শিরোনাম
নুসরাত আমাদের লড়তে শিখিয়েছে
প্রকাশ : ২৪ অক্টোবর ২০১৯, ১৮:৪৮
নুসরাত আমাদের লড়তে শিখিয়েছে
তুরিন আফরোজ
প্রিন্ট অ-অ+

একটি বছর শেষ হয়ে যায়, আরেকটি আসে। দিন যায়, দিন আসে, দিন বদলায়। এভাবে কেটে যায় অনন্তকাল। কিন্তু কালের দাবি তার স্বাক্ষর রেখে যায় সভ্যতার বাঁকে-বাঁকে। আরো একটি নতুন বাংলা বছরের সূচনা হলো। প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার হিসাব মেলাতে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছি বারবার। আমার সমস্ত চেতনায় একটি নাম আজ প্রতিবাদের আগুন হয়ে স্ফুলিঙ্গ ছড়াচ্ছে। নুসরাত! মেয়েটি লড়াই করতে চেয়েছিল। ঘুণে ধরা সমাজের আনাচে-কানাচে সকল দীনতা আর হীনতার বিরুদ্ধে। নুসরাতকে চারপাশে দেখি। নুসরাত হারিয়ে যাওয়ার নয়। আমি রাজনীতির অলিগলি চিনি না, আমি মোল্লাতন্ত্রের জাঁতাকলে ধর্মকে বন্ধক দেইনি, আমি নারীবাদী না পুরুষবাদী তা নিয়ে ভাবার সময় পাই না। আমি তথাকথিত প্রগতিবাদী নই, আমি কুসংস্কারে নিজের শুদ্ধি খুঁজি না, আমি ডান-বাম চিনি না। আমি শুধু দেখি এক বিশাল অন্ধকার গহ্বরে আমার মানব অস্তিত্ব। আগুনের লেলিহান শিখা আমার বিবেককে দাউ দাউ করে পোড়াচ্ছে। আমি সরকারের পক্ষে যুক্তি দেব না, আমি সরকারের বিপক্ষে আন্দোলন করব না। আমাকে শুধু একবার কেউ বুঝিয়ে দিয়ে যাক, আমার নুসরাত কেন চলে গেল না ফেরার দেশে?



ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ


নুসরাত হিজাব পরত না টাইট জিন্স এসব আমাকে বিচলিত করে না। নুসরাত ধর্ম মানত নাকি নাস্তিক ছিল এসব আমাকে ভাবায় না। নুসরাত তার প্রথম প্রণয়ে কাউকে কাছে টেনেছিল নাকি বাবা-মার পছন্দের ছেলের হাত ধরে সংসার করত এসবের কোনো কিছুই আমাকে চিন্তিত করে না। আমি খুব স্বার্থপর! ভাবি, শুধু আমার নুসরাতের কথা। আমার ঘরে যে ‘নুসরাত’ বড় হচ্ছে, আমি তাকে বাঁচাব কী করে? সে কোথায় নিরাপদ? আমার দেবালয়তুল্য ঘরে? তার আলোকবর্তিকা পাঠালয়ে? তার পিতার কাছে? পুরুষ স্বজনদের কাছে? ধর্মগুরুর কাছে? তার স্বপ্নের হাতছানি দেয়া পথের মোড়ে মোড়ে বিপদ। এত অন্ধকার কেন এই সমাজ? আমি আমার ‘নুসরাত-কে কেন জন্ম দিলাম?


আইনের লড়াই লড়ে যাওয়া যায় অনন্তকাল। আইন আছে না নাই, তা নিয়ে তর্ক-বিতর্কে যাওয়া আজকাল খুব অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। এই অপরাধীদের শাস্তি হতে পারে আবার নাও হতে পারে! আবার আরেক নুসরাতকে আত্মাহুতি দিতে হবে। এটাই তো স্বাভাবিক বলে আমরা মেনে নিয়েছি। আসলে আমাদের অন্ধকার মনে এর চাইতে বেশি কিছু আমরা ভাবতেও পারি না। আমরা আমাদের কন্যাকে সম্মান করতে শিখিনি, আমরা আমাদের কন্যাকে সমান ভাবতে পারি না, আমরা আমাদের কন্যাকে উত্তরাধিকারী ভাবার জায়গা তৈরি করিনি। কন্যাকে সম্পত্তির অধিকার দিতে গেলে সমাজপতি, পরিবারের পুরুষ সদস্যরা তো বটেই, ঘরের মহিলারা, এমনকি কন্যার জন্মদাত্রী মাও মুখ ঝামটে উঠে। আসলে এ এক ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজ। এই সমাজ আরও অন্ধকারে ছেয়ে যাবে। তবে, নুসরাত জাহান রাফি আমাদের লড়তে শিখিয়েছে। আমি লড়ব, আমার ‘নুসরাত’ ও লড়বে। আপনারাও লড়াই করুন। কিন্তু দয়া করে তা কেবল রাজপথের মিটিং-মিছিলে নয়, ফেইসবুকের টাইমলাইনে নয়, মিডিয়া-পত্রিকায় নয়। লড়াই শুরু করুন আপনার মূল্যবোধের ঘরে; জি, আপনার নিজের ঘরে। পারবেন? আর যদি না পারেন, তবে দয়া করে চুপ করে থাকুন। আর দেখতে থাকুন এই সমাজের মানবিক অবক্ষয়, মূল্যবোধের পতন। সর্বনাশা এই আগুনে শুধু ‘নুসরাত’ নয়, পুড়বে আপনার ঘর, সমাজ, জাতি, পুড়বেন আপনিও।


লেখক: আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com