হযরত আবু আলী ফরমাদী তুসী (রহ.)
প্রকাশ : ১১ জুন ২০২৪, ২২:৫৮
হযরত আবু আলী ফরমাদী তুসী (রহ.)
মৌলবী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
প্রিন্ট অ-অ+

আবু আলী আল-ফারমাদি আত-তুসী
আল্লাহ তার আত্মাকে পবিত্র করুন


‘হে শিশু! জ্ঞানী লোকমান বললেন,
মোরগকে আপনার চেয়ে বেশি সতর্ক হতে দেবেন না,
তুমি ঘুমন্ত অবস্থায় ভোরবেলা আল্লাহকে ডাকো।’
তিনি সঠিক, যিনি বলেছেন:
‘কচ্ছপ-ঘুঘু রাতে তার ডালে কেঁদেছিল
আর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম- কি মিথ্যা, মিথ্যা ভালোবাসা আমার?
আমি যদি সত্যিকারের প্রেমিক হতাম, তবে কচ্ছপ-কপোতিরা আমাকে কখনই ধরে ফেলবে- না।
আমি তার প্রভুর শুকনো চোখ প্রেমিক, যখন পশুরা কাঁদে!’


-গাজ্জালী,আইয়ুহাল-ওয়ালাদ


তাকে বলা হয় করুণাময়ের জ্ঞাতা এবং ঐশ্বরিক ভালোবাসার রক্ষক। তিনি শাফিঈ মাযহাবের আইনশাস্ত্রের পণ্ডিত এবং একজন অনন্য `আরিফ (আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ) ছিলেন। তিনি সালাফের মাযহাব (প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর পণ্ডিত) এবং খালাফ (পরবর্তীতে পণ্ডিত) উভয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু তিনি তাসাউফ বিজ্ঞানে তার ছাপ রেখেছিলেন। এটি থেকে তিনি কিছু স্বর্গীয় জ্ঞান আহরণ করেন যা আল-খিদরের প্রসঙ্গে কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে- ‘এবং আমরা তাকে আমাদের স্বর্গীয় জ্ঞান থেকে শিখিয়েছি’ [১৮:৬৫]।


একবার তিনি বললেন, ‘আমি আমার শিক্ষক আল-কুশায়রীর পিছনে জনসাধারণের গোসলের জন্য প্রবেশ করলাম এবং কূপ থেকে তার জন্য এক বালতি পানি নিলাম যা আমি নিজেই কূপ থেকে ভর্তি করেছি। আমার শিক্ষক এলে তিনি বললেন, 'বালতিতে পানি কে এনেছে?' আমি চুপ করে রইলাম, আমার মনে হলো আমি কিছু অসম্মান করেছি। তিনি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, 'কে জল এনেছে?' আমি চুপ করে রইলাম। তিনি তৃতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, 'কে সেই বালতি জলে ভরেছে?' অবশেষে বললাম, 'আমি করেছি, আমার শিক্ষক।' তিনি বললেন, হে বৎস, সত্তর বছরে আমি যা পেয়েছি, তা এক বালতি পানি দিয়ে তোমার কাছে পৌঁছে দিয়েছি। এর অর্থ হলো যে স্বর্গীয় এবং ঐশ্বরিক জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি সত্তর বছর ধরে সংগ্রাম করেছিলেন তা এক নজরে আমার হৃদয়ে চলে গেছে।’


ফজল বিন মুহাম্মদ বিন আলী (আরবি : فضل بن محمد بن علي, ; জন্ম ১০১৬-১০৮৪) সাধারণত ‘আবু আলী ফরমাদি’ নামে পরিচিত বা শুধু ‘আবু আলী’ ছিলেন নকশাবন্দী গোল্ডেন চেইনের একজন সাধক, একজন বিশিষ্ট সুফি। তুস, ইরানের খোরাসান থেকে ওস্তাদ ও প্রচারক। যৌবনে তিনি আল-গাজালির শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত।


তিনি ৪০৭ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাকে আল-ফারমাদি বলা হয়- তার জন্মস্থান, ফরমাদ। তুসের আশেপাশে অবস্থিত একটি গ্রাম।


শিক্ষা


প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর তিনি নিশাপুরের বিখ্যাত সুফি আব্দুল করিম কুশায়রির মাদ্রাসায় প্রবেশ করেন। তারপর আবু আল-হাসান আল-খারকানির অনুসারী ছিলেন। তিনি ইমাম আবু কাসেম কায়শেরী এবং শেখ আবু কাসিম জুরজানির শিষ্য ছিলেন। শেষ সময়ে তিনি শায়খ আব্দুল হাসান কারকানির কাছ থেকে আধ্যাত্মিক অনুগ্রহ লাভ করেন।


জীবনী


আবু আলী ফরমাদিকে বলা হয় করুণাময়ের জ্ঞাতা এবং ঐশ্বরিক ভালোবাসার রক্ষক। তিনি শাফিঈ মাযহাবের আইনশাস্ত্রের একজন পণ্ডিত এবং একজন অনন্য `আরিফ (আধ্যাত্মিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ) ছিলেন। তিনি সালাফের মাযহাব (প্রথম ও দ্বিতীয় শতাব্দীর হিজরি) এবং খালাফের (পরবর্তীকালে পণ্ডিতগণ) উভয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত ছিলেন, কিন্তু তিনি তাসাউফ বিজ্ঞানে তার ছাপ রেখেছিলেন। এটি থেকে তিনি কিছু স্বর্গীয় জ্ঞান আহরণ করেছিলেন যা আল-খিদর সাল্লার প্রসঙ্গে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে: ‘এবং আমরা তাকে আমাদের স্বর্গীয় জ্ঞান থেকে শিক্ষা দিয়েছি’ [১৮:৬৫]।


ইলমে তাসাউফে তিনি শায়েখ আবুল হাসান খেরকানী কুদ্দিসা সিররুহুর সাথে সম্পর্ক রাখেন। শায়খ আবুল কাসেম গুরগানী তুসী (র.) এর সাথেও তার সম্পর্ক ছিল, যিনি কুতুবে রব্বানী ও আরেফে সুবহানী ছিলেন। তাঁর ওফাত হয় ৪৫০ হিজরীতে। শায়েখ আবুল কাসেম (র.) এর সম্পর্ক ছিল শায়েখ আবুল হাসান খেরকানী (র.) এর সাথে, শায়েখ গুরগানী (র.) এর শায়েখ ওসমান মাগরেবীর সাথে। তার সম্পর্ক ছিল আবু আলী কাতেব, আবু আলী রুবারী (র.), সায়্যেদুত্ তায়েফা জুনাইদ বাগদাদী কাদ্দাসাল্লাহু আসরারাহুম এর সাথে। এরপর এই সিলসিলা হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এর সাথে মিলিত হয়েছে। এ ছাড়া শায়খ আবু আলী ফারমেদী (র.) শায়েখ আবু সাঈদ আবুল খায়ের (র.) এর সােহবত লাভ করেন। তাঁর থেকে অনেক ভাবে উপকৃত হন এবং খেলাফতও লাভ করেন। শায়খ আবু সাঈদ আবুল খায়ের (র.) এর ইন্তেকাল হয় ৪৪০ হিজরীতে। তাঁর বয়স হয়েছিল এক হাজার মাস।


বর্ণিত আছে, শায়খ আবু সাঈদ আবুল খায়ের (র.) এর মুরিদগণের মধ্যে ৪০ জন খেলাফত লাভ করেন। তন্মধ্যে শায়েখুল ইসলাম আহমদ জাম (র.) এবং শায়েখ আবু আলী ফারমেদী (র.) উল্লেখযোগ্য বুজুর্গ ছিলেন।


প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণা


তরিকায়ে নকশবন্দীয়ার এক বুজর্গ বলেন, খাজা আবু আলী ফারমেদী (র.) প্রবৃত্তির কুমন্ত্রণা সম্পর্কিত তত্ত্ব অবগত ছিলেন। কিন্তু তা প্রকাশের অনুমতি ছিল না। কিন্তু শায়েখ আহমাদ জাম (র.) প্রবৃত্তির। প্ররোচনা সম্পর্কে জানতেন এবং তিনি তা প্রকাশের জন্য আদিষ্ট ছিলেন। শায়েখ আবু আলী ফারমেদী (র.) এর আসল নাম ছিল ফজলুল্লাহ ইবনে মােহাম্মদ। তিনি খোরাসানের শায়েখদের শায়খ ছিলেন। তাঁর যুগে এই তরিকার একক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ওয়াজ নসিহতের ক্ষেত্রে তিনি ইমাম আবুল কাশেম কুশাইরী (র.) এর শিষ্য ছিলেন, যিনি অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতা ও তাফসীর লেখক। ছিলেন স্বীয় যুগের ইমাম ও প্রসিদ্ধ আলেম। তিনি ৪ রবি-উল-আউয়াল ৪৭৭ হিজরি বৃহস্পতিবার ইন্তেকাল করেন।


অলির সাক্ষাৎ


তিনি বলেন, আমি যৌবনের প্রারম্ভেই এলেম অন্বেষণের জন্য নিশাপুরে গমন করি। আমি শুনতে পেলাম শায়েখ আবু সাঈদ আবুল খায়ের এক মাস অবস্থান করবেন এবং ইলমী আলোচনা করবেন। আমি সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে তাঁর খেদমতে উপস্থিত হলাম। আমার দৃষ্টি তাঁর সুন্দর চেহারার প্রতি নিবন্ধ হলাে। আমি তাঁর ভক্ত হয়ে গেলাম। সূফীগণের মহব্বত আমার অন্তরে সুদৃঢ় হলাে। নুফহাতুল উস।


একদা আমি মাদ্রাসার কক্ষে বসা ছিলাম। শায়েখের সাথে সরাসরি দেখা করার উদগ্র বাসনা জাগ্রত হলাে আমার মনে। কিন্তু শায়েখের বাইরে। আসার সময় সুযোগ হচ্ছিল না। আমি ধৈর্যধারণ করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পারলাম না। আমি বাইরে চলে এলাম। চৌরাস্তায় এসে দেখলাম, শায়েখ বড় একটি দলের সাথে কোথাও যাচ্ছেন। আমি শায়েখের পিছনে পিছনে চলতে লাগলাম। তিনি একস্থানে গিয়ে থেমে গেলেন। আমি এক কোণায় বসে গেলাম। সেখান থেকে শায়েখ আমাকে দেখতে পাচ্ছিলেন।


কাওয়ালি শ্রবণ


একবার শায়েখ কাওয়ালি শ্রবণে লিপ্ত হয়ে পড়লেন। তাঁর বিশেষ অবস্থা সৃষ্টি হলাে। তিনি তার পরিধেয় বস্ত্র ছিড়তে শুরু করলেন। কাওয়ালি শেষ হলে ছেড়া টুকরােগুলাে একত্র করা হলাে। শায়েখ এক আস্তিন আঁচলসহ বের করে পৃথক করে রাখলেন। ডাক দিলেন, আবু আলী তুসী তুমি কোথায়? আমি উত্তর দিলাম না। ভাবলাম, শায়েখ এখন পর্যন্ত তাে আমাকে দেখতে পাননি। আর আমাকে তিনি চিনেনও না । হয়তাে তাঁর মুরিদানদের মধ্যে অন্য কোনো আবু আলীও থাকতে পারেন। শায়েখ দ্বিতীয় বার ডাক দিলেন। আমি চুপ থাকলাম। তৃতীয় বার ডাকলে লােকজন আমাকে বললেন, শায়খ আপনাকেই ডাকছেন। আমি উঠে শায়েখের সামনে গেলাম। শায়েখ আঁচল-আস্তিনের টুকরাটি আমাকে দিয়ে বললেন, এটাকে সংরক্ষণ করাে। আর তুমি আমাদের নিকট এই আস্তিন। এবং আঁচলের মতাে। আমি আদব ও বিনয়ের সঙ্গে বস্ত্রখণ্ডগুলো গ্রহণ করলাম। উপযুক্ত স্থানে রেখে দিলাম। ওটি থেকে প্রভূত উপকার লাভ করলাম। হৃদয় আলোকিত হলাে এবং একটি বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হলাে।


একজন মালিকের প্রতি আচরণ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন,


‘আপনি যদি আপনার শায়েখের প্রতি আপনার ভালোবাসায় সত্য হন তবে আপনাকে তার সাথে শ্রদ্ধা রাখতে হবে।’


আধ্যাত্মিক দৃষ্টি সম্পর্কে তিনি বলেছেন-


‘আরিফ (জ্ঞানের) জন্য এমন একটি সময় আসবে যখন জ্ঞানের আলো তার কাছে পৌঁছাবে এবং তার চোখ অবিশ্বাস্য অদৃশ্য দেখতে পাবে।’


‘যে ব্যক্তি শুনতে পাওয়ার ভান করে, কিন্তু পাখি, গাছ এবং বাতাসের প্রশংসা শুনতে পায় না, সে মিথ্যাবাদী।’


‘সত্যবাদীদের অন্তর উন্মুক্ত এবং তাদের শ্রবণশক্তি উন্মুক্ত।’


‘আল্লাহ তাঁর বান্দাদের খুশি করেন যখন তারা তাঁর অলিদের দেখেন।’ এর কারণ এই যে, নবী বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ঈশ্বরের জ্ঞানীর চেহারা দেখে, সে আমাকে দেখে’ এবং এছাড়াও, ‘যে আমাকে দেখে সে বাস্তবতা দেখেছে।’ সূফী উস্তাদগণ শেখের মুখের দিকে মনোনিবেশ করার অনুশীলনের নাম দিয়েছেন (তাসাউর), এবং এটি সেই অবস্থা পূর্ণ করার শেষ পর্যন্ত করা হয়।


‘যে ব্যক্তি মানুষের ক্রিয়াকলাপ দেখবে সে তার পথ হারাবে।’


‘যে ব্যক্তি গরীবদের সাথে ধনীদের সঙ্গ পছন্দ করে, আল্লাহ তাকে হৃদয়ের মৃত্যু প্রেরণ করবেন।’


ইমাম গাজ্জালী বর্ণনা করেন,


‘আমি শুনেছি যে আবুল হাসান আল-ফারমাদি বলেছেন, 'আল্লাহর নিরানব্বইটি গুণাবলী আল্লাহর পথে অনুসন্ধান কারীর বৈশিষ্ট্য ও বর্ণনায় পরিণত হবে।’


তিনি ৪৪৭ হি. সালে মারা যান এবং তাকে তুস শহরের উপকণ্ঠে ফরমাধ গ্রামে সমাহিত করা হয়। তিনি আবু ইয়াকুব ইউসুফ ইবনে আইয়ুব ইবনে ইউসুফ ইবনে আল-হুসাইন আল-হামাদানী (ক) এর কাছে সোনার শৃঙ্খলের গোপনীয়তাগুলি হস্তান্তর করেছিলেন।


লেখক: মৌলভী মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা ভুইয়া শিবপুরী
আল-ক্বাদলী-চিশতী, আল-নক্সবন্দী-মোজাদ্দেী-ওয়াইসী
পরিচালক, বিশ্ব আশেকান মজলিস পাক দরবার শরীফ
দুলালপুর, শিবপুর, নরসিংদী


বিবার্তা/রোমেল/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com