শিরোনাম
নীল পাহাড়ের দেশে
প্রকাশ : ২৯ অক্টোবর ২০১৮, ১৮:২১
নীল পাহাড়ের দেশে
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৫ সালের কথা। তখন আমি চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দা। যে বাসায় থেকে পড়াশুনা করতাম সে বাসাটিতে থাকত বেশ ক'জন সাহিত্য ও সাংষ্কৃতিক কর্মী।


একদিন শুনলাম, ওই সাংষ্কৃতিক সংগঠনের উদ্যোগে একটি ভ্রমণের আয়োজন করা হয়েছে। আমি তাদের সংগঠনের কেউ নই, তবুও তারা আমাকে রেখে যেতে নারাজ।


শেষ পর্যন্ত আমিও আর রাজি না হয়ে পারিনি। ভ্রমণের দিনের জন্য সবাইকে এক মোড়কে মুড়িয়ে দেয়া হলো। সবার জন্য সংগঠনের লোগোযুক্ত সবুজ টি-শার্ট, টিসু, খাবার পানি, শুকনো খাবার, ভ্রমণের প্রয়োজনীয় পথ্য। আরো কত কি!


নির্ধারিত দিন ফজরের নামাজের পরপরই চট্টগ্রাম মহানগরীর দেওয়ানহাট মোড় থেকে আমাদের গাড়ি যাত্রা শুরু করলো। নগরী থেকে বের হয়ে রাউজান উপজেলা হয়ে আমরা যাচ্ছি বান্দরবানের দিকে। রাঙ্গুনিয়ায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) পার হবার পর আর রাস্তাঘাটের হিসেব রাখতে পারিনি। শুধু জানি যে আমরা বান্দরবান যাচ্ছি।


দু’ঘণ্টা পর আমাদের গাড়ি থেকে অবতরণ করার সময় হলো। আমরাও সবাই নেমে পড়লাম।


জায়গাটির নাম স্বর্ণ মন্দির। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত মন্দিরটি নাকি বান্দরবান সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই পাহাড়ে একটি লেক আছে। লেকের নাম দেবতা পুকুর। পুকুরটি ৩৫০ ফুট উচুতে হলেও সব মৌসুমেই পানি থাকে। বৌদ্ধ ভান্তেদের মতে, এটা দেবতার পুকুর, তাই এখানে সব সময় পানি থাকে।


আমরা উঠতে থাকলাম পাহাড়ের চূড়ায়। পথ যেন শেষই হয় না। পুরো শরীর ঘেমে গেছে। বহু সাধনার পর স্বর্ণ মন্দিরের দেখা পেলাম। এবার নাকি টিকেটও নিতে হবে। আমাদের সবার হয়ে একজনই সব টিকেট নিলেন।


ঘুরে ঘুরে দেখলাম প্রায় এক ঘণ্টা। আবার কিছু স্থানে যেতে ও দর্শন করতে আমাদের বারণও করা হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানের পর্যটন কেন্দ্রগুলোর অন্যতম বুদ্ধ ধাতু জাদি ক্যাং। এই জাদিটি এখন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান। এটি স্বর্ণমন্দির নামে পরিচিত পেলেও স্বর্ণনির্মিত নয়, যদিও দেখতে সোনার মতোই।


বান্দরবানের যেকোনো উঁচু ভবন বা পাহাড়ের চূড়া থেকে মন্দিরটি স্পষ্ট দেখা যায়। মূলত সোনালি রঙের জন্যেই এটির নাম হয়েছে স্বর্ণমন্দির। দেখতেও অপরূপ। ভিতরে ছোট-বড় সব মূর্তি। সেসব মূর্তিও সোনালি।


মন্দিরের উপরে খাবারের দোকানও আছে, যদিও প্রত্যেক খাবারের দাম দ্বিগুণ।


স্বর্ণমন্দির থেকে আমরা যাত্রা করলাম বান্দরবান সদরের উদ্দেশে। সেখানে একটি রেস্তোরায় দুপুরের খাবার সেরে পাশের মসজিদে যোহরের নামাজ আদায় এবং একটু বিশ্রাম করে শক্তি সঞ্চয় করে নিলাম।


মেঘলা
বিশ্রাম শেষে আবার যাত্রা শুরু। এবার গন্তব্য মেঘলা।


আবার ছুটে চলছি আমরা। মাইক্রোবাসের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে অপরূপ ফল, সবজি ও হরেক রকম ফসলের সমাহার, আর পাহাড়ী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভিন্ন রকম জীবনযাত্রা।


দেখতে দেখতে পৌছে গেলাম মেঘলায়। সেখানেও টিকেট নেয়ার পালা। টিকেট নিয়ে ঢুকে পড়লাম মেঘলার অপরূপ সৌন্দর্য্যের গভীরে। সেখানে পাহাড়ের পদতলে অপরূপ লেক আর লেকের ওপর একাধিক ঝুলন্ত ব্রীজ। উপরে উঠে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। বিশাল আকৃতির লেকের পরে ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড়। যে কারণে বাইরে চলাচলকারী যানবাহনের শব্দ শ্রবণেন্দ্রিয়র প্রশান্তিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।


মেঘলায় আরো আছে শিশুপার্ক, নামাজের জায়গা।


এই লেকে দেখতে পাবেন নানান জাতের জলচর পাখির খেলা। মাথার উপর গাছের ডাল পানি ছুঁই ছুঁই করছে। সেসব গাছে কাঠবিড়ালীর তিড়িংবিড়িং খেলা ও অসংখ্য পাখির কলতান। নৌকায় চলার সময় দেখা যাবে, মাথার ওপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলছে ক্যাবল কার। যাতায়াত মিলিয়ে ১৬০০ ফুট দীর্ঘ এ ক্যাবল কার পানির ২০০ ফুট উপরে দিয়ে চলার সময় শূণ্যে ভেসে থাকার দারুণ এক অনূভুতির সৃষ্টি হয়। ক্যাবল কার কারো কারো মনে কিঞ্চিত ভীতিও সঞ্চার করতে দেখেছি।


পিকনিক স্পটের জন্যও অতুলনীয় মেঘলা। সেখানেও আমরা সময় কাটিয়েছি এক ঘণ্টার চেয়ে বেশি।


নীলাচল
মেঘলা থেকে বিদায় নিয়ে যাত্রা শুরু করলাম নীলাচলের দিকে। নীলাচল বান্দরবান জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে টাইগারপাড়ার পাহাড়চূড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে আকর্ষণীয় এই পর্যটন কেন্দ্র।


দেখে মনে হয়েছিল চির সুখের আবাস যে জান্নাত আছে তা বুঝি দেখতে এমনই হবে। ভারতের দার্জিলিংয়ে যারা ঘুরে এসেছেন তারা নীলাচলকে ''বাংলার দার্জিলিং'' বলে থাকেন। সেখানে রয়েছে শুভ্রনীলা, ঝুলন্ত নীলা, নীহারিকা ও ভ্যালেন্টাইন পয়েন্ট নামে আকর্ষণীয় বিশ্রামাগার। কমপ্লেক্সের মাঝে বাচ্চাদের খেলাধুলার ও বসার ব্যবস্থা রয়েছে। পাহাড়ের ঢালে ঢালে সাজানো হয়েছে এ জায়গাগুলো। ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে সামনের পাহাড়ের দৃশ্যও ভিন্ন ভিন্ন রকম। একটি থেকে আরেকটি একেবারেই আলাদা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬শ’ ফুট উঁচু এই জায়গায় বর্ষা, শরৎ আর হেমন্ত তিন ঋতুতে ছোঁয়া যায় মেঘ। তবে শীতকাল থাকার কারণে আমরা ছুঁতে পারিনি।


নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহর একনজরে দেখা যায়। স্পষ্ট দেখা যায় স্বর্ণমন্দিরও। মেঘমুক্ত আকাশে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের অপূর্ব দৃশ্য নীলাচল থেকে পর্যটকেরা উপভোগ করতে পারেন।


নীলাচলের বাড়তি আকর্ষণ হলো এখানকার নীল রঙের রিসোর্ট। নাম নীলাচল স্কেপ রিসোর্ট। সাধারণ পর্যটকদের জন্য এ জায়গায় সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার অনুমতি আছে। আমরাও এর চেয়ে বেশি সময় থাকতে পারিনি। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে সাবাইকে সংকেত দিয়ে বের করে দেয়া হলো। ইচ্ছে হচ্ছিলো, বাকি জীবনটা এখানেই কাটিয়ে দিই। কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে কি আর পূরণ হয়?


লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও উপস্থাপক।


বিবার্তা/কামরুল/হুমায়ুন

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com