শিরোনাম
সড়ক ও পরিবহন খাত : সমস্যা চিহ্নিত, শুরু হোক সমাধান যাত্রা
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০১৮, ১৭:২৮
সড়ক ও পরিবহন খাত : সমস্যা চিহ্নিত, শুরু হোক সমাধান যাত্রা
সাইফুল হাসান
প্রিন্ট অ-অ+

তখন আমি দৈনিক যায়যায়দিনে। দেশসেরা সাংবাদিকরা কাগজটিতে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু কাগজ প্রকাশিত হচ্ছে না, কবে বেরুবে সে নিশ্চয়তাও নেই। ফলে সবার অলস সময় কাটছে। এ অবস্থায় কেউ একজন দার্জিলিং ঘুরতে যাবার প্রস্তাব করায় সিনিয়ররা রাজি হয়ে গেলেন। তাদের দেখাদেখি আমরাও।


এক রাতে ১৮/১৯ জনের একটি দল দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে রওনা হলাম। নেতৃত্বে প্রখ্যাত সাংবাদিক অমিত হাবিব। শিলিগুড়ি থেকে আকাবাঁকা রাস্ত খাড়া উঠে গেছে। সামান্য ভুল বা গাড়ির ব্রেক ফেল করলেই সব শেষ - বাঁচার কোনো সুযোগই নেই।তবে পাহাড়ের শরীর বেয়ে উপরে ওঠার অভিজ্ঞতা সত্যিই রোমাঞ্চকর ও অতুলনীয়।


আগে এতো উঁচু পাহাড় দেখার বা চড়ার অভিজ্ঞতা হয়নি। সমতলের মানুষ, ফলে কয়েক হাজার ফিট উপরে উঠেই অক্সিজেনের অভাব বুঝতে শুরু করলাম। সরু ও ভেজা রাস্তা, চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। কিন্তু ড্রাইভাররা ভীষণ দক্ষ আর সতর্কতার সাথে আমাদের সমতল থেকে নয় হাজার ফিট ওপরে পৌঁছে দিলো। রাস্তার প্রতিটি বাঁক, পাহাড়ের গায়ে খোদাই করে লেখা, সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত মজার মজার বার্তা, ড্রাইভারদের জন্য উপদেশবাণী, ভিন্নধর্মী সব স্লোগান।


এখনও মনে পড়ে, নওরোজ ইমতিয়াজ (এটিএন নিউজের বার্তা সম্পাদক) কাকে যেনো বলছিলেন, বাংলাদেশের রাস্তাগুলোতেও যদি এমন সুন্দর উপদেশ ও সতর্কতামূলক সাইনবোর্ড, স্লোগান থাকতো তবে এড়ানো যেতো অনেক দুর্ঘটনা। বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা সেসব বার্তার এখনও কয়েকটার কথা মনে আছে। ‘বাবা, সাবধানে গাড়ী চালিও, মা ও আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।’ সাবধানে চালাও জীবন বাঁচাও। Stop accident before they stop you. Kill your speed, not a child।


শুধু দার্জিলিংই নয় এরপর পৃথিবীর যেখানেই গেছি প্রায় সব জায়গাতেই এমন সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, দেয়ালে অংকন দেখেছি। সবচেয়ে মজার উপদেশ ছিলো, if you want to stay marriage, divorce speed. অন্যটি হলো Donates blood!! But not on roads.


নিরাপদ সড়কের দাবি যতবার ওঠে, ততবারই এক যুগ আগের দার্জিলিং ভ্রমণের কথা মনে পড়ে। কেননা প্রথম দিনেই ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন একজন ট্যাক্সিচালক। দার্জিলিংয়ে ট্রাফিক আইন ভীষণ কড়া। প্রথমবার আইন ভাঙলে জরিমানা ৫০০০ রুপি। দ্বিতীয়বার ১০ হাজার রুপি। তৃতীয়বারে ২০ হাজার রুপি এবং সারাজীবনের জন্য লাইসেন্স বাতিল। জরিমানার টাকা শোধ করাও বাধ্যতামূলক। যেকারণে সেখানে ট্রাফিক আইন ভাঙ্গার কথা কেউ কল্পনাও করে না।


বাংলাদেশের বাস্তবতা অবশ্য ভিন্ন। এখানে সড়ক কম, গাড়ি বেশি। গাড়ি থাকলে ফিটনেস নেই। ড্রাইভার আছে লাইসেন্স নেই। লাইসেন্স-ফিটনেস আছে কিন্তু সড়কের অবস্থা করুণ। সড়ক যেমনই হোক যাত্রী ধরার বা গন্তব্যে পৌঁছানোর প্রতিযোগিতা প্রবল। সড়ক পারাপারে কোনো নিয়ম মানে না পথচারীরা। পরিবহন শ্রমিক- মালিকরা ভীষণ সংঘবদ্ধ এবং ক্ষমতাধর। সব মিলিয়ে এ খাতটিতে চরম বিশৃংখলা বিরাজ করছে।


নিরাপদ সড়কের দাবি বাংলাদেশে বহু পুরানো। ২৫ বছর আগে চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন দাবিটি সামনে এনেছিলেন। কিন্তু কেউ তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনেননি বা শুনতে চাননি। দুঃখজনক হচ্ছে, দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ব বরণকারী বা স্বজন হারানো পরিবারগুলোও ঠিক মতো তার পাশে দাঁড়ায়নি।


সড়ক ও পরিবহনের সাথে মানুষের জীবন-মৃত্যু, জীবিকা ও নিরাপত্তা জড়িত। অথচ এ খাতটিই সবচেয়ে বেশি নৈরাজ্যের শিকার। স্বভাবতই সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত। কিশোর-কিশোরীদের আন্দোলনে মানুষের স্বপ্রণোদিত সমর্থনই এর প্রমাণ। অবশ্য বাচ্চাদের এই আন্দোলনের কারণেই দেশবাসী জানতে পেরেছে খাতটির অসুখ কত গভীরে পৌছেছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস ও জরুরী কাগজপত্র ছাড়া কত গাড়ি চলে!!! মন্ত্রী, আমলা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, পুলিশ, সাংবাদিক, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ কেউ আইন মানেন না। সারাদেশের চিত্র নিশ্চয়ই এরচেয়েও ভয়াবহ।


এ অবস্থা চলতে পারে না, যে কোনো মূল্যে বন্ধ হওয়া উচিত - কয়েকদিন সড়কে অবস্থান করে এ বার্তাটিই দিয়েছে কিশোরী-কিশোরীরা। আন্দোলনটি যৌক্তিক ও জনসমর্থনপুষ্ট। ফলে সরকার তাদের দাবি মেনে নিয়ে দ্রুত কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। খাতটিতে শৃংখলা ফেরাতে, পরিবহন ও সড়ক আইন-২০১৮ মন্ত্রীসভায় পাস করিয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে সড়ক ও পরিবহন খাতে শৃংখলা ফিরবে বলে আশা করছে সরকার।


কিন্তু শুধু আইন দিয়ে কি বিশৃংখলা, নৈরাজ্য, দুর্নীতি দূর করা সম্ভব? বহু বছর ধরে চলে আসা অনিয়ম-অনাচার এ খাতটিতে ক্যান্সারের মতো জেঁকে বসেছে। অপারশেন ছাড়া এ থেকে মুক্তির কোনো উপায় আছে?


পৃথিবীর সবচেয়ে সুশৃংখল সড়কেও দুর্ঘটনা ঘটে, প্রাণহানি হয়। কিন্তু সেগুলো দুর্ঘটনাই। কিন্তু ২৯ জুলাই শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী বা আরো অনেকের সাথে যা ঘটেছে সেগুলো স্রেফ হত্যাকান্ড। পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর ১২ থেকে ১৫ লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে বাংলাদেশে এই সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। দুর্ঘটনার কারণে জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ ক্ষতি হয়। এতো জীবন যাবার পরও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামছে না।


চালকদের অসাবধানতা, অকারণ প্রতিযোগিতা, বিশ্রামের অভাব, ফিটনেসহীন গাই, খানাখন্দে ভরা সড়ক, পথচারীদের অসচেতনতাসহ নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। দুর্ঘটনা ঠেকানো যাবে না। তবে সচেতন হলে এর হার কমিয়ে আনা সম্ভব। নিরাপদ সড়কের বিষয়টি শর্তসাপেক্ষ এবং অনেক কিছুর ওপর নির্ভরশীল। এজন্য শুধু চালককে দোষ দেয়া যাবে না। দূর্ঘটনা রোধে চালক, মালিক, শ্রমিক, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী সবারই ভূমিকা আছে।


সড়কের সাথে মালিক-শ্রমিক-সাধারণের জীবন-জীবিকা ও নিরাপত্তার প্রশ্নটি গভীরভাবে জড়িত। ফলে দূর্ঘটনা এড়াতে সচেতনতাই উত্তম প্রতিষেধক। পাশাপাশি টেকসই ও উন্নত সড়ক, কার্যকর সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও আইন, আইনের প্রয়োগ, ভালো গাড়ি, ফুটওভার ব্রিজ ও জেব্রা ক্রসিংয়ের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। যদিও সড়কগুলো বর্তমানে যে অবস্থায় আছে, এখানে আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া শৃংখলা ফেরানো কঠিন।


প্রবাদ আছে, একটা দেশের সড়ক ও পরিবহন খাতের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, দেশটি কতটা সভ্য। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সড়ক ও সাধারণ নিরাপত্তা বিষয়ে ছেলেবেলায় ধারণা দেয়া হয়। এতে করে নিরাপত্তার বিষয়টি তাদের অভ্যাসের মধ্যে ঢুকে পড়ে। বড়দের ক্ষেত্রে এই সচেতনতা তৈরি কঠিন। বিষয়টি সাংস্কৃতিকও বটে। অর্থাৎ ট্রাফিক আইন পরিপালনকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা জরুরী। সবার মনে রাখা উচিত, নিরাপত্তা ও সচেতনতাই প্রথম। ফলে, সড়ক নিরাপত্তায় সরকার, পুলিশ, মালিক, শ্রমিক এবং জনসাধারণের দায়িত্বশীলতাই প্রধান। কেননা, দুর্ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কেউ লাভবান হয় না, সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।


গত সোমবার রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রাজনীতি ঠিক হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আগে রাজনীতিবিদদের ঠিক হতে হবে।’----‘সড়কে শৃংখলা আগেও ছিলো না, এখনও নেই। মানসিকতা পরিবর্তন না হলে সড়কে শৃংখলা ফিরবে না। শুধু কি চালকরা বেপরোয়া, পথচারীরা বেপরোয়া নয়?’ (বাংলা ট্রিবিউন)


মন্ত্রী যথার্থই বলেছেন। যুগ যুগ ধরে খাতটিতে যে জঞ্জাল ও জটিলতা তৈরি হয়েছে, তা শুধু আইন ও বলপ্রয়োগে দূর হবে না। বরং দরকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বিআরটিএর দুর্নীতি, প্রভাবশালীদের আইন অমান্য করার প্রবণতা, পরিবহন ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার মানসিকতা এবং ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করতে বহুমুখী উদ্যোগ প্রয়োজন।


ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রদানে কঠিন ও কঠোর পরীক্ষার ব্যবস্থা, ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল বন্ধ, জনগণকে ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহারে বাধ্য করা, ট্রাফিক আইন পালনে সকলেকে বাধ্য করা, চালকদের পর্যাপ্ত বিশ্রামের ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় সংস্কার, বিভাজক ও সড়কের পাশে নিরাপত্তা ও সচেতনতা সম্পর্কিত সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে বাধ্য। পাশাপাশি, ভবিষ্যত প্রজন্মের নিরাপত্তা ট্রাফিক আইন সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় কি না, তা ভেবে দেখতে পারে সরকার।


সড়ক ও পরিবহন খাতে সমস্যা বহু পুরানো ও চিহ্নিত, প্রয়োজন সমাধান যাত্রা।


এর শুরুটা হতে পারে কিশোর-কিশোরীদের নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে ভিত্তি ধরে।


(লেখার শিরোনাম, প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নির্বাচনী ক্যাম্পেইন থেকে সংগৃহিত)


লেখক : সাংবাদিক


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com