শিরোনাম
জেলহত্যার প্রতিবাদে প্রথম হরতালের স্মৃতি
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০১৯, ২২:০৫
জেলহত্যার প্রতিবাদে প্রথম হরতালের স্মৃতি
ড. মুহাম্মদ সামাদ
প্রিন্ট অ-অ+

উনিশ’শ পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সপরিবারে নিহত হন। পরবর্তী টালমাটাল সময়ে অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানের মধ্যে ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে অন্তরীণ অবস্থায় জাতীয় চার নেতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এই জাতীয় চার নেতা হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান। তেশরা নভেম্বর বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘জেলহত্যা দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।


মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে মুজিবনগরে গঠিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমেদ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। আর এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


কারা আইন ও সকল রীতি-নীতি লঙ্ঘন করে কারাগারের অভ্যন্তরে সংঘটিত এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘ একুশ বছর জেলহত্যার বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে। আট বছরের বেশি সময় বিচারকাজ চলার পর বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করার দল বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর এই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। নিম্ন আদালত কর্তৃক দেয়া মামলার রায়ে ২০ জন আসামির মধ্যে ১৫ জনকে শাস্তি দেয়া হয়। এদের মধ্যে তিন সাবেক সামরিক কর্মকর্তার ফাঁসি এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল যা ছিল মূলত বিচারের নামে প্রহসন। বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর পুনঃতদন্তের মাধ্যমে জেলহত্যা মামলার সঠিক রায়ও উচ্চতর আদালতে সম্পন্ন হয়েছে। এটি এক দীর্ঘ সংগ্রামের ফসল। সেই ইতিহাসের একটি ছোট্ট অংশ হিসেবে জেলহত্যার প্রতিবাদে ১৯৮০ সালে দেশব্যাপী আহ্বান করা আওয়ামী লীগের হরতালের সামান্য স্মৃতিচারণ করাই আমার এই ছোট নিবন্ধের প্রতিপাদ্য।


স্কুল জীবন থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি কবিতা লেখা, আবৃত্তি আর প্রতিটি মিছিল-সমাবেশে অংশ নেয়া ছিল আমার কাছে মহৎ কর্তব্যের মতো। বঙ্গবন্ধু আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। তাই বিনা মেঘে ভয়ংকর বজ্রপাতের মতো বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আমার বাবা-মা আমাকে নিয়ে সব সময় উদ্বিগ্ন থাকতেন।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ড. মুহাম্মদ সামাদ


আমাদের গ্রামের বাড়ি জামালপুরের সরিষাবাড়ী থেকে বিকেল তিনটার ট্রেনে যাত্রা করে রাত এগারটার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলে পৌঁছতাম। হলে পুলিশ প্রবেশের অনুমতি না থাকলেও ছাত্রদের মধ্যে তাদের পেইড সোর্স ছিল। ফলে, সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার দুঃশাসনকালে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দাবিতে ‘মুজিব হত্যার পরিণাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’ শ্লোগান দিয়ে কিংবা কোনো রাজনৈতিক নির্যাতনের প্রতিবাদে বা বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তির দাবিতে মিছিল বের করা হতো সাধারণত রাত ১১টার পর।


অনেক সময় সাধারণ ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণের লক্ষ্যে রাজনৈতিক ঘটনার সঙ্গে ডাইনিং-এর সাবসিডি বৃদ্ধি বা লাইব্রেরিতে বই বাড়ানোর দাবি জুড়ে দেয়া হতো শ্লোগানে। আমি যে প্রায় নিয়মিত মিছিলের মুখ, তা আমাদের এলাকার অন্য ছাত্রদের কাছ থেকে আমার মা-বাবা জেনে ফেলেছিলেন।


ফলে প্রতিবারই ছুটি শেষে বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার সময় মা আমার দু’হাত তার নিজের মাথার ওপর নিয়ে শপথ করাতেন- ‘বাবা, আমার মাথায় হাত দে। বল, আর কোনো দিন মিছিলে যাবি না।’আমি মা’র কথা শেষ হওয়ার আগেই ঝটপট শপথ করে রেলস্টেশনের দিকে হাঁটা দিতাম এবং অনেক দিনই হলে ফিরে রুমে ব্যাগ রেখেই মিছিলে যোগ দিতাম।


১৯৮০ সালের ঘটনা। সামরিকজান্তা জেনারেল জিয়া তখন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি থেকে দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির লেবাস গায়ে চাপিয়েছেন। ২ নভেম্বর বিকেলে প্রায় প্রতিবারের মতো বাড়ি থেকে ঢাকা আসার সময় মায়ের মাথায় হাত রেখে মিছিলে না-যাওয়ার শপথ করে রাতে হলে ফিরলাম।


ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানকে হত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে ৩ নভেম্বর হরতাল আহ্বান করা হয়। যদ্দুর মনে পড়ে, জেলহত্যার প্রতিবাদ ও বিচারের দাবিতে পঁচাত্তরের পরে সেটি ছিল আওয়ামী লীগের প্রথম হরতাল।


আমরা জহুরুল হক হলের ছাত্ররা আগের রাতে ঘুমাতে যাইনি। হলের গেট থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত পুলিশ আর সাদা পোশাকের ডিজিএফআই-এর লোকদের শশব্যস্ত আনাগোনা। হল গেটের একশ গজের মধ্যে ওরা গিজগিজ করছে। এই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তখনও নাগরিক অধিকারের প্রতি এতটা অশ্রদ্ধাশীল ছিল না।


সকাল সাতটার দিকে আমরা মিছিল নিয়ে রাজপথে নামলাম। সূর্যসেন ও জগন্নাথ হলসহ আরো দু'একটি হল থেকে ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিল। মিছিল কলাভবনের সামনে দিয়ে টিএসসি-বাংলা একাডেমী হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। আমাদের গন্তব্য প্রেসক্লাব।


মিছিল যখন কার্জন হলের সামনে, তখন বিপরীত দিক থেকে দুটি জিপে করে ‘উচ্ছৃঙ্খল’ কিছু যুবক আমাদের দিকে লাঠি-হকিস্টিক-ছোরা উঁচিয়ে ‘মুজিববাদী গুণ্ডারা হুশিয়ার সাবধান’শ্লোগান দিতে দিতে চলে গেল। ‘সন্ত্রাসী’ শব্দটি তখনো এতো কদর পায়নি বাংলা ভাষায়!


আমাদের মিছিলটি প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তা দিয়ে শ্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছিল। মিছিলের পুরোভাগে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জননেতা আবদুর রাজ্জাক, সাংগঠনিক সম্পাদক তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মনির সঙ্গে আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক সৈয়দ আহমদ (যার কাছ থেকে ডিক্টেশন নিয়ে আওয়ামী লীগের ৯১ নবাবপুর অফিসে আমি প্রেস রিলিজ লেখা শিখেছি; এখান থেকেই আমার হস্তাক্ষর পত্রিকার পাতায় মুদ্রিত হওয়ার শুরু। পরে কবিতা ও অন্যান্য লেখালেখিতে), ছাত্রনেতা বাহলুল মজনুন চুন্নু, ফজলুর রহমান, মুকুল বোসসহ অনেকে।


হঠাৎ দেখা গেল সেই জিপ দুটিই সচিবালয়ের দিক থেকে মিছিলের দিকে আবার এগিয়ে আসছে। মিছিলের কাছাকাছি হতেই এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে-ছুঁড়তে জিপ দুটি মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ডানপাশ থেকে দ্রুতবেগে উধাও হয়ে গেল।


ঘটনার আকস্মিকতার মধ্যেও আমাদের বুঝতে বাকি রইলো না যে, রাজ্জাক ভাই-ই এই সশস্ত্র হামলার মূল টার্গেট। আমরা তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে-দিতেই মুকুল বোসের কপালের এবং আমার মাথার পেছনে খুলির চামড়া ফেঁড়ে চলে গিয়েছিল পিস্তলের গুলি।


ছাত্রলীগকর্মী সেলিমসহ আরো কয়েকজন আহত হয়েছিলেন সেদিন। স্বাধীন বাংলাদেশে সেটিই ছিল গুণ্ডা লেলিয়ে দিয়ে মিছিলের ওপর প্রথম আগ্নেয়াস্ত্র হামলা।


তখন প্রেসক্লাবের আশপাশ ছিল গাছগাছালি ভরা আর জঙ্গলাকীর্ণ। আমি রাস্তায় পড়েছিলাম। আমাকে জেনারেল জিয়ার লেলিয়ে দেয় কয়েকজন যুবক পিটিয়েও ছিল খুব। সন্দিগ্ধচিত্তে মা’র করানো শপথের কথা তখন আমার মনে পড়েছিল! গরীব ঠেলাগাড়িওয়ালারা আমাকে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু সময় জঙ্গলে লুকিয়ে রেখে, পরে ঠেলাগাড়ি করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারা হয়তো আমার পোশাক-আশাক আর সাধারণ চোহারা দেখে বুঝে ফেলেছিল যে আমি তাদেরই মতো কোনো পিতার সন্তান বা ভাই!


মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিদিন গুলির আঘাতে অতিরিক্ত রক্তরক্ষণে মৃত্যুর কথা শুনেছি। সেদিন কিছুটা হলেও অভিজ্ঞতা হলো। রক্তক্ষরণে আমার শার্ট-গেঞ্জি-প্যান্ট ভিজে গিয়েছিল। অচেতন অবস্থায় আমাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলে সেখানে পুলিশ গ্রেফতার করতে যায়। স্নেহশীল সেবিকারা আমাকে লুকিয়ে রেখে জগন্নাথ হলে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে আমার বন্ধু মাধবের ছোটবোন ঢাকা মেডিকেলের ছাত্রী শিলা দাস জগন্নাথ হলে ছুটে আসে। সেখানে চিকিৎসা চলে এবং সন্ধ্যার পর আমাকে জহুরুল হক হলের আমার ৩৭৫ নম্বর রুমে নিয়ে আসা হয়।


আমার মনে আছে, সেদিন মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদল (বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি) এবং আরো কয়েকজন আমাকে একটি বেতের চেয়ারে বসিয়ে কাঁধে করে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে এসেছিল। সে সময় রাজ্জাক ভাই, তোফায়েল ভাই, সৈয়দ ভাই, কৃষকলীগ নেতা রাশেদ মোশাররফ ভাই ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানসহ অনেকে আমার খোঁজ-খবর নিতে জহুরুল হক হলের ৩৭৫ নম্বর কক্ষে এসেছিলেন।


সৈয়দ ভাই এবং রাশেদ ভাই একাধিকবার তাদের গাড়িতে করে আমাকে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) নিয়ে গেছেন এবং হলে পৌঁছে দিয়েছেন।


খবর পেয়ে আমার পাগলপ্রায় বাবা ঢাকায় ছুটে এসেছিলেন। সৈয়দ ভাই আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে বাড়ি পাঠানোর নিশ্চয়তা দিয়ে মাকে চিঠি লিখেছিলেন। একমাত্র তোফায়েল ভাই ছাড়া আজ সব নেতাই প্রয়াত হয়েছেন। সে সময় আমার প্রাইমারি স্কুল জীবনের বন্ধু এবং রুমমেট আবদুল্লাহ ও ইলাহী বক্স, অনুজপ্রতিম রওশনসহ অনেকে আমাকে সুস্থ করতে আমার সেবা-যত্ন করেছে।


এখন প্রায়ই ভাবি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান। প্রধান প্রধান যুদ্ধপরাধীদের বিচারের রায় ‘মৃত্যুদণ্ড’ কার্যকর হয়েছে। কিছুদিন আগেও যা ছিল ভাবনার অতীত!


জেলহত্যা মামলার ন্যায় বিচার উচ্চতর আদালতে সম্পন্ন হয়েছে। অগণিত বাঙালির রক্ত ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান ঘটিয়ে, দেশবাসীর কাঙ্খিত গণতন্ত্রের অক্লান্ত সংগ্রামে অদম্য সাহস আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুজিব তনয়া শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে যে নতুন নতুন নজির স্থাপন করে চলেছেন তা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।


লেখক: প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com