়দায় ‘বিষটোপ’ ব্যবহারসহ নানাভাবে এসব পাখি শিকারে মত্ত হওয়ায় পাখিরা নিরাপত্তহীনতায় পড়েছে।


জানা যায়, শীতকালে উষ্ণতার খোঁজে শীতপ্রধান বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশের জলাধারগুলোকে নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় পরিযায়ী পাখি। সবুজে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত বিলগুলো যেন শীতের অতিথিদের বরণ করে নিতে বাৎসরিক প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। জেলার বিলগুলোতে প্রতিবছরের মতো এবারও এসেছে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি। নিত্যদিন ভোরের কুয়াশার আঁচল চিরে দলবেধে উড়ে চলা পাখির ডানার শো-শো শব্দ আর কলতানে ঘুম ভাঙে খাল-বিল ও জলাধারের বাসিন্দাদের। এবারও বিলের কচুরিপানা ও জলজ উদ্ভিদের মাঝে খোলা পানিতে জলকেলিতে মেতে উঠেছে পাখিরা। একটু থেমেই এক ঝাঁক পাখি পানিতে অবতরণ করছে তো আর এক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। এ যেন তাদের আপন নীড়ে উৎসব।


জেলা মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, টাঙ্গাইল জেলায় ১০৪৩ দশমিক ৫০ হেক্টর আয়তনজুড়ে ১২৮টি খাল, ৬৮০৮ দশমিক ৩৪ হেক্টর আয়তনজুড়ে ২৭৭টি বিল, ১০১৫ দশমিক ৭৪০ হেক্টর আয়তনে ৮২টি জলাশয় রয়েছে। এছাড়া ৪৮ দশমিক ৩৩ হেক্টর আয়তনে ১৭২টি প্লাবন ভূমি রয়েছে।


টাঙ্গাইলের ১২টি উপজেলার চর নিকলা বিল, কয়েড়া ধোপাচড়া বিল, আমুলা বিল, বর্ণিবিল, বার্থাবিল, বালিয়া বিল, নিরাইল বিল, চারান বিল, দোগাঙ্গীবিল, মলাদহবিল, ঝাইতলাবিল, বরকমবিল, পুঁইটাবিল, ধোপারকমবিল, খৈইলাকুড়িবিল, আদমবুইড়াবিল বিভিন্ন খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিতে শীত মৌসুমে দেশি পাখির সঙ্গে পরিযায়ী পাখি এসে যোগ দেয়। স্থানীয় বোরো ধানের খোলা মাঠে বা জলাধারের কিনারে অল্প পানিতে মাছ শিকারের জন্য ঝাঁকে ঝাঁকে কানিবক, গো-বক, ছোট সাদা বক, বেগুনি বক, বড় বক, নিশি বক, বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককনা, গাঙ কবুতর, মানিকজোড়সহ নানা ধরনের দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির পাখি শীত মৌসুমে খেলা করে। পাখিরা রাতে সাধারণত আশপাশের গাছগাছালীতে আশ্রয় নেয়।


দিনভর পাখিগুলো ছোট ছোট মাছ ও জলজপ্রাণি নানা ভঙিমায় শিকার করে খায়। কিচিরমিচির কলকাকলীতে মেতে ওঠে এবং মাঝে মাঝেই ঝাঁক বেধে জলাশয়ের পাশে ওড়ে বেড়ায়। বিমোহিত এ দৃশ্য অবলোকনে প্রকৃতিপ্রেমীরাও ভোর থেকে বিকাল পর্র্যন্ত জলাধারে বেড়াতে আসে।


তবে এক শ্রেণির শিকারী অভিনব কায়দার ‘বিষটোপ’ সহ নানা ফাঁদে এসব পাখি শিকারে মত্ত হয়ে পড়েছে। কেউ কেউ এসব পাখি শিকার করে স্থানীয় মাংশাসীদের কাছে চড়াদামে বিক্রি করছে। ফলে জেলার খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমিগুলোতে প্রতিবছর পরিযায়ী পাখির বিচরণ কমছে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিকারীরা ছোট মাছের পেটে বাসুডিন, ফুরাডান ও কার্বোটাফ নামে এক ধরনের বিষ ঢুকিয়ে খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমির পাশে বা খোলা মাঠে ছিটিয়ে রাখা হয়। এটাকেই ‘বিষটোপ’ বলা হয়। এসব বিষ মেশানো মাছ খেয়ে দেশি-বিদেশি পাখিগুলো অচেতন হয়ে পড়ে। শিকারীরা সেগুলো ধরে নিয়ে হাটবাজার ও স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে দেয়। এছাড়া পুঁটি মাছের পেটে বিষ দিয়েও নির্বিচারে বক পাখি শিকার করা হয়।


মূলত খাওয়ার জন্যই বক পাখি শিকার করা হয়ে থাকে। বিষটোপ খেয়ে বক ও অতিথি পাখিরা অচেতন হয়ে পড়লে শিকারীরা দৌঁড়ে গিয়ে ধরে সাথে সাথে জবাই করেন। পরে ওই পাখি দিয়ে ভুড়ি ভোজের আয়োজন করে বা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করে থাকেন। এছাড়া নাইলনের সুতোর তৈরির ফাঁদ ও বাটাল (পাখি শিকারের জন্য এক ধরনের দেশীয় অস্ত্র বা খেলনা) দিয়েও পাখি শিকার করা হচ্ছে। বিষটোপ খেয়ে যেসব পাখি অজ্ঞান হয়ে শিকারীর হাতে ধরা না পড়ে সে পাখিগুলো উড়ন্ত পথেই মারা যাচ্ছে। জেলাজুড়ে প্রকাশ্যে এসব পাখি শিকার করা হচ্ছে। শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেলায় পাখি শিকার ও বিক্রেতার সংখ্যাও বাড়ছে।


জেলার পরিবেশবিদরা মনে করেন, এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে ক্রমান্বয়ে পাখির বিচরণ কমে যাবে- যা পরিবেশের ভারাসাম্য বিনষ্ট করবে।


বন্যপ্রাণি সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পাখি শিকার ও বিক্রয় দণ্ডনীয় অপরাধ। ১৯৭৪ সালের বন্যপ্রাণি রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন অনুযায়ী, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছরের জেল বা এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করার কথা বলা হয়েছে। একই অপরাধ আবার করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণের বিধানও রয়েছে।


নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিকারী জানায়, প্রতিবছর শীত মৌসুমে শখের বসে খাল-বিল-জলাশয় ও প্লাবন ভূমি থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বক, ঘুঘু, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, শামুককনা শিকার করে থাকেন। এগুলো তারা বিষ জাতীয় দ্রব্য বা বাটালের মাধ্যমে শিকার করেন। তবে বিষ খেয়ে অসুস্থ ও বাটালের মাধ্যমে ছোঁড়া মারবেলের আঘাতে আহত হয়ে মাটিতে অচেতন হয়ে পড়লে তারা ধরে সঙ্গে সঙ্গে জবাই করেন। শিকার করা বক পাখির আকার ভেদে প্রতিটি ৮০-১০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।


কলেজ পডুয়া পাখি প্রেমিক ইসতিয়াক আহমেদ ইমরান জানান, সঠিক নজরদারি ও জনসচেতনার অভাবে পাখি শিকার বেড়েছে। পাখি শিকার দণ্ডনীয় অপরাধ জেনেও শিকারীরা বিরত থাকছে না। এক ধরনের অসাধু ব্যক্তি বা যুবক আইনকে উপেক্ষা করে এসব কাজ করছে। দুঃখজনক হলেও সত্য- পাখি নিধন বা শিকারে আইন থাকলেও তার কার্যকর কারার উদাহরণ খুব কম। অতিথি পাখি শিকার রোধে প্রচলিত আইন বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।


মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সুজাউদ্দিন তালুকদার জানান, পাখি শিকারের জন্য যে বিষটি ব্যবহার করা হয় তা ওপিসি জাতীয় বা গণ ফসফরাস কমপাউন্ড জাতীয় এক ধরণের বিষ। এটা কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটা মানুষের দেহে সবদিক দিয়েই ঢুকতে পারে- স্কীনের উপর দিয়ে ঢুকতে পারে, খাবারের মাধ্যমে এবং শ্বাসনালীর মাধ্যমেও ঢুকতে পারে এবং আরেকটি বিষয় হচ্ছে এটা স্কিনের উপরে থাকলে রক্তের সাথে মিশে যেতে পারে।


তিনি আরও জানান, বিষটোপে শিকার করা এসব পাখি মানব দেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এ বিষের মাত্রা যদি বেশি থাকে তাহলে মানুষ মারা যেতে পারে। না হলে অল্প সময়ের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হতে পারে। যেমন বমি হতে পারে, প্রেসার কমে যেতে পারে, কিডনি এবং লিভারের ক্ষতি হতে পারে। এ ধরণের বিষ দিয়ে শিকার করা পাখি কখনই খাওয়া যাবে না- কোনোভাবেই এটা নিরাপদ হবে না। আগুনে ফুটালেও এ বিষ যাবেনা।


মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (ইএসআরএম) বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর ডক্টর এএসএম সাইফুল্লাহ জানান, একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে- শুধুমাত্র মধুপুর জাতীয় উদ্যানে ১৪০ প্রজাতির পাখির উপস্থিতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যার অনেক বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে করা হয়। বাংলাদশে রয়েছে বাহারি ধরণের বক পাখি এবং এদের অনেক প্রজাতি টাঙ্গাইল অঞ্চলে দেখা যায়। এর মধ্যে রয়েছে- কানিবক, গো-বক, ছোট সাদা বক, বেগুনি বক, বড় বক, নিশি বক। টাঙ্গাইল অঞ্চলে কানিবক, ছোট সাদা বকের উপস্থিতি সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এসব বক অধিকাংশই মাংসাশী, মোটকথা এরা ছোট ছোট মাছ খায় এবং এগুলো জলাভূমি, ধান খেত থেকে শিকার খেয়ে থাকে। বক সাধারণত বড় বড় গাছকে আবাস হিসেবে বেছে নেয়। খাবারের স্বল্পতা, খাবারে বিষক্রিয়া, জলাভূমি কমে যাওয়া এবং গাছ ও আবাস স্থল ধ্বংস হলে এদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন এবং এসব ঘটার কারণে বকসহ নানা পাখির বৈচিত্র্য দিন দিন কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে অনেক পাখির প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে বাস্তুসংস্থানের ভারসাম্য ও জীব বৈচিত্র্যের ওপর।


টাঙ্গাইল বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. সাজ্জাদুজ্জামান জানান, যেসব এলাকায় পাখি শিকার করা হচ্ছে সে অঞ্চলে বনাঞ্চল না থাকায় তাদের তেমন একটা নজরে আসে না। তাছাড়া তাদের জনবল খুব কম থাকায় যথা সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন না। তবে যারা পাখি শিকার করে অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


বিবার্তা/বাবু/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com