'ক্ষমার অযোগ্য' অপরাধের পথে হাঁটছেন জাহাঙ্গীর
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৩, ২১:৪৫
'ক্ষমার অযোগ্য' অপরাধের পথে হাঁটছেন জাহাঙ্গীর
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে আজমত উল্লা খানকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। সেই নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানের প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছিলেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচনের পর জেলা আওয়ামী লীগের সভায় পরাজয়ের কারণ হিসেবে জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধিতাকে উল্লেখ করা হয়। পরে তা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকেও জানানো হয়। যদিও দলের পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।


এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে মেয়র পদে দলের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন জাহাঙ্গীর আলম। মেয়রও নির্বাচিত হন। ২০২১ সালের শেষ দিকে জাহাঙ্গীর আলম মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করছেন- এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। এর প্রেক্ষিতে দল থেকে জাহাঙ্গীর আলমকে বহিষ্কার করা হয়। যদিও পরে ভবিষ্যতে দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করলে তা 'ক্ষমার অযোগ্য' হিসেবে বিবেচিত হবে এমন সতর্কবাণী দিয়ে তার বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে এবার যেন 'ক্ষমার অযোগ্য' সেই অপরাধের পথেই হাঁটছেন জাহাঙ্গীর আলম।


আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে দল তাকে মনোনয়ন না দিলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন তিনি। পাশাপাশি মায়ের নামেও একটি মনোনয়ন নেন। বাছাইয়ে জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করেছেন রিটার্নিং অফিসার। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।


গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের টিম মেম্বার দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে শেষ পর্যন্ত জাহাঙ্গীর আলম নির্বাচন করলে কী ব্যবস্থা নেয়া হতে পারে? জানতে চাইলে তিনি বিবার্তাকে বলেন, দলের শৃঙ্খলা পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার জন্য তাকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। আবারো শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করলে তা তো অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য। দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করলে দল যেটা করার সেটাই করবে।


দলীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী অন্তত দু'জন নেতা। আসন্ন গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও জাহাঙ্গীর সেই ঘনিষ্ঠদের গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে মনোনয়নপত্র কেনেন। তবে শেষ পর্যন্ত দলের মনোনয়ন না পেলেও তাকে মাঠে রাখতে চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের জাহাঙ্গীর ঘনিষ্ঠ নেতারা।


এর আগে ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে আনারস প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। যদিও শেষ দিকে এসে তিনি খানিকটা নিস্ক্রিয় হলেও নৌকার প্রার্থী পরিাজিত হয়। যার দায় এসে পড়ে জাহাঙ্গীর আলমের উপর। এবারও শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থাকার ব্যাপারে এখনো অনড় অবস্থানের কথা জানিয়েছেন জাহাঙ্গীর। তাই দলের নেতা-কর্মীদের মনে ২০১৩ সালের সেই শঙ্কা ভর করেছে। সেই কারণে নৌকা প্রতীকের বিজয় নিশ্চিতে দলের শক্ত অবস্থান দেখতে চান তারা।


দলীয় সূত্র জানায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাহাঙ্গীর আলমের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সেই ভিডিওতে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করতে শোনা যায় জাহাঙ্গীর আলমকে। এ ঘটনায় ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে আরো বেশকিছু অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২৫ নভেম্বর তাকে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এসময় সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা ও দলে ফিরতে কেন্দ্রে আবেদন করেছিলেন জাহাঙ্গীর আলম।


পরে আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগে গত বছরের ১৭ ডিসেম্বর গণভবনে অনুষ্ঠিত জাতীয় কমিটির সভায় সাংগঠনিক শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের কারণে অব্যাহতি প্রাপ্তদের ক্ষমা করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে মোতাবেক দলের সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত চিঠিতে ব্যক্তিগতভাবে জানিয়ে দেয়া হয়। ক্ষমা করা হলেও ওই চিঠিতে তাকে সতর্ক করে বলা হয়, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নিকট সাধারণ ক্ষমা প্রার্থনা করে আপনার প্রেরিত লিখিত আবেদন পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যতে সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ না করার শর্তে আপনার প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করা হলো। ভবিষ্যতে কোনো প্রকার সংগঠন বিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে, তা ক্ষমার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবে।


এদিকে রবিবার (৩০ এপ্রিল) গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন জাহাঙ্গীর আলমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেন রিটার্নিং অফিসার মো. ফরিদুল ইসলাম। গাজীপুরে নিউ টাউন সিটি ওয়্যার নামের একটি কোরিয়ান কোম্পানি অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড থেকে ১০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছিল। সেখানে জামিনদার হয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। নির্বাচন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি (ক্রেডিট ইনফরমেশন ব্যুরো) সেই ঋণের তথ্য দেয়। আর জাহাঙ্গীরকে সেখানে ঋণ খেলাপি দেখানো হয়। সেই তথ্যে মনোনয়নপত্র বাতিল ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। তবে মনোনয়নপত্র বাতিলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকে লড়াই করে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম।


দলীয় একটি সূত্র জানায়, অগ্রণী ব্যাংকের এই ঋণের ব্যাপারে নিজের মনোনয়নপত্র বাতিল হতে পারে এমন ধারণা থেকেই জাহাঙ্গীর তার মা জায়েদা খাতুনের নামে মনোনয়নপত্র দাখিল করিয়েছেন। রবিবার মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খান ও জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুনসহ ৯ জনের মনোনয়নপত্র বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। সূত্র বলছে, জাহাঙ্গীর আলম আপিলেও মনোনয়ন ফিরে না পেলে শেষ পর্যন্ত মা জায়েদা খাতুন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।


গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে রিটার্নিং অফিসারের বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল ২ থেকে ৪ মে, আপিল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আপিল নিষ্পত্তি ৫ থেকে ৭ মে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ৮ মে।


মনোনয়ন বাতিলের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমি নির্বাচন করার জন্য এসেছি। সব ফাঁকফোকর বন্ধ করে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলাম। তবে আমার সঙ্গে এমনটি করা হতে পারে বলে আঁচ করতে পেরেছিলাম। এখানে ক্ষান্ত হব না। আইনের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত লড়ব।


সোমবার (১ মে) বিকেল চারটায় জাহাঙ্গীর আলম বিবার্তাকে বলেন, আমার প্রতি অবিচার করা হয়েছে। আপিল করব, এখনো তো কাগজই পাইনি। আপিলে মনোনয়ন ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে আমি আশাবাদী।


দলের মনোনয়ন পাওয়া কে এই আজমত উল্লা


১৯৯৫ সালে টঙ্গী পৌর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর তিন মেয়াদে আজমত উল্লা দীর্ঘ ১৮ বছর দক্ষতা ও সফলতার সাথে টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩ সালে গাজীপুর সিটি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী ছিলেন তিনি। যদিও দলীয় কোন্দলের কারণে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন আজমত উল্লা। এরপর ২০১৮ সালে তাকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়। সর্বশেষ তিনি গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আজমত উল্লাহর বয়স, রাজনৈতিক ক্যারিয়ার বিবেচনায় তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়।


১৯৬৯ সালে তৎকালিন টঙ্গী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আজমত উল্লা খানের রাজনৈতিক জীবন শুরু। ’৭২ সালে ভাওয়ালগড় জেলা ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ছিলেন। এরপর ’৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ’৭৯ সাল থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত এক টানা টঙ্গী থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ’৯১ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ’৯৬ ও ২০০৩ সালে পরপর দুইবার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। ২০১৫ সালে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।


গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিবার্তাকে বলেন, আওয়ামী লীগ, ১৪ দল এবং সাধারণ শান্তিকামী মানুষ একেবারেই ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ পরিবারের মধ্যে সবাই খুবই ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগ যারা করে তারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি যেমন আপোষহীন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের প্রতিও আপোষহীন। বিশেষ করে প্রথম থেকেই আমাদের সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, নির্বাহী কমিটি সবাই নৌকার বিজয়ের জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করছে।


দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি জনগণ নিয়েই ব্যস্ত আছি। এই ব্যাপারে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। আমি আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী। কেউ দলের বাইরে গেলে আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র আছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অবশ্যই গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। কিছু মিডিয়ায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্যের মাধ্যমে এটি স্পষ্ট হয়েছে। এটা নিয়ে আমি মন্তব্য করতে চাই না।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এনএস

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com