কম বয়সী মেয়েদের জোর করে রাজধানীর বিলাসবহুল আবাসিক হোটেলে নিয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করা। চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবসা, রাজধানী ও নরসিংদী এলাকা থেকে চাঁদাবাজি, মাসোয়ারা আদায়সহ নানাভাবে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়ে উঠেছেন র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ দম্পতি। গ্রেফতারের পর র্যাব ও গোয়েন্দাদের কাছে এমন তথ্যসহ আরো কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন তারা।
তাদের দেয়া তথ্যমতে র্যাব রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযানও চালিয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় রবিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় পাপিয়া দম্পতির আস্তানায় অভিযান চালায়। এসময় বিপুল পরিমাণ বিদেশি মদ, অর্থ ও অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। তারা শুধু বাংলাদেশেই নয়, তাদের অবৈধ ব্যবসার পরিধি থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত বলে জানা গেছে। এছাড়াও রাজধানী এবং নরসিংদীতে তাদের রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।
এর আগে দুর্ধর্ষ এই লেডি ডন শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ (২৮), তার স্বামী ২) মফিজুর রহমান ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে মতি সুমন (৩৮) এবং তাদের সহযোগী সাব্বির খন্দকার (২৯) ও শেখ তায়্যিবাকে (২২) গত ২২ ফেব্রুয়ারি হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে সাতটি পাসপোর্ট, নগদ দুই লাখ ১২ হাজার ২৭০ টাকা, ২৫ হাজার ৬০০ জাল টাকা, ৩১০টি ভারতীয় রুপি, শ্রীলংকান মুদ্রা ৪২০, ইউএস ডলার ১১ হাজার ৯১ ও সাতটি মোবাইল সেট উদ্ধার করা হয়। এরপর র্যাব তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। এসময় তারা র্যাব ও গোয়েন্দাদের কাছে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।
পরবর্তীতে তাদের দেয়া তথ্যমতে, রবিবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) হোটেল ওয়েস্টিনে তাদের নামে বুকিংকৃত বিলাসবহুল প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুট রুম এবং ফার্মগেট এলাকার ২৮নং ইন্দিরা রোডস্থ ‘রওশন’স ডমিনো রিলিভো’ নামক বিলাসবহুল ভবনে তাদের দুটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালানো হয়। এসময় একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি পিস্তলের ম্যাগাজিন, পাঁচটি পাসপোর্ট, ৩টি চেক, কিছু বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, পাপিয়া দম্পতিদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের বর্তমান সম্পদ ও বিলাসবহুল জীবন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসে। তাদের সুনির্দিষ্ট পেশা না থাকা স্বত্বে ও তারা স্বল্প সময়ে বিপুল সম্পত্তি ও অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছে। ফার্মগেট এলাকাস্থ ২৮ ইন্দিরা রোডে তাদের দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়ি ও নরসিংদীর বাগদী এলাকায় দুই কোটি টাকা মূল্যের দু’টি প্লট আছে।
এছাড়াও তেজগাঁও এফডিসি গেট সংলগ্ন এলাকায় অংশীদারিত্বে তাদের ‘কার একচেঞ্জ’ নামক গাড়ির শো রুমে প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগ আছে এবং নরসিংদী জেলায় ‘কেএমসি কার ওয়াস অ্যান্ড অটো সলিউশন’ নামক প্রতিষ্ঠানে ৪০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে তাদের। এমনকি দেশের বিভিন্ন ব্যাংকে তাদের নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত আছে বলেও জানা যায়। এব্যাপারে র্যাবের অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
র্যাব আরো জানায়, পাপিয়া দম্পতি রাজধানীর বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করতেন। তারা গত বছরের ১২ অক্টোবর থেকে চলতি বছর ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে মোট ৫৯ দিন হোটেল ওয়েস্টিনের কয়েকটি বিলাসবহুল রুমে অবস্থান করেন। এসময় আনুষঙ্গিক খরচসহ সর্বমোট ৮১ লাখ ৪২ হাজার ৮৮৮ টাকা নগদ পরিশোধ করেন তারা। তবে তাদেও এই বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রকৃত উৎসের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
র্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে, শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ও তার স্বামী সুমন চৌধুরী নরসিংদী এলাকায় অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজী, চাকরি দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা, জমির দালালি, সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স প্রদান, গ্যাস লাইন সংযোগ ইত্যাদির নামে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। এই পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে তারা পুলিশের এসআই ও বংলাদেশ রেলওয়েতে বিভিন্ন পদে চাকরি দেয়ার নামে মোট ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকাসহ ঢাকা ও নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে উপার্জন করেছেন।
শুধু তাই নয়, তাদের আয়ের অরেকটি উৎস হচ্ছে নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। তারা ঢাকাস্থ বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। যাদের অধিকাংশই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরি দেয়ার কথা বলে এবং বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। এসব অনৈতিক কাজে কেউ অস্বীকৃতি জানালে পাপিয়া দম্পতি তাদের বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করত।
এছাড়াও শামিমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ ও তার স্বামী সুমন চৌধুরীর নরসিংদী এলাকায় ‘কিউ অ্যান্ড সি’ নামক একটি ক্যাডার বাহিনী আছে। যাদের মাধ্যমে তারা নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজির, মাসোয়ারা আদায়, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য সকল প্রকার অন্যায় কাজের সাথে জড়িত।
এ ব্যাপারে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বিবার্তাকে বলেন, পাপিয়া দম্পতির ক্যাডার বাহিনীর অনেকের নাম ইতোমধ্যে জানা গেছে। যাদের গ্রেফতারে র্যাবের অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
বিবার্তা/খলিল/উজ্জ্বল/জহির
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]