নিত্যদিন হাজারো অন্যায়-অনিয়ম, জুলুম, নিপীড়ন-নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এতোসব ঘটনা-দুর্ঘটনার সাথে তালমেলানো কঠিন। একটি ঘটনা অন্যটির চেয়ে ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক। বিভৎস কিংবা নৃশংস। খবর যত প্রকাশিত তারচেয়ে বেশী অপ্রকাশিত।চারিদিকে ভীষন অস্থিরতা। বিভক্তি। বৈষম্য। সন্দেহ। লোভ এবং ঘৃনার চাষাবাদ। সামাজিক কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। এমন পরিস্থিতি থেকে সকলেই পরিত্রাণ চায়। কিন্তু কেউ প্রতিবাদ বা বদলে দেবার লড়াইয়ে নেই। সকলেই মেনে বা মানিয়ে চলছে। আর ভাবছে, আসমান থেকে একজন মহাপুরুষ এসে সকল দুর্গতি-দুর্দশা থেকে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করবে।
বছরের পর বছর কাটে। সবল সর্বগ্রাসী হয়। কর্তৃত্বপরায়ন রাজনীতি চেপে ধরে। জনমনে হতাশা বাড়ে। মানুষ, ব্যক্তিকেন্দ্রীকতায় বাঁচার চেষ্টা করে। সমাজ-রাজনীতির ভালোমন্দ থেকে মুখ ফেরায়। এই সুযোগে, ছোট অনিয়মকারী বড় দুর্বৃত্ত হয়। বড়রা দুর্বৃত্তদের মহিরুহ(!)। রাজনীতি, গোষ্ঠীস্বার্থের তাবেদার এবং সর্বক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্য দাবী করে। অবিরত সাফল্য ও উন্নতির গল্প শোনাতে থাকে ক্ষমতাসীনরা।
অন্যদিকে, বহুমুখী চাপে-তাপে বিরোধী মত-পথ, কন্ঠ ক্রমশ ক্ষীন হতে থাকে। আর রাজনীতির মুখোশে কতিপয় লুটতে থাকে সোনার বাংলা।
রাজনীতি পথ হারালে সুশাসন ও ন্যায়বিচারের চাহিদা তীব্র হয়। নামে-বেনামে সুযোগসন্ধানীরা লুটপাট চালাতে থাকে। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে চলে। দুর্নীতি ও অপরাধ প্রবনতা বাড়ে। চটি কেনার সামর্থ্য ছিলো না যার, সে দামী গাড়ী হাকায়। সন্তানদের ব্যয়বহুল স্কুল-কলেজে পাঠায়। গ্যাষ্ট্রিক, মাথা ব্যাথায় সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড; উইক এন্ড পালন করতে দুবাই, বালি ছোটে। মোদ্দা কথা দেশটাকে নিজেদের তালুক ভাবে। আর এই গোষ্ঠীর দাপটে তটস্থ থাকে সমাজ, রাজনীতি, রাষ্ট্র ও প্রশাসন।
বিস্ময়কর এদের উত্থান। ক্ষমতাসীন দলের ‘রাজনীতি’ তাদের অবৈধ ‘ক্ষমতা ও আয়ের’ উৎস। এরা সমাজ, রাষ্ট্র, নীতি-নৈতিকতা, মানবিকতার ধার ধারে না। এদের কাছে, অর্থ ও ক্ষমতা ছাড়া বাকী সব মূল্যহীন। এবং এরা সর্বদাই ক্ষমতা ও ক্ষমতাসীনদের সাথে থাকতে পছন্দ করে।
ব্যক্তিস্বার্থে এরা মানুষ ও সমাজে বিভেদ তৈরি করে। তরুন-তরুনীদের বিপথগামী করে। মাস্তান পোষে। মিথ্যা মামলায় ফাসায়। নানান তকমায় পেটায়। ভিটেবাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে। জনসমক্ষে কান ধরে উঠবস করায়। প্রয়োজনে জীবন কেড়ে নিতেও দ্বিধা করে না। যা ইচ্ছে তা করার অধিকারকে নিজেদের মানবাধিকার বিবেচনা করে।
রাজনৈতিক সুবিধাভোগী এই শ্রেনীর হাতেই মূলত রাষ্ট্র এবং রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ। এরা সংখ্যায় কম কিন্তু সংঘবদ্ধ। রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের অশুভ অংশের সাথে এদের বন্ধুত্ব।
ফলাফল সৎ রাজনীতিক, আমলা, সাধারণ মানুষ সর্বত্র কোনঠাসা। জীবনভর তাদের হাজারো পরাজয় ও গ্লানির সাথে লড়তে হয়। জোড়াতালি দিয়ে চালাতে হয় জীবন। সততা, মর্যাদাপূর্ণ জীবনের নিশ্চয়তা দেয় না। বরং নৈমিত্তিক প্রয়োজন মেটাতে না পারায় শরীরে ব্যর্থতার সিল পড়ে। অথচ এই মানুষগুলোর মর্যাদা ও সম্মানই প্রাপ্য।
কিন্তু তা না পাওয়ায়, তারা একসময় অন্যায়ের বশ্যতা মানে, নয়তো উপেক্ষা আর আক্ষেপে জীবন কাটায়। এমন প্রেক্ষিতে ”যারা সৎ পথে চলবে। তারা একেবারে মরে যাবে, এটা তো হতে পারে না “-প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ভীষন অর্থবহ হয়ে ওঠে। যদিও সমাজ এবং পরিবারে এই বোধেরই অভাব। সে কারণেই দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা রাজত্ব করতে পারছে। ‘ভিখারী’র ডাকাত হয়ে ওঠার বহু উদাহরণ দেশে আছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে প্রজারাই সবচেয়ে প্রান্তিক। ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক হলেও, চর্চা কম। উন্নয়নের গতি চমকপ্রদ হলেও, অর্থনীতিতে দৃশ্যমান অনেক গর্ত। জনসংখ্যা বাড়লেও, প্রকতৃ মানুষ বাড়ছে না। শিক্ষার হার বাড়লেও মান তলানীতে। সাংস্কৃতিক মানও তথৈবচ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাড়লেও কমেনি কুপমুন্ডকতা ও গোঁড়ামী। উৎপাদন বাড়লেও, বঞ্চনা কমেনা কৃষকের। মাথাপিছু আয়ের সাথে বাড়ে বৈষম্য ও দুর্নীতি। দারিদ্র্য কমলেও বেড়েছে টাকা পাচার। প্রবৃদ্ধির উচ্চগতিকে কটাক্ষ করে বেকারত্ব ও বৈষম্য। এমন বহু বৈপরীত্য চোখের সামনে।
রাজনীতি, ব্যবসায়ী ও লুটেরাদের কবজায়। বর্তমান রাজনীতি ত্যাগি নেতা-কর্মী নয়, লোভি অর্থলগ্নিকারী খোঁজে। কারণ জনতার নামে রাজনীতি এখন অর্থনির্ভর। এই সময়ে অঢেল টাকা, দলের শীর্ষ পর্যায়ে লবিং, উর্ধ্বতন নেতাদের খাতিরদারি ছাড়া রাজনীতিতে টিকে থাকা কঠিন। এমতাবস্থায়, লোভ-ভোগের আশায় যারা রাজনীতি করেন; নানা সিষ্টেমে দলীয় পদ, এমপি, মন্ত্রীত্ব বাগান তারা দেশ ও জনতাকে বিক্রি করবে, এটাই স্বাভাবিক। এরা রাজনীতিকে ব্যবসা ভেবে বিনিয়োগ করে এবং সুযোগ পেলে তা সুদে আসলে তুলে নেন। এরাই সম্পদ পাচারকারি, ভন্ড ও মিথ্যাবাদী।
এই পরিস্থিতি একদিনে হয়নি। এর দায় অবশ্যই রাজনীতিকদের। সাথে অতীতের সব সামরিক ও বেসমারিক সরকার এবং অনেকাংশে জনগণেরও। সংবিধান সমুন্নত রেখে দেশ পরিচালনায় প্রায় সব সরকারের দুর্বলতা ছিলো বা আছে। বরং বহুক্ষেত্রে তাদের দ্বারাই লুন্ঠিত হয়েছে জাতীয় চেতনা ও গণতান্ত্রিক অধিকার। মোট কথা দেশের অভ্যন্তরে ক্রীয়াশীল সব অংশের সমষ্টিগত উদাসীনতা ও অবহেলায় রাষ্ট্রে পচন ধরেছে। রাজনীতি তিক্ততায় ভরা। মানুষ বিভক্ত। এই সুযোগে দুর্নীতি নামক পোকায় কাটছে জনগণের পকেট, উন্নয়নের সুতো এবং দেশের ভবিষ্যত।
সংবিধানে প্রদত্ত অধিকার, সুশাসন এবং সামাজিক ন্যায়বিচার থেকে জনগণ বঞ্চিত হলে ক্ষুদ্ধ ও হতাশ হয়। এ নিয়ে সমালোচনাও অস্বাভাবিক নয়। যদিও, জনস্বস্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু ‘উইনারস টেকস অল‘-গণতান্ত্রিক চেতনা বিরোধী হলেও, দেশে এই চর্চাই প্রবল। এ নিয়ে জনঅস্বস্তি আছে এবং সরকার তা উপলদ্ধি করছে বলে ধারণা করি। সরকার প্রধানের দুর্নীতি বিরোধী কঠোর অবস্থান তারই প্রমাণ বলে ইংগিত দেয়।
ভাবতে অবাক লাগে, যে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা থেকে জনগণের অধিকার, সাম্প্রদায়িকতা, স্বৈরাচারসহ বহু ক্ষতিকর প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে এতোটা পথ এসেছে; আজ সেই দলটির নেতাকর্মীদের থামাতে অভিযান চালাতে হচ্ছে। স্বস্তির বিষয়, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার আশ্বস্ত করছেন, অপরাধী যেই হোক ছাড় পাবেনা। কিছু কিছু ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি দলটির বহু সাধারণ সমর্থক-নেতাকর্মীর প্রত্যাশা দুর্নীতি বিরোধী চলমান অভিযান পরিণতি পাবে।
ইতিমধ্যেই বহু রথি মহারথি ঝরে গেছে। অনেকেই আটক এবং পলাতক। সম্মেলনের মাধ্যমে দলটির সহযোগী সংগঠনগুলোর বহু বিতর্কিত নেতা-কর্মীকে ছেটে ফেলা হয়েছে। যদিও, এতে তুষ্টির কিছু নেই। কারণ দুর্নীতি-অনিয়মের শেকড় এতো গভীরে যে এর বিরুদ্ধে লড়াই দীর্ঘ হতে বাধ্য। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও লড়াই চালিয়ে যাবার বিকল্প নেই। কেননা, দুর্নীতির রাশ টানা গেলে বহু সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয়ে যাবে। তবে, বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাশ টানাটাই কঠিন। তবে সদিচ্ছা, সঠিক পরিকল্পনা ও লক্ষ্য থাকলে সাফল্য আসবেই।
অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের সাথে প্রয়োজন সমৃদ্ধ জাতি গঠন। এ জন্যে চাই জাতীয় গণতান্ত্রিক চেতনা, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানের উন্নতি। সকল ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা। সুশাসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অবাধ রাজনৈতিক চর্চার নিশ্চয়তা। রাষ্ট্রের ওপর জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা। এসব ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। কেননা, জনগণ শুধুই অ্থনৈতিক নয়, রাষ্ট্রের কাছে সার্বিক উন্নতি ও কল্যান প্রত্যাশা করে।
এমন প্রেক্ষিতে সরকারী ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন নীতি পর্যালোচনা করা উচিত। যাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুষম বন্টন হয়। বৈষম্য ও বেকারত্ব কমে। বিনিয়োগ বাড়ে। প্রশাসন জনবান্ধব হয়। বিরোধীমত ও পক্ষ নির্ভয়ে কথা বলতে পারে। এর ব্যতয়, সমাজে অস্থিরতা তৈরি করে। যখন সমাজ থেকে ন্যায় পিছু হটে, বৈষম্য প্রকট হয়, দুর্নীতি ঘিরে ধরে, দমবন্ধ পরিবেশ সৃষ্টি হয় তখন আশাহত মানুষ আশ্রয় খুঁজতে থাকে। যার সুযোগ নেয় প্রতিক্রিয়াশীল ও পশ্চাৎপদ এমন এক গোষ্ঠী, যাদের চেহারার সাথে এ দেশের মানুষ ঠিকঠাক পরিচিত নয়।
শেষ পর্যন্ত দেশটা সকলের। এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য, সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল দেশ গড়ে তোলার দায়িত্বও সবার। তবে, মূল দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বের। নতুন করে দেশকে গড়তে হলে, রাষ্ট্র ও সমাজের খোলনলচে বদলে ফেলতে হবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জনপ্রশাসন, নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে। এজন্য প্রয়োজন সাহসী ও জনপ্রিয় নেতৃত্ব। দুর্নীতি বিরোধী শক্ত অবস্থান। সুশাসন, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ঐক্যমত এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রতি আন্তরিক ও অঙ্গিকারাবদ্ধ।
সন্দেহ নেই, যে কোন সংস্কারই জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পিছিয়ে গেলে চলবে না। কারণ সমাজ ও রাজনীতির যে অসুখ, তা প্যারাসিটামল বা পেইন কিলারে সারবে না। এজন্য প্রয়োজন বড় ধরণের সার্জারি বা অপারেশন। প্রশ্ন হচ্ছে, সার্জনটা কে? যার ছুরির নীচে নিরাপদ বাংলাদেশ।
লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, বিবার্তা২৪.নেট
বিবার্তা/আবদাল
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]