৮ বছরেও খোঁজ মেলেনি আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের, প্রতীক্ষায় পরিবার
প্রকাশ : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:৩৬
৮ বছরেও খোঁজ মেলেনি আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের, প্রতীক্ষায় পরিবার
সোহেল আহমদ
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোরে তেজগাঁওয়ের বাসা থেকে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়েছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হান্নান। সেদিন হাঁটতে বের হয়ে হান্নান আর ফেরেননি। আট বছর আগে জিডি করলেও আজো তার খোঁজ মেলেনি। হান্নান বেঁচে আছেন কি নেই, তাও জানে না তার পরিবার। তবে এখনো হান্নানের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে তার পরিবার।


জানা যায়, নিখোঁজ হওয়ার সময় রাজধানীর তেজগাঁও কলেজে শিক্ষকতা করতেন হান্নান। ১৯৯৬ সালে তিনি কলেজে বাংলা বিভাগে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ২০১১ সালে কলেজের উপাধ্যক্ষের পদ সংখ্যা বাড়িয়ে তিনজন করা হয়। ওইসময় সৃষ্ট উপাধ্যক্ষ-২ পদে যোগ দেন হান্নান। তখন উপাধ্যক্ষ পদ সংখ্যা বৃদ্ধি ও নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা হয়। পরে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে উপাধ্যক্ষ পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর সেই বছরের ৭ ডিসেম্বর নিখোঁজ হন তিনি।


কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষের ভাষ্যমতে, নিখোঁজের সময় আব্দুল হান্নান মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন। সেই সময়ে কলেজের পক্ষ থেকে তার চিকিৎসায় সহযোগিতাও করা হয়েছে। তবে তার পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তিনি সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। কলেজের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকায় কলেজ প্রশাসনের কারো সাথে তার দূরত্ব থাকতে পারে।



জানা যায়, তেজগাঁও কলেজ হোস্টেল সুপারের বাসায় থাকতেন হান্নান। সেই বাসা থেকেই ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন। তারপর থেকেই নিখোঁজ। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, হান্নান নিখোঁজ হওয়ার পর থানায় জিডি করা হলেও তাকে খুঁজে বের করতে পুলিশের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।



তাদের দাবি, আব্দুল হান্নানের খোঁজ চেয়ে প্রতি বছর মানববন্ধন, স্মারকলিপি দিলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো ধরণের আশ্বাস বা সহযোগিতা আমরা পাই না। গত ৮ নভেম্বর ২০২২ জামালাপুরের সরিষাবাড়িতে মানববন্ধন করেছেন পরিবারের সদস্যরা ও এলাকাবাসী।


নিখোঁজের আট বছর হলেও এখনো হান্নান ফিরবে বলে আশায় পথ চেয়ে আছেন পরিবারের সদস্যরা। অন্তত কী হয়েছে, কোথায় আছে, কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে- জানতে চান তারা পরিবার।


পরিবারের সদস্যদের দাবি, নিখোঁজ আব্দুল হান্নান কলেজের অনিয়ম নিয়ে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। যার কারণে ওই সময়ে তার সাথে তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষের অনেকের সাথে বিরোধ তৈরি হয়। এছাড়া আব্দুল হান্নান উপাধ্যক্ষ পদে যোগ দেয়ার পর সেসময় কলেজে উপাধ্যক্ষ পদ সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তার নিয়োগ নিয়ে আদালতে মামলা হয়েছিল।



ওই সময়ে কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন প্রফেসর আবদুর রশীদ। তিনি বর্তমানে তেজগাঁও থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি। সেই সময়কার পরিস্থিতি কী ছিল? জানতে চাইলে আবদুর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, নিখোঁজের পর কলেজের পক্ষ থেকে জিডি করা হয়েছিল। জাতীয় পত্রিকায় হারানো বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। তৎকালীন কলেজ গভর্নিং বডির সভাপতি ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। ওনার সহযোগিতা নিয়ে তার খোঁজ পেতে র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে সবকিছুই করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব সব করা হয়েছে।



তিনি বলেন, সেই সময় (আব্দুল হান্নান) অসুস্থ ছিল। নিউরো প্রবলেম, মানসিক সমস্যা ছিল। অসুস্থ অবস্থায় দীর্ঘদিন কলেজ চিকিৎসা করেছে। চিকিৎসার সবকিছুর ডকুমেন্ট, এভিডেন্স কলেজে আছে। আমি তো এখন কলেজে নেই। কলেজের প্রশাসনিক শাখায় যোগাযোগ করলে সব পাবেন।


নিখোঁজ আব্দুল হান্নান ২০১৫ সালে উপাধ্যক্ষ পদ হারানোর পর সেই দায়িত্ব পান কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ আবদুর রশীদের ছোট ভাই হারুন অর রশীদ। বর্তমানে তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ্যের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর পাশাপাশি হারুন অর রশীদ জামালপুরের সরিষাবাড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও।


তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষের সাথে আব্দুল হান্নানের কী দূরত্ব ছিল? জানতে চাইলে হারুন অর রশীদ বিবার্তাকে বলেন, এগুলো ভিত্তিহীন কথাবার্তা। এগুলো স্টেটমেন্ট কারা দেয়? যারা দেয় তারা অভ্যন্তরীণ রাজনীতির অংশ হিসেবে বলে। তার স্ত্রী এখনো এই কলেজে চাকরি করে।


আব্দুল হান্নান নিখোঁজের পর থানায় জিডি করা হয়েছিল। তার অগ্রগতি জানতে চেয়ে গত ২২ জানুয়ারি হাইকোর্টে রিট করেছেন আব্দুল হান্নানের ভাই আইনজীবী আহসান উল্লাহ। তিনি বিবার্তাকে বলেন, মানুষ হয় মরে, না হয় মাইরা ফালায়। মরছে বা মেরে ফেলছে। লাশ পাওয়া গেলে কবর দিতাম। দোয়া-দরুদ পড়তাম। তার সন্তানেরা লিখতেও পারে না, পিতা জীবিত না মৃত।


তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডাকনামে তাকে চিনে। দুর্দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ছিল। দলের জন্য তার এতো ত্যাগ। এই মানুষটার কোনো হদিস নাই। ২৪ ঘন্টা, ৭২ ঘন্টায় পুলিশ অনেক কিছু বের করতে পারে। এটা কেন হয় না!


আহসান উল্লাহ বলেন, ভাই নিখোঁজের সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (আসাদুজ্জামান খান কামাল) তেজগাঁও কলেজের গভর্নিং বডির সভাপতি ছিল। তারই কলেজের একজন ভাইস প্রিন্সিপাল নিখোঁজ হলো, অথচ উনি কিছুই জানেন না- এটা কেমন কথা। বাংলাদেশের অন্য কলেজের হলে একটা বিষয় ছিল। পুলিশেরই মন্ত্রী উনি। আমরা জিডি করলাম, পুলিশ কী করল? কিচ্ছু করেনি, আমাদের প্রশ্ন এই জায়গায়।


স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক ছিলেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ছিলেন। কোনোদিন অর্থের লোভ করেন নাই। ভালো মানুষের কদর নাই। কিন্তু উনি নিখোঁজের পর রাজনৈতিকভাবেও কেউ যোগাযোগ করে না। কেউ না, এটাই কষ্ট আমাদের।


নিখোঁজ হান্নানকে খুঁজে বের করার বিষয়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা রয়েছে এমন দাবি করে তিনি বিবার্তাকে বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর জামালপুরের সরিষাবাড়ির গ্রামের বাড়িতে থানার এক এসআই আইসা বলতেছে, ‘স্যার এটা তো ভিন্নখাতে যাইতেছে, সে নাকি জঙ্গি হয়ে গ্যাছে’। আমি বলেছি, ঠিক আছে হয়ে গেলে হোক। এই নিউজই দেন গা। জননেত্রী তাকে ভালোভাবে চিনে।


নিখোঁজের সময় আব্দুল হান্নান মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন- কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষের এমন মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে আহসান উল্লাহ বলেন, এগুলো মিথ্যা কথা। এধরনের কিচ্ছু না। কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল পদ থেকে বাদ দিলে উনি আপসেট ছিলেন। বাদ পড়ার পর উনি বলেছিল, আমি সারাজীবন করলাম রাজনীতি আর আজ আমি হলাম ভিকটিম।


নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের ছোট ভাই মো. শহীদুর রহমান বিবার্তাকে বলেন, ২০১৫ সালে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর আমরা তার খোঁজ চেয়ে মানববন্ধন করেই যাচ্ছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি কিন্তু আমরা তাকে পাচ্ছি না। সরকার যদি একটু সদয় হয়, তাহলে হয়তো তাকে পাওয়া যাবে।


দীর্ঘদিন যাবত উনি নেই। আমরা অসহায়। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আওয়ামী লীগ নেতার খোঁজ নাই। কাউকে বলতেও পারি না- বলেন তিনি।


পরিবার সূত্রে জানা যায়, ওই সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন আব্দুল হান্নান। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন তিনি। পরে রাজধানীতে এসেও রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহ্বায়ক হান্নান পরে সহ-সভাপতি হয়েছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক পদ পান।


নিখোঁজ আব্দুল হান্নানের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন লায়েব উদ্দিন লাভলু। তিনি বিবার্তাকে বলেন, উনি ভালো ছাত্র ছিলেন, জনপ্রিয় ছাত্রনেতাও ছিলেন। এর পাশাপাশি উনি একজন ভালো মানুষ এবং ভালো শিক্ষক ছিলেন। ওনার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল। ওনাকে খুঁজে না পাওয়া খুবই হতাশার। এরকম একজন মানুষ মিসিং হয়ে গেল, পাওয়া গেল না বা পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের জন্য যেরকম কষ্টের আমরা যারা সহকর্মী ছিলাম তাদের জন্যও খুব বেদনার।


তিনি বলেন, আমি একজন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক কর্মী। আমরা তার জন্য কিছু করতে পারিনি। এটা আমরা মানি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আমরা কী করলাম? আমি মাঝেমধ্যে উনার পরিবারের খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করি- তবে আরও কিছু করতে পারলে ভালো হতো। ভাবির কাছেও কিছু বলতে পারি না, বাচ্চাদের দিকে তাকালেও খারাপ লাগে। মানুষ মারা যেতে পারে বা খুন করে ফেলতে পারে কিন্তু পাওয়া যাবে না এটা হবে কেন?


আব্দুল হান্নানের স্ত্রী আফরোজা সুলতানার বাবা সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আফরোজা বর্তমানে তেজগাঁও কলেজে শিক্ষকতা করছেন।


জানতে চাইলে আফরোজা সুলতানা বিবার্তাকে বলেন, নিখোঁজের অনেক বছর হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা এখনো তার অপেক্ষায় আছি। একটা তরতাজা মানুষ হারিয়ে গেলো। মরে গেলে তো অন্তত একটা মৃত্যুদিন পালন করতে পারতাম। কি হয়েছে কেউ জানে না, তাই সেটাও করতে পারি না। এই কষ্ট নিয়েই বেঁচে আছি।


তিনি বলেন, ওনার (আব্দুল হান্নান) সবসময় সীমিত চাহিদা ছিল। সারা জীবন আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে গেল। কিন্তু নিখোঁজের পর কেউ খোঁজ-খবরও নেয় না। শেরেবাংলা নগর থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিলাম,  কিন্তু আজো তার কোনো অগ্রগতি হলো না। কেউ বলতেও পারল না তিনি বেঁচে আছেন না-কি মারা গেছেন।  


আফরোজা সুলতানা বলেন, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি উপাধ্যক্ষ হিসেবে পদোন্নতি পান। ২০১৫ সালের শুরুর দিকে তার পদটা চলে যায়। তারপর থেকে তিনি চাকরিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এরপর ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিনের মতো সকালে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। সেই যে বেরিয়েছেন আর ফিরে আসেননি। তিনি ফিরবেন, সেই প্রতীক্ষায় আছি।


বিবার্তা/সোহেল/রোমেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com