হীম ঠান্ডা জেঁকে বসেছে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায়। সন্ধ্যার পর ঘন কুয়াশায় ঢেকে যায় উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি পল্লীগুলো। কোন কোন সময় দুপুর পর্যন্তও সূর্যের দেখা মেলে না। গত কয়েকদিন ধরে এখানে ঘন কুয়াশা ও শৈত্যপ্রবাহ বিরাজ করছে। শীতের তীব্রতায় দুস্থ ও অসহায় মানুষের জবুথবু অবস্থা।

জানা গেছে, উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক শীতার্ত মানুষের জন্য সরকারিভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মাত্র ৩ হাজার ৯২০টি কম্বল। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য। গত বছর বরাদ্দ ছিল ২ হাজার ৬৬৪টি কম্বল। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ, পৌরসভা, ত্রাণ ও দূর্যোগ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছাড়া শীতার্তদের সহায়তায় কোন বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে আসেনি বলে জানান স্থানীয়রা।

এদিকে, শীত নিবারণে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে পৌরসভা এলাকার জন্য ৪৯০টি ও প্রতি ইউনিয়নে ৪৯০টি করে ৭টি ইউনিয়নের জন্য ৩ হাজার ৪৩০টি কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। অথচ উপজেলায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষ প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে বলে জানান স্থানীয় জনপ্রতিনিগণ।

পাহাড়ি নারী হ্লামাউ মারমা ও উমে মারমা বিবার্তাকে বলেন, অন্যবারের চেয়ে এ বছরে বেশি শীত পড়ছে। শীত থেকে রক্ষা পেতে আমরা আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বেশি শীত পড়লেও আমরা এখানে যারা বসবাস করছি তাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা চাই সরকার আমাদের শীতবস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করুক।

পাহাড়ি মংহ্লা চিং মারমা, বাবু মং মার্মা ও জয় মার্মা বিবার্তাকে বলেন, বেশি শীত পড়ছে। আমাদের গরম কাপড় যা আছে, তা দিয়ে শীত ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। তীব্র শীতের কারণে দৈনন্দিন কাজকর্ম ব্যাহত হওয়ায় পরিবার-পরিজনের খাদ্য যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দুস্থ ও শ্রমজীবী মানুষদের। পাড়ার লোকজন খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছে।

বাঙালি শ্রমিক আবদুর রহিম, বশির, জসিম ও আবুল হোসেন বিবার্তাকে বলেন, এ বছর অতিরিক্ত শীতের কারণে আমরা কোনও কাজ ঠিকমতো করতে পারছি না। কাজ করতে না পারায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ সদস্য ফাতেমা পারুল বিবার্তাকে জানান, পরিষদের পক্ষ থেকে একটি পৌরসভা ও সাতটি ইউনিয়নের শীতার্ত মানুষের মাঝে ১ হাজার ৫০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামস্থ শেয়ার এন্ড কেয়ার নামক একটি সংস্থা পৌরসভা এলাকায় আড়াইশ ও সরই ইউনিয়নের ১ হাজার দুস্থ মানুষের মাঝে শীত বস্ত্র বিতরণ করে।

সরেজমিন উপজেলা শহরসহ বিভিন্ন বাজারঘুরে দেখা যায়, পুরানো কাপড় নিয়ে ব্যবসায়ীরা পসরা সাজিয়ে বসেছে। খোলা আকাশের নিচে প্রায় অর্ধ-শতাধিক শীতবস্ত্রের দোকান আছে। এসব দোকানে খুচরা মূল্যে পুরানো শীতের কাপড় বিক্রিতে ধুম পড়েছে। বাজারের কাপড় ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকদিন ধরে হাড়ভাঙা শীত পড়ছে, সাথে ঘন কুয়াশা তো অছেই। গত বছরের চেয়ে এবার পুরনো কাপড় বিক্রি ভালো হচ্ছে।

লামা সদর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মিন্টু কুমার সেন বিবার্তাকে বলেন, আমার ইউনিয়নে আনুমানিক দুই হাজারেরও বেশি দুস্থ শীতার্ত মানুষ রয়েছে। কিন্তু ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ মিলে কম্বল বরাদ্দ দিয়েছে মাত্র ৬৫০পিস। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এখনো অনেক মানুষ শীতার্ত রয়েছে। একই অবস্থা অন্য সব ইউনিয়নেও বিরাজ করছে বলে জানান জনপ্রতিনিধিরা। তারা শীতার্তদের শীত নিবারণে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।

আবার শীতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে শীতজনিত রোগের প্রাদুর্ভাবও। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশু ও বৃদ্ধরা। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী এখানকার অধিকাংশ অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় শীতবস্ত্রের অভাবে রয়েছেন অতিকষ্টে।

লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসক শহীদুল ইসলাম বাবলু বিবার্তাকে বলেন, শীতজনিত কারণে বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হচ্ছে। গত এক মাসে হাজারেরও বেশি রোগী আন্ত বিভাগে ভর্তিসহ বহির্বিভাগে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, চলতি শীত মৌসুমে উপজেলার একটি পৌরসভা ও সাত ইউনিয়নের দুস্থ-অসহায়দের মধ্যে বিতরণের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ভাণ্ডার থেকে ৩ হাজার ৯২০টি কম্বল বরাদ্দ দেয়া হয়। ইতোমধ্যে এসব কম্বল শীতার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তর করা হয়েছে।

বিবার্তা/আরমান/জামাল