শিরোনাম
কয়েকজন শিক্ষাগুরু
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০১৮, ১৫:৩০
কয়েকজন শিক্ষাগুরু
হুমায়ুন কবীর
প্রিন্ট অ-অ+

আমি একজন সাবেক ফুটবলার। দীর্ঘ দিন পাকিস্তান ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে ফুটবল খেলার সৌভাগ্য হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী ঢাকা মোহামেডানের হয়ে খেলেছি। খেলেছি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও ক্লাবের হয়েও।


কিন্তু আজ খেলাধুলা নয়, আমার ছাত্রজীবনের অর্থাৎ বিগত শতকের ৫০-এর দশকে কুমিল্লার কিছু গুণী শিক্ষকের স্মৃতিচারণ করছি। যাদের কথা মনে হলে এখনো আমার মাথা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় নুয়ে আসে।


বসন্ত বাবু : ১৯৪০-৫০ দশকে কুমিল্লার দেবিদ্বার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন বসন্ত বাবু। স্কুলের ছেলেদের তিনি নিজের সন্তানের মতোই দেখতেন। টাকাপয়সার দিকে তার কোনো লোভ ছিল না।


তার সময়ে চতুর্থ শ্রেণীর এক ছাত্র নাম ঈসমাইল। সে অঙ্কে খুব পারদর্শী ছিল। বসন্ত বাবু তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের বলেছিলেন, আমাদের ঈসমাইল বিশ্ববিখ্যাত একজন বিজ্ঞানী হবে। শিক্ষাগুরুর কথা বিফলে যায়নি। পরবর্তীকালে আমেরিকার নাসার একজন গবেষক হয়েছিলেন তিনি।


এস বি বড়ুয়া : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী কুমিল্লা জিলা স্কুলের একজন শিক্ষক এস বি বড়ুয়া। একদিন স্কুল ছুটির পর স্কুলের সামনের সড়ক দিয়ে সব শিক্ষার্থী যখন বাসায় ফিরছিল এ সময় তিনি দেখলেন, একজন ছাত্র রাস্তার ওপর থুতু ফেলছে। পরদিন তিনি স্কুলে এসে সেই ছাত্রটিকে নিজ কক্ষে ডেকে নিলেন। বললেন, তুমি রাস্তার উপর থুতু ফেলেছিলে কেন? থুতু ফেলতে হলে সড়কের পাশের ড্রেনে গিয়ে ফেলবে। আর কোনোদিন এরকম করো না, যাতে রাস্তার পরিচ্ছন্নতা নষ্ট হয়।


তার সময়ে জিলা স্কুল শিক্ষায় অনেক এগিয়ে ছিল। এই স্কুলেরই আরো শিক্ষক আলী আহমেদ, নুর আহমেদ, রশিদ স্যার - জেলাশহর পেরিয়ে যাদের নাম-ডাক সারা দেশে ছিল।


সুবর্ণ চৌধুরী : ভারত বিভক্তির আগে-পরে কুমিল্লা ইউসুফ বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন সুবর্ণ চৌধুরী। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে স্কুলটিতে প্রায় সাড়ে ৯০০ শিক্ষার্থী ছিল। স্কুলে কাস শুরুর আগে শিক্ষার্থীদের কোলাহলে মনে হতো কোনো সভা বা সমাবেশ। কিন্তু যেইমাত্র সুবর্ণ চৌধুরী স্কুলের গেটে এসে পৌঁছতেন, সাথে সাথে সব কোলাহল থেমে যেত। মনে হতো স্কুলে একজন ছাত্রও নেই। প্রতিটি শ্রেণিকক্ষে নীরবতা নেমে আসত। একই রকম স্নেহ ও শাসন ছিল স্কুলের অন্য শিক্ষকদেরও।


১৯৫১ সাল। আমি তখন ইউসুফ স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র। আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল তৈয়ব আলী ডাক্তারের বড় ছেলে ফরিদ। আমি গানের কিছু চর্চা করতাম, আর ফরিদ সেতার বাজাত। একদিন সুবর্ণ চৌধুরী বললেন, ''কুমিল্লা টাউন হলে একটি গানের অনুষ্ঠান করব। স্কুলের ছেলেদের মধ্যে কে ভালো গান গাইতে পারে?'' সলিল সাহা নামে এক ছাত্র বললেন, ''স্যার আমি গানের কিছু চর্চা করি, আর ফুটবলার হুমায়ুন কবীর গান গাইতে পারে। ফরিদ ভাই সেতার বাজাতে পারে।'' তখন তিনি আমাদের ডেকে নিয়ে বললেন, ''তোমাদের একটি অনুষ্ঠান করতে হবে আমাদের স্কুলের পক্ষ থেকে।'' এরপর দারোগা বাড়ির ওস্তাদ খলিল মিয়া ও ঠাকুরপাড়ার সুধীন দাসকে ডেকে বললেন, ''সুধীন তুই যখন কথা বলিস, তখন ফাটা বাঁশকে বাড়ি দিলে যেরকম আওয়াজ হয়, সেরকম মনে হয়। আর যখন গান গাইতে যাস, তখন এত সুন্দর সুর করে কিভাবে গান করিস!'' বলেই আমি, সলিল ও ফরিদকে দেখিয়ে বললেন, ''স্কুলের অনুষ্ঠান হবে। তুই এদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখাবি। '' নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠান হয়ে গেল। পুরস্কারও পেলাম। সবাই আমাদের গানের প্রশংসা করলেন।


আরেকদিন আমি ও ফরিদ কান্দিরপাড়ে সিনেমা প্যালেসে ‘টারজান অ্যান্ড দ্য এইপম্যান’ দেখতে যাই। প্রথম শ্রেণীর টিকিট কেটে ভেতরে গিয়ে আসনে বসি। হঠাৎ খেয়াল করলাম, পাশের সিটে সুবর্ণ বাবু। বিষয়টি ফরিদকে বলে দু'জনে পেছনের সিটে গিয়ে বসি। পরদিন স্কুলে গেলাম ভয়ে ভয়ে। তিনি কাসে আমাদের ‘ডিকার অব ওয়ারফিল্ড’ পড়াতেন। যথারীতি ক্লাসে এসে আমাদের দু'জনকে উদ্দেশ করে বললেন, ''ওই, তোরা দু’জন দাঁড়া।'' তিনি কাসের অন্য ছাত্রদের উদ্দেশে বললেন, ''জানিস, এরা কী করেছে। গতকাল কান্দিরপাড় সিনেমা প্যালেসে আমি ‘টারজান অ্যান্ড দ্য এইপম্যান’ ছবিটা দেখছিলাম। তারা প্রথমে আমাকে না দেখে আমার পা ঠেলে পাশের সিটে গিয়ে বসেছে সিনেমা দেখতে। যখনই তারা আমাকে দেখল, তখন উঠে গিয়ে পেছনের সিটে বসল। আমি এটাকে তাদের দোষ বলব না। আজেবাজে কোনো সিনেমা দেখিস না। যে ছবি দেখে ভালো কিছু অর্জন করা যায় ও শিক্ষণীয় কিছু থাকে ওইসব ছবি দেখবি। দেখিস বাবার সর্বনাশ করার জন্য যেন সিনেমার প্রতি নেশা না হয়।'' তারপর বললেন, ''কাল যে ছবিটা দেখেছিস তার প্রথম অর্ধেক তুই (হুমায়ুন), পরের অর্ধেক ফরিদ বলবি।'' এ সময় বলতে গিয়ে যখনই আমি আটকে যেতাম, তখনই তিনি সেটা বলে দিতেন। আর এভাবেই সেদিনের কাস শেষ হয়েছিল।


সুবর্ণ চৌধুরীর আরেকটি ঘটনা খুব মজার ছিল। স্কুলের এক হিন্দু ছেলে প্রায়ই সুবর্ণ চৌধুরীর বাসার সামনে ঘুর ঘুর করত এবং তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করত। মেয়ে বাবার কাছে নালিশ করল। একদিন স্কুলে এসেই প্রথমে ক্লাসে দাঁড় করালেন ওই ছাত্রকে। তারপর ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে শুনিয়ে বললেন, ''জানিস সে কী কাজ করেছে? সে আমার মেয়ের সাথে প্রেম করে।'' তারপর বললেন, ''আগে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজেকে যোগ্যভাবে গড়ে তোলো। তারপর দেখবি সুবর্ণ বাবু নিজেই ডেকে তার মেয়েকে তোর কাছে বিয়ে দেবে। দেখবি আমার মেয়ে প্রফেসর, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা ব্যারিস্টার হতে পারে। তোর যদি যোগ্যতাসম্পন্ন হতে ইচ্ছে থাকে আর এসব ডিগ্রি না থাকে, তাহলে মানুষ হতে পারবি না।'' ক্লাসের সবাইকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, বিদ্যালয় হলো একটি পবিত্র ও আদর্শ জায়গা। এখানে এসেছিস জ্ঞান ও আদর্শ শিক্ষার জন্য। গুরু বিনে জ্ঞান অর্জন, সৎপথে চলা, উচ্চশিক্ষা লাভসহ প্রকৃত মানুষ হওয়া কারো পক্ষে সম্ভব নয়। আমি আশা করি, তোমরা আমার কথাগুলো অনুসরণ করে দেশের, সমাজের সব অনিয়ম, দুর্নীতি থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রেখে দেশের কল্যাণে ব্রতী হবে। '' তারপর আর কোনোদিন ওই ছেলেটি সুবর্ণ বাবুর বাসার সামনে দাঁড়ায়নি।


আখতার হামিদ খান : কুমিল্লার অন্যতম সম্মানিত ব্যক্তি যিনি কুমিল্লাকে বিশ্বের দরবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন সেই আখতার হামিদ খানের কিছুটা স্মৃতিচারণ করব। এক সময় তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তিনি শুধু একজন মানুষ গড়ার কারিগরই ছিলেন না, এ দেশের জন্য অনেক কিছু করে গেছেন।


তার একটি ঘটনা, একদিন ভিক্টোরিয়া কলেজের এক ছাত্র কলেজের করিডোর দিয়ে ঢোকার সময় জেলার এক পদস্থ সরকারি কর্মকর্তার সুন্দরী মেয়ের গালে একটি পিংপং বল ছুড়ে মারে। মেয়েটি অধ্যক্ষ আখতার হামিদ খানের কক্ষে ঢুকে ছেলেটির নামে নালিশ দেয়। সাথে সাথে তিনি ওই ছেলেটিকে ডেকে এনে বিষয়টি জানতে চাইলে সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখন আখতার হামিদ খান চেয়ার থেকে উঠে ঘুষি মেরে ছেলেটিকে মেঝেতে ফেলে দেন। তারপর টেনে উঠিয়ে বললেন, ''গুণ্ডা হয়ে গেছ? তোমাকে কলেজ থেকে বের করে দেবো।''


ছেলেটি অধ্যক্ষের পায়ে পড়ে ক্ষমা চাইল। এ সময় তিনি বলেন, কলেজ হলো আদর্শ মানুষ গড়ার জায়গা, কোনো অন্যায় আচরণ শিক্ষার নয়। ভবিষ্যতে এসব আর করবে না।


বড়ুয়া বাবু : এরকম আরেকজন শিক্ষক জাফরগঞ্জ স্কুলের বড়ুয়া বাবু। একই স্কুলের অপর একজন শিক্ষক সোনা মিয়া। তাদের হাতে গড়া অনেকেই দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও সুনামের সাথে কাজ করছেন।


নলিনী লোধ ও উপেন্দ্র বাবু : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে ময়নামতি উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন নলিনী লোধ। ওই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন উপেন্দ্র বাবু। তাদের আদর্শের ছোঁয়ায় স্কুলে যে নিয়মকানুন ছিল, তাতে সে সময় কেন শিক্ষার্থী বিপথগামী হয়নি। সেই স্কুলের একজন ছাত্র ছিলেন সিরারুল ইসলাম। যিনি অবিভক্ত বাংলায় মেট্রিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অধিকার করেছিলেন।


দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নৈতিকতা ও আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন আদর্শ শিক্ষকের। সে সময় দেশের প্রতিটি স্কুল-কলেজ ছিল সব আদর্শের এক উত্তম জায়গা। আমার মনে পড়ে, সুবর্ণ বাবু ১৯৫৪ সালে অবসর নিয়ে ভারতে চলে যান। যাওয়ার আগে কুমিল্লা টাউন হলে নাগরিক সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল তাকে। তা ছাড়া বিভিন্ন শিক্ষার্থীর বাসা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে অর্ধশতাধিক সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। বর্তমানে এরকম মানের শিক্ষকের বড়ই অভাব। বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নে শুধু সরকারের দিকে চেয়ে থাকলে হবে না, দেশের শ্রেণী-পেশার সব স্তরের বুদ্ধিজীবীদের গুরুদায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে শিক্ষার মানোন্নয়নে।


লেখক : সাবেক জাতীয় ফুটবলার


বিবার্তা/হুমায়ুন/মৌসুমী

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com