শিরোনাম
দুসরা ‘ঈদ’ আত্মত্যাগের বিনিময়েই হয় কোরবানি
প্রকাশ : ১২ আগস্ট ২০১৯, ১৫:৪৮
দুসরা ‘ঈদ’ আত্মত্যাগের বিনিময়েই হয় কোরবানি
নজরুল ইসলাম তোফা
প্রিন্ট অ-অ+

‘ঈদ' আরবি শব্দ। আসলে এর অর্থটাই হচ্ছে ফিরে আসা। এই ফিরে আসাকে ঈদ বলা হয় এ কারণে যে, মানুষ বারংবার একত্রিত হয়ে সাধ্য মতো যার যা উপার্জন, তা অনেক খুশিতে আল্লাহ পাকের দরবারে সওয়াবের আশায় আনন্দ-উৎসব করে।


বলা যায়, সওয়াবের পাশাপাশি একে-অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ দূর হয়। সুতরাং ঈদকে দ্বারাই মহান আল্লাহ তার বান্দাকে নিয়ামত কিংবা অনুগ্রহে ধন্য করে থাকেন। বারংবারই তার ইহসানের নৈতিক শিক্ষা প্রদান করে। আল্লাহ তায়ালার প্রতিই ভালোবাসা লাভের উদ্দেশ্যে কিছু বিসর্জন দেয়াকে কোরবানি বলা যেতে পাবে। সুতরাং আর্থিকভাবেই সামর্থ্যবান ব্যক্তির ওপরই কোরবানির হুকুম পালন ওয়াজিব হয়েছে। তাই সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও কেউ যদি কোরবানির মতো ইবাদত থেকে বিরত থাকেন কিংবা কোরবানি না দেন, তাহলে সেই ব্যক্তি অবশ্যই গুনাহগার হবেন।


আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যের মধ্যে কোরবানি একটি বিশেষ আমল। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে মহান আল্লাহ পাক মুসলিম উম্মাহর জন্য যেন ‘নিয়ামত' হিসেবেই ঈদ দান করেছেন। হাদিসে বর্ণিত রয়েছে-রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় যখন আগমন করেন, তখন মদিনাবাসীর দুটি দিবস ছিল। সে দিবসে তারা শুধুই খেলাধুলা করত।


আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত- রাসুলুল্লাহ (সা.) গুরুত্বের সঙ্গে প্রশ্ন করেছিলেন এমন দুদিনের তাৎপর্যটা কী? মদিনাবাসী উত্তর দিলেন- আমরা জাহেলি যুগে এ দুদিনে খেলাধুলা করে কাটাতাম। তখন তিনি বলেছিলেন, আল্লাহ রাববুল আলামিন এ দুদিনের পরিবর্তে তোমাদের এর চেয়েও শ্রেষ্ঠ দুটি দিন দিয়েছেন। তা হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর ‘ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতর।’


সুতরাং শুধু খেলাধুলা বা আমোদ-ফূর্তির জন্যই যে দুদিন ছিল, তাকে পরিবর্তন করেই সৃষ্টিকর্তা ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিনকেই দান করেছিলেন। সমগ্র উম্মত যেন ঈদের দিনেই মহান আল্লাহর শুকরিয়া, জিকির এবং তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনার সঙ্গে শালীনতায় আমোদ-ফূর্তি ও নিজস্ব সাজ-সজ্জা কিংবা খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারেও সংযম হতে পারে। কথাগুলো বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ পুস্তকে ইবনে জারিরের (রা.) অনেক বর্ণনায় উঠে এসেছে।


জানা দরকার, দ্বিতীয় হিজরিতে প্রথম ঈদ করেছিলেন রাসুলুল্লাহ (রা.)। তাই ইসলাম ধর্মে ‘বড় দুটি' ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি ঈদুল আজহা। এ দেশে এমন উৎসবটিকে আবার অনেকে কুরবানির ঈদ বলেও সম্বোধন করেন। ‘ঈদুল আজহা' মূলত ‘আরবি বাক্যাংশ'। এর অর্থ দাঁড়ায় ‘ত্যাগের উৎসব।'


এর মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘ত্যাগ করা'। এ দিনটিতে মুসলমান তাদের সাধ্যমত ধর্মীয় নিয়মানুযায়ী উট, গরু, দুম্বা, ছাগল কোরবানি কিংবা জবাই দিয়ে থাকে। ঈদুল আজহার দিন যেন ঈদের নামাজের আগে কিছু না খেয়ে নামাজ আদায় করে। তারপর কোরবানি দিয়েই গোশত খায়। এটাই সুন্নাত এবং বিশ্বনবী তাই করেছিলেন।


বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত রয়েছে, নবী কারিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে ঈদগাহে যেতেন না। আবার ঈদুল আজহার দিন তিনি ঈদের নামাজের আগেও খেতেন না। এমন ‘তাকওয়ার সহিত ১ কোরবানি' আদায় করা দরকার। আবার এও জানা যায়, কোরবানি দেয়া পশুর রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ তায়ালা সেই কোরবানি কবুল করে নেয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন।


এখন এ ঈদ আনন্দের বাস্তবতার দিকে আসা যাক। ‘ঈদ' শব্দটিকে যখন মানুষ প্রথম বুঝতে শিখে তখন তাদের শিশুকাল থাকে এবং সেসময় তারা বড়দের উৎসাহে প্রথম ঈদের আনন্দকে উপভোগ করে। তারা সারা রাত না ঘুমিয়ে খুব ভোরে নতুন সুগন্ধি সাবান দিয়ে গোসল করে। তারপর ঈদের নামাজের জন্যই আতর, সুরমা এবং নতুন নতুন জামা-কাপড় পরে বাবা-ভাইদের নিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গেই তারা প্রিয় ঈদগাহে যেত। আর ঈদগাহে যে পরিবেশ হয়ে ওঠত সেটিই মূলত ঈদের খুশি।


ঈদগাহের মাঠে পাঁয়ে হেঁটে যাওয়া বা আসার মজাই আলাদা। জানা যায়, আলী (রা.) এর বর্ণনা মতে সুন্নত হলো ঈদগাহে পাঁয়ে হেঁটেই যাতাযাত করা। সুতরাং উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করাও ভালো হয়।


উদাহরণ স্বরূপ নবী কারিম (সা.) ঈদগাহে এক পথে গিয়ে আবার অন্য পথেই ফিরেছেন। ‘ঈদুল আজহার’ তাৎপর্য হলো ইসলাম ধর্মের নানা বর্ণনায় যা পাওয়া যায়- মহান আল্লাহ তায়ালা ইসলাম ধর্মেরই এক নবী হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) স্বপ্নে তার প্রিয় বস্তুকেই আল্লাহ তায়ালাকে খুশির উদ্দেশ্যেই কোরবানির নির্দেশ দিয়েছিলেন।


সেই আদেশেই হজরত ইব্রাহিম (আ.) তার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি করার জন্যেই প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু তার সৃষ্টিকর্তা তাকে তা করতে বাধা দিয়ে ছিলেন। সেখানেই নিজ পুত্রের পরিবর্তেই একটি পশু কুরবানি হয়েছিল এবং তা হয়েছিল সৃষ্টিকর্তার নির্দেশেই।


এ ঘটনাকে স্মরণ করেই বিশ্বের মুসলিম ধর্মাবলম্বীরা মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনে প্রতি বছর ঈদুল আজহা দিবসটি পালন হয়ে আসে। হিজরির বর্ষ পঞ্জির হিসাবেই জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকেই শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরেই যেন ঈদুল আজহা চলে। হিজরি চন্দ্র বছরের গণনা অণুযায়ী, ‘ঈদুল ফিতর’ এবং ঈদুল আজহার মাঝে দুইমাস ১০ দিনের ব্যবধানেই হয়ে থাকে। আর দিন হিসেবে তা সর্বোচ্চ ৭০ দিনও হতে পারে।


জানা দরকার, ঈদুল আজহার দিন থেকেই শুরু করে পরবর্তী দুদিন পশু কুরবানির জন্যই নির্ধারিত থাকে। বাংলাদেশের মুসলমানরা সাধারণত গরু বা খাসি কোরবানি দিয়ে থাকে। এক ব্যক্তি একটিমাত্র গরু, মহিষ কিংবা খাসি কুরবানি করতে পারে। তবে গরু এবং মহিষের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৭ ভাগে কোরবানি করা যায় অর্থাৎ দুই, তিন, পাঁচ বা সাত ব্যক্তি একটি গরু, মহিষ কোরবানিতে শরিক হলে ক্ষতি নেই। তাই এ দেশে সাধারণত কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে ১ ভাগ গরিব-দুস্থদের মধ্যে; ১ ভাগ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে এবং এক ভাগ নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখা উচিত।


ইসলামের আলোকে জানা যায়, এ ঈদের মাংস বিতরণের জন্য কোনো ধরনের সুস্পষ্ট হুকুম নির্ধারিত নেই। এমনকি কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থগুলো দান করে দেয়ার নির্দেশ রয়েছে। কোনো মুসাফির অথবা ভ্রমণকারীর ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। আবার ঈদুল আজহার ঈদের নামাজের আগেই ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের পশু কোরবানি সঠিক হয় না।


জানা যায়, কোরবানির প্রাণী খাসি বা ছাগলের বয়স কমপক্ষে ১ বছর ও ২ বছর বয়স হতে হয় গরু কিংবা মহিষের বয়স। নিজ হাতে কোরবানি করাই উত্তম। এ কোরবানির প্রাণীটি দক্ষিণ দিকে রেখে কিবলামুখী করে খুবই ধারালো অস্ত্র দ্বারা অনেক স্বযত্নে মুখে উচ্চারিত ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে জবাই করাটা ইসলাম ধর্মের বিধান।


সুতরাং এই ‘ঈদ' আনন্দে ভরে উঠুক প্রতিটি প্রাণ। সবাই সবার প্রতি 'ভালোবাসা ও আনন্দ' নিয়ে একসঙ্গেই কাজী নজরুল ইসলামের ঈদুল আজহার গান অন্তরে ধ্বনিত করি- ‘ঈদুল আজহার চাঁদ হাসে ঐ, এলো আবার দুসরা ঈদ, কোরবানি দে কোরবানি দে, শোন খোদার ফরমান তাকিদ।
এমনি দিনে কোরবানি দেন, পুত্রে হজরত ইব্রাহিম।
তেমনি তোরা খোদার রাহে, আয়রে হবি কে শহীদ।



লেখক : নজরুল ইসলাম তোফা, টিভি ও মঞ্চ অভিনেতা, চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিস্ট এবং প্রভাষক।



বিবার্তা/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com