বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীতে বর্ণিল আয়োজন
প্রকাশ : ১২ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:৪২
বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লীতে বর্ণিল আয়োজন
লামা প্রতিনিধি
প্রিন্ট অ-অ+

পাহাড়ে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’। গেল দুই বছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের কারণে এ উৎসব ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পালন করতে পারেনি নৃ-গোষ্ঠিরা। এ বছর পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় উৎসবকে ঘিরে পাহাড়ি পল্লী গুলোর ঘরে ঘরে চলছে উৎসবের আমেজ। ইতিমধ্যে পাড়া ভিত্তিক নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে উৎসবকে বরণ করে নেওয়ার যাবতীয় আয়োজন। ক্যায়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হবে ‘বৈসাবি’ উৎসব।


১৩ এপ্রিল, বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হয়ে এই উৎসব শেষ হবে আগামী ১৭ এপ্রিল। কেন্দ্রীয়ভাবে বান্দরবান জেলার লামা ও আলীকদম উপজেলা সদর এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের পাড়াগুলোর বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠন, ক্লাব, সমিতির উদ্যোগে সাংগ্রাইং পোয়ে জলকেলি উৎসব পৃথক ভাবে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছেন আয়োজক কমিটির নেতৃবৃন্দরা। উৎসবের দিনগুলোতে আনন্দে হয়ে উঠবে পাহাড়ি বাঙ্গালীর সম্প্রীতির এক মিলনমেলা।


জানা গেছে, বান্দরবানের লামা ও আলীকদম উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং একটি পৌরসভার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায় বর্ষবরণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হিসেবে পালন করে থাকেন। ১৯৮৫ সাল থেকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সংগঠনের সম্মিলিত উদ্যোগে ‘বৈসাবি’ নামে এ উৎসব পালন হয়ে আসছে। যা সময়ের ব্যবধানে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ‘বৈসাবি’ হিসেবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠে। এ উৎসবকে সামনে রেখে উপজেলাগুলোর হাট-বাজারে কেনা-কাটা ধুম পড়েছে। বিপনী বিতানগুলোতে পাহাড়ি তরুন-তরুনীদের উপচে পড়া ভিড় লক্ষনীয়।


বর্ষবরণ ও বিদায় উৎসবকে ত্রিপুরা সম্প্রদায় ‘বৈসুক’, মারমা সম্প্রদায় ‘সাংগ্রাই’ এবং চাকমা সম্প্রদায় ‘বিজু’ নামে এ উৎসব পালন করে থাকেন। একত্রে ৩টি আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈ-সা-বি বলে পাহাড়ে এই উৎসব পরিচিত। চৈত্রের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু। এদিনে ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজানো হয়। দ্বিতীয় দিন চৈত্র সংক্রান্ত ‘বৈসাবি’ অথবা মূল বিজু। এদিনকে উৎসবের প্রধান দিন ধরে নেয় চাকমারা। ত্রিপুরা ও মারমারা এদিন পালন করলেও তাদের জন্য ১ বৈশাখ হচ্ছে গুরুত্বপুর্ণ দিন।


মূল বিজুর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে ‘পাচন’ (অনেক রকমের শাক-সবজি, ফল মুলের সমন্বয়ে রান্না করা তরকারি)। এই পাচনে যে যত পদের সবজি মেশাতে পারবে তার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এদিন নতুন কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি বেড়ানো, পাজন খাওয়া চাকমাদের আনন্দ উদ্যাপনের মূল আয়োজন। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত আছে যে, বিজুর দিন কমপক্ষে পাঁচ বাড়িতে বেড়াতে হবে। এসব বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে পাচন খেলে পরবর্তী ৩ মাস কোন রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবেনা কেউ। পাচনের সঙ্গে ভাত থেকে তৈরি পানীয় অর্থাৎ দো-চুয়ানী (বাংলা মদ)। এই দো-চুয়ানী ছাড়া চাকমা সমাজে বিজু, বিয়ের অনুষ্ঠান কখনও সম্পন্ন হয়না। এই রীতি এখানে প্রচলিত। আর এই দিন বাংলা মদ খেতে কোন বাধা নেই। খাও দাও অনাবিল আনন্দে মেতে ওঠে। এটাই রীতি।


ত্রিপুরা সম্প্রদায় এদিন উদযাপন করে তাদের ঐতিহ্যবাহী বিশেষ নাচের মাধ্যমে। যার নাম ‘গড়াইয়্যা নৃত্য’। নারী পুরুষ সবাই এক সঙ্গে নাচে। এ নাচের বিশেষত্ব হচ্ছে, যে বাড়ি থেকে এ নাচ শুরু হবে সে বাড়িতেই এসে নাচ শেষ করতে হবে। ত্রিপুরাদের এই উৎসবকে ‘বৈসুক’ বলে। মারমা সম্প্রদায় ১ বৈশাখ পালন করে বর্ণিল জলকেলী বা পানি উৎসবের মধ্য দিয়ে। পুরনো বছরের সব দুঃখ হতাশাকে মুছে ফেলার জন্য জল ছিটানো উৎসব (পানি খেলা)। যা মারমা সম্প্রদায়ের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব নামে পরিচিত। অবশ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় চাকমাদের সাংগ্রাই উৎসবের নাম এখন ‘ওয়াটার ফেষ্টিভ্যাল’ রাখা হয়েছে। নারী-পুরুষ মারমা গানের তালে তালে একে অপরকে পানি ছিটিয়ে একে অপরকে জলে টুইটুম্বুর করে ভেজানোর প্রতিযোগিতা করেন। এই জলকেলির মাধ্যমে মারমা তরুন-তরুনী একে অপরের মাঝে ভালোবাসার বিনিময় করেন। একইভাবে ত্রিপুরা, বম, পাংখোয়া সম্প্রদায়গুলোও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নিজস্ব খাবারের আয়োজন করছে।


বৈসাবি উৎসবকে ঘিরে পাড়ায় পাড়ায় নানা খেলা-ধুলারও রয়েছে ঘিলাখেলা, নাদেরখেলা, বলিখেলা, ফোরখেলা, পুত্তিখেলা ও তুমুরো খেলা এবং তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে উপরে উঠা। আয়োজক ও জনপ্রতিনিধিদের মতে এবারে পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুকুলে থাকায় এবার উৎসব মখুর পরিবেশে ‘বৈসাবি’ পালনে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।


গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যা পাড়া উৎসব পরিচালনা কমিটিরি সদস্য নুহ্লামং মার্মা জানান, এ বছর উৎসবের দিনগুলোতে পানি খেলা, তৈলাক্ত বাঁশে আহরণ ও মেয়েদের সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের আয়োজন করা হয়েছে।


কেন্দ্রীয় ‘বৈসাবি’ উৎসব উদযাপন কমিটির সদস্য বাবু মং মার্মা, মংচাই মার্মা ও ফাইতং হেডম্যান পাড়ার উৎসব আয়োজক কমিটির আহবায়ক থোয়াইন সানু মার্মা বলেন, গেল দুই বছর করোনা ভাইরাসের কারণে উৎসাহ উদ্দীপনায় উৎসব পালন করা যায়নি। পরিস্থিতি স্বাবাভিক হওযার কারণে এবার উৎসব মখুর পরিবেশে পালনের আয়োজন করা হয়। তারা বলেন, বৈসাবিকে সামনে রেখে ৪ দিনের বর্ণাঢ্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে ক্যয়াং দর্শন ও সমবেত প্রার্থনা, দড়ি টানাটানি, হাড়ি ভাঙ্গা, পিঠা তৈরি, ঐতিহ্যবাহী তৈলাক্ত বাঁশ আহরণ, পানি খেলা, সাংস্কৃতিক ও পুণর্মিলনী অনুষ্ঠান।


একই ধরণের অনুষ্ঠান পালনের সত্যতা নিশ্চিত করে আলীকদম উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা দুংড়িমং মার্মা ও অংশিথোয়াই মার্মা জানায়, উপজেলার ২৪টি বৌদ্ধ বিহার ও ৩০টি পাড়ায় পৃথক এ উৎসব যথাযথভাবে পালন করা হবে।


এ বিষয়ে লামা থানা পুলিশের অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিরা যাতে ‘বৈসাবি’ উৎসব শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর ভাবে পালন করতে পারেন, সেজন্য বৌদ্ধ কেয়াং ও পাড়াগুলোতে সাদা পোশাক ও পোশাকধারী পুলিশ মোতায়েন সহ বিশেষ নজরদারীতে রাখা হবে।


বিবার্তা/আরমান/এনএস


সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com