দারা গাঁও। পূর্ব হিমালয়ের অন্যতম সেরা ভিউ পয়েন্ট এই গ্রাম। অনেকেই এই গ্রামকে বলেন কাঞ্চনজঙ্ঘার ব্যালকনি। এখানকার হোমস্টের জানলা থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার গোটা রেঞ্জ। চোখ ভরে যাবে নীচে সর্পিল গতিতে বয়ে চলা তিস্তারও।
রাতে কালিম্পং শহরের আলো যেন তারাভর্তি আকাশকে নামিয়ে আনে পাহাড়ের গায়। দারাগাঁও গ্রামটি আরও বিখ্যাত হয়েছে সিঙ্কোনা গাছের জন্য। পাহাড়ি গ্রামের পথের ধারে সারি দিয়ে রয়েছে সিঙ্কোনা গাছ। যার ছাল থেকেই তৈরি হয় কালাজ্বরের ওষুধ কুইনাইন।
খুব বেশি ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত হতে না চাইলে সপ্তাহান্তে ছুটি কাটানোর আদর্শ ঠিকানা এই গ্রাম। ট্রেনে এনজেপি বা বিমানে বাগডোগরা। সেখান থেকে সড়কপথে দারা গাঁও। তিস্তা বাজার অবধি এলে দারা গাঁও হোমস্টে থেকেই গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা আছে।
পাইনঘেরা পাহাড়ি গ্রাম। ছবির মতো কাঠবাড়ি। দু’দিকের দেওয়ালেই জানলা। একদিকের জানলা খুলে উঁকি মারলেই নিচে এঁকেবেঁকে চলেছে তিস্তা। আর, অন্যদিকের জানলার বাইরে আকাশে টাঙানো কাঞ্চনজঙ্ঘা।
কালিম্পং যাওয়ার আগেই এককালের খরস্রোতা তিস্তা। একের পর এক ড্যামের বাধা পেয়ে আজ বেশ শান্ত। তবু, এই নদীর মায়া কাটানো কঠিন। তিস্তার মায়া কাটাতে না পেরেই তো ছুটে এসেছিল রঙ্গিত। এসে বুক ভরে জল দিয়েছিল তৃষ্ণার্ত তিস্তাকে। সেইসব পাহাড়ি উপকথার উল বুনতে বুনতেই আপনাদের গাড়ি বাঁক নেবে কালিম্পঙের পথে।
বর্ষায় প্রাণবন্ত সুন্দরবনের পিয়ালি দ্বীপ
একটা ছবির মতো গ্রাম। এখনো পর্যটকদের ভিড় তেমন বাড়েনি। ফলে, হিমালয়ের সবুজ অনেক সজীব, কুমারী এখানে। হাতে গোনা সাত-আটটা হোমস্টে। কাঠের খেলনাবাড়ি যেন। ভিতরটা অদ্ভুত সুন্দর। আর, বাইরে? সবুজ ঢেউ খেলানো একচিলতে ঘাসজমি। দু’পাশে মাথা উঁচু পাইন ও অন্যান্য হিমালয়ান বৃক্ষের বন। গ্রামেই চাষ হচ্ছে এলাচ, সরষে। কোনো রাস্তাই সোজা নয় এই গাঁয়ে। প্রতিটি কোণ থেকেই নিসর্গের এক এক রূপ। নেশা লাগবে।
তুষার-ধবল শৃঙ্গ
দারা গাঁওয়ে বিছিয়ে রয়েছে কমলালেবুর বাগান। শীত এলে গাছেরা গর্ভবতী হয়। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে গেলে গাছভর্তি কমলালেবু আর পাহাড় উজিয়ে আসা কমলা রঙের রোদ দেখে হয়তো ফিরতে ইচ্ছেই করবে না আর পোড়া শহরে। সেই অনিচ্ছেকেই আরো গাঢ় করবে সোমদাথ তামাং-এর আতিথেয়তা। এখানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা একইসঙ্গে। ক’দিনের অতিথি যেন। ঘুম থেকে উঠলেই গরম চা, তারপর প্রাতঃরাশ। ফের চায়ের আব্দারেও সামান্য বিরক্তির রং লাগে না এই সরল মানুষদের মনে। আকাশ উজাড় করে হাসেন এরা। কাঞ্চনজঙ্ঘায় তখন সোনা রোদ ধরেছে।
সবুজে ঘেরা পাহাড়ি পথ
পূর্ব হিমালয়ের অন্যতম সেরা ভিউ পয়েন্ট এই গ্রাম। কেউ কেউ বলেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার ব্যালকনি। ঘরের জানলা থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘার গোটা রেঞ্জ। তাছাড়া, নিচে সর্পিল গতিতে বয়ে চলা তিস্তার দেখাও মিলবে সহজেই।
রাতে, কালিম্পং শহরের আলো যেন তারাভর্তি আকাশকে নামিয়ে আনে পাহাড়ের গায়। রাভাংলা, দার্জিলিং, গ্যাংটক-সিকিম হাইওয়েও আলো পাঠায় এই গ্রামে। ঝিকিমিকি সেই আলোকে দূরে রেখেই কনকনে ঠান্ডায় এক অদ্ভুত তাপে জড়িয়ে থাকে হোমস্টে লাগোয়া রান্নাঘর। সেখানে কাঠের উনুনে তখন তৈরি হচ্ছে রুটি, মাংস, ডাল।
ফুলের সমারোহ
দারা গাঁও থেকে পায়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায় দারা বাংলোয়। শতাব্দীপ্রাচীন এই বিলিতি বাংলোর গড়নে টিউডর স্থাপত্যের মাধুর্য। চাইলে থাকতে পারেন এই বাংলোতেও। বাংলোর পাশে সবুজ ঢেউ খেলানো লন, কমলালেবু গাছ। এই গ্রামে গেলে আর গাড়ি চড়ে ঘুরে বেড়াতে মন চাইবে না। পায়ে হেঁটেই ঘুরে আসা যায় সিলেরি গাঁও, রামিতে ভিউ পয়েন্ট। পায়ে জোর থাকলে নিচে নেমে চলে আসতে পারেন তিস্তার কোলেও। তবে, ওঠার সময় অনেকটা চড়াই ভাঙতে হবে।
উত্তাল হইচই, ক্যাম্প ফায়ারের জায়গা নয় এই গ্রাম। হয়তো গ্রামের সহজ-সরল-মুখচোরা মানুষগুলো বারণ করবে না আপনাকে। তবু, এই গ্রামের নির্জনতাকে ভাঙতে ইচ্ছে করবে না আপনার। কেমন যেন ঢিমেতালের ঢেউয়ের মতো জীবনযাপন গ্রামের মানুষদের। সেখানে কিছুদিন মিশে গেলে ক্ষতি কী? পাখি দেখার নেশা থাকলেও হতাশ হবেন না। হিমালয়ান পাখিদেরও স্বর্গরাজ্য এই গ্রাম। আর, সন্ধে নামতেই হয়তো দেখবেন মেঘের চাদর বিছনো রয়েছে আকাশে আর তার ওপরে ভাসছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। বিভ্রম মনে হবে। ঘোর কাটতে চাইবে না।
মহিমান্বিত হিমালয়
এই গ্রাম আপনাকে ঘিরে ধরবেই মায়ায়। কচি কচি পাহাড়ি ছেলে-মেয়েগুলো, কোঁচকানো চামড়ার বয়স্ক সদাহাস্য মুখগুলো শহুরে জটিলতার স্মৃতি ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চাইবে মাত্র দু-তিন দিনেই। ফেরার সময় যত এগিয়ে আসবে, আকাশের কাঞ্চনজঙ্ঘা আর সেই সুদূর বরফের দেশ থেকে ভেসে আসা হাওয়ারা আপনাকে বলবে অন্য এক পৃথিবীর গল্প। এ জন্মে আর ঠিকানা বদল সম্ভব না, কিন্তু, সেই ডাক ফেরাবেন কী করে?
এই এত্তো মনখারাপ আর বিস্ময় নিয়েই অতএব আপনি ফেলে আসবেন দারা গাঁও। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানেই…
কীভাবে যাবেন
ট্রেনে এনজেপি বা বিমানে বাগডোগরা। সেখান থেকে সড়কপথে দারা গাঁও। তিস্তা বাজার অবধি এলে দারা গাঁও হোমস্টে থেকেই গাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা আছে।
কোথায় থাকবেন
একতা হোমস্টে-সহ কয়েকটা হোমস্টে আছে। যোগাযোগঃ ৯৯৩৩৪৪৭৬১৯। চাইলে থাকতে পারেন দারা বাংলোতেও।
কখন যাবেন
সেরা সময় অক্টোবর থেকে এপ্রিল। শীতে গেলে কমলালেবু ভর্তি গাছের শোভা মুগ্ধ করবেই।
কোথায় কোথায় যাবেন
চাইলে গাড়িতে ঘুরে আসতে পারেন কালিম্পং, লাভা, লোলেগাঁও, পেডং। এছাড়াও রয়েছে একাধিক ট্রেক রুট। স্থানীয় গাইডদের সাহায্যে বেরিয়ে পড়ুন ইচ্ছে আর সাধ্যমতো।
কী কী করবেন না
আমরা সমতলের শহুরে মানুষরা পাহাড়কেও বড়ো দূষিত করে ফেলি। দারা গাঁও আজও নির্জন, স্নিগ্ধ। সেখানে অতিরিক্ত হই হল্লা, ক্যাম্প ফায়ার, প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা মানে এই পরিবেশকে বিষিয়ে দেওয়া। এটুকু মাথায় রাখলেই হল।
বিবার্তা/এসবি
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]