শিরোনাম
শেখ হাসিনা রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থপাঠ কেনো অপরিহার্য
প্রকাশ : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৫
শেখ হাসিনা রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থপাঠ কেনো অপরিহার্য
মুহাম্মদ সামাদ
প্রিন্ট অ-অ+

ভূমিকা


আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ৭৪তম শুভ জন্মদিন। তাঁর জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর বাঙালির তীর্থভূমি জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার জন্মগ্রাম টুঙ্গিপাড়ায়। শেখ হাসিনার শৈশব কেটেছে শান্ত গ্রামীণ পরিবেশে। পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাবাহিক ঘটনাবলী তাঁর রাজনীতিক ও লেখক মানসপট সমৃদ্ধ করেছে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিনের শিশু ‘হাচু’১৯৫২ সালে কচিকণ্ঠে উচ্চারণ করে ভাষা আন্দোলনের শ্লোগান; স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রনেত্রী হিসেবে দেশের সকল ছাত্র-গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। প্রিয়কন্যা হিসেবে পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবের অবিসংবাদিত হয়ে ওঠা ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ; একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের বন্দিজীবনের দুঃসহ অভিজ্ঞতা; একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রত্যক্ষ করেন অগণিত বাঙালির স্বজন-প্রিয়জন হারানোর বেদনা মিশ্রিত বিজয়োল্লাস ও প্রতীক্ষিত মুক্তির আনন্দ; প্রত্যক্ষ করেন বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহণ; এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্যে নতুন বাংলাদেশ গঠনের জন্যে জাতির পিতার দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা; এ সবই শেখ হাসিনার সনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণের প্রথম অধ্যায়।


অন্যদিকে, ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড; প্রবাসে ছয় বছরের দুঃসহ শরণার্থী জীবন শেষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন; ঘাতকের রক্তচক্ষু ও মৃত্যুবাণ উপেক্ষা করে দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের সামরিক ও স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদান; সংসদে বিরোধী দলীয় নেতার দায়িত্বপালন; অতঃপর জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৯৬ সাল থেকে, এক মেয়াদের বিরতি বাদে, অদ্যাবধি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম প্রাজ্ঞ রাজনীতিক ও সফল রাষ্ট্রনেতা হিসেবে দেশসেবার অনন্য নজির স্থাপন করে চলেছেন শেখ হাসিনা। এই যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং নিরন্তর সাহিত্য পাঠের অনুপ্রেরণায় তাঁর নিজের লেখালেখি, পাশাপাশি অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর তিনখানা মহাকাব্যিক আত্মজীবনী এবং চৌদ্দ খণ্ড গোয়েন্দা দলিলপত্র সম্পাদনায় ব্রতী হয়েছেন।


বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার প্রথম বই ওরা টোকাই কেন-এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান গভীর এক বেদনাবোধ থেকে পরিপার্শ্বকে অবলোকনের কথা উল্লেখ করে তাঁর রচনাকুশলতার প্রশংসা করেছেন; দ্বিতীয় গ্রন্থ শেখ মুজিব আমার পিতা-এর ভূমিকায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম শেখ হাসিনার মধ্যে একজন গভীর সংবেদনশীল লেখকের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পেয়েছেন। শেখ হাসিনার রচনাসমগ্র: ১ ও ২-এর মুখবন্ধে অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ খুবই প্রশংসনীয়। কামাল চৌধুরী ‘লেখক শেখ হাসিনা’শীর্ষক প্রবন্ধে শেখ হাসিনার লেখালেখিকে ‘যুগপৎ সৃজনশীলতার উদ্ভাসন ও দিনবদলের হাতিয়ার’আখ্যা দিয়ে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।


উল্লেখ্য, প্রবন্ধের কাঠামো এবং পরিধি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত ছবিতে যেমন চৌকা জিনিসের চারিটা পাশই এক সঙ্গে দেখানো যায় না, তেমনি প্রবন্ধেও একসঙ্গে একটা বিষয়ের একটি, বড়োজোর দুইটি দিক দেখানো চলে। তাই, আমি এই প্রবন্ধ/বক্তৃতায় শেখ হাসিনা রচিত মৌলিক ও সম্পাদিত গ্রন্থপাঠের অপরিহার্যতার দিক কয়েকটি উপশিরোনামে তুলে ধরার প্রয়াস করেছি।


টুঙ্গিপাড়ার পল্লী প্রকৃতি


টুঙ্গিপাড়া বাঙালি জাতির স্বপ্নগর্ভা গ্রাম। এই ছায়া সুনিবিড় গ্রামে বনেদি শেখদের বাড়ি। বাড়ির পেছন ঘেঁষে বয়ে চলা সকলের প্রিয় ‘খোকা’র সাঁতার-গোসলের ও বৈঠা বেয়ে নৌকায় ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতিবিজড়িত ক্ষীণতোয়া বাইগার নদী; আশপাশের দশ গাঁয়ের মেঠোপথ, আইল-বাতর, দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠে, হাটে-ঘাটে-বাটে টুঙ্গিপাড়ার প্রিয় ‘খোকা’র শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের পদচিহ্ন পড়ে আছে; বাতাসে তাঁর নিঃশ্বাস প্রবহমান। তিনি চিরনিদ্রায় অনন্তকালের জন্যে শুয়ে আছেন এই মাটিতে! তাহলে কেমন ছিলো এই গ্রাম? শেখ হাসিনার শৈশবের মধুর স্মৃতিচারণে টুঙ্গিপাড়ার সেদিনের পল্লী প্রকৃতির চিত্রালেখ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সারিত হবে। আগামী দিনের অনাগত শিশু-কিশোরের কৌতুহলের উত্তর মিলবে বাঙালি জাতির এই তীর্থভূমিতে জন্ম নেয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার লেখায়:


বাইগার নদী এখন টুঙ্গীপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে কুল কুল ছন্দে ঢেউ তুলে বয়ে চলেছে। রোদ ছড়ালে বা জ্যোৎস্না ঝরলে নদীর পানি রুপোর মতো ঝিকমিক করে। ...নদীর পাড় ঘেঁষে কাশবন, ধান-পাট-আখ ক্ষেত, সারিসারি খেজুর, তাল-নারকেল-আমলকি গাছ, বাঁশ-কলাগাছের ঝাড়, বুনো লতাপাতার জংলা, সবুজ ঘন ঘাসের চিকন লম্বা লম্বা সতেজ ডগা। শালিক-চড়–ই পাখিদের কল-কাকলি, ক্লান্ত দুপুরের ঘুঘুর ডাক। সব মিলিয়ে ভীষণরকম ভালালাগার এক টুকরো ছবি যেন। আশ্বিনের এক সোনালী রোদ্দুর ছড়ানো দুপুরে এ টুঙ্গীপাড়া গ্রামে আমার জন্ম। গ্রামের ছায়ায় ঘেরা, মায়ায় ভরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও শান্ত নিরিবিলি পরিবেশ এবং সরল-সাধারণ জীবনের মাধুর্য্যের মধ্য দিয়ে আমি বড় হয়ে উঠি।


আমার শৈববের স্বপ্ন-রঙিন দিনগুলো কেটেছে গ্রাম-বাংলার নরমপলিমাটিতে, বর্ষার কাদা-পানিতে, শীতের মিষ্টি রোদ্দুরে, ঘাসফুল আর পাতায় পাতায় শিশিরের ঘ্রাণ নিয়ে, জোনাক-জ্বলা অন্ধকারে ঝিঁঝিঁর ডাক শুনে, তাল-তমালের ঝোপে বৈচি, দীঘির শাপলা আর শিউলি-বকুল কুড়িয়ে মালা গেঁথে, ধুলোমাটি মেখে, বর্ষায় ভিজে খেলা করে। ...বৈশাখে কাঁচা আম পেড়ে কুচি কুচি করে কেটে সর্ষেবাটা ও কাঁচা মরিচ মাখিয়ে, তারপর কলাপাতা কোনাকুনি করে সে আম মাখা পুরে, তার রস টেনে খাওয়ার মজা ও স্বাদ আমাকে এখনও আপ্লুত করে রাখে। কলাপাতায় এ আম মাখা পুরে যে না খেয়েছে, কিছুতেই এর স্বাদ বুঝবে না।


১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন


রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ৪ঠা মার্চ। সেদিন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে লিফলেট বিলি করা হয়। সেই লিফলেটের অন্যতম স্বাক্ষরদাতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ই মার্চ প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট আহ্বান করা হয়। ধর্মঘটের সমর্থনে জনমত গঠনের লক্ষ্যে শেখ মুজিব ফরিদপুর, যশোর, খুলনা ও বরিশালে ছাত্রসভা করেন। ঢাকায় ফিরে ১০ই মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে এক সভায় ১১ই মার্চের হরতালের কর্মসূচিতে কারা, কোথায় ও কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন তা ঠিক করে দেন। শেখ হাসিনা সম্পাদিত পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়:


Secret information was received on 12.3.48 that the subject(Bangabandhu) along with others took part in the discussions held at Fazlul Haq Hall on 10.3.48 and gave opinion in favour of violating section 144 Cr.p.c. on 11.3.48. On this decision, small batches of Hindu and Muslim students were sent out on 11.3.48 to picket the G.P.O., the secretariat and other important Govt. offices. The subject [Sheikh Mujibur Rahman] was arrested on 11.3.48 for violating the orders. ...He took very active part in the agitation for adopting Bengali as the State language of Pakistan...8


১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে ভাষা আন্দোলন যৌক্তিক পরিণতি লাভ করে এবং পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষের মনে এই আন্দোলন গভীর ছাপ ফেলে। শেখ হাসিনার শিশুমনের উপরও এর প্রভাব পড়ে। ১৯৫২ সালের ২৭শে ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জেল থেকে মুক্তি পেয়ে টুঙ্গিপাড়ায় গেলে শিশুকন্যা শেখ হাসিনা পিতাকে জড়িয়ে ধরে কচিকণ্ঠে ভাষা আন্দোলনের শ্লোগান দেন। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: [কারামুক্তির] ‘পাঁচ দিন পর বাড়ি পৌঁছলাম।...হাচু আমার গলা ধরে প্রথমেই বলল, ‘আব্বা, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই।...২১শে ফেব্রুয়ারি ওরা ঢাকায় ছিল, যা শুনেছে তাই বলে চলেছে।’শিশুকাল থেকে লালিত মায়ের ভাষার প্রতি শেখ হাসিনার ভালোবাসার ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে ১৯৯৯ সালে আমাদের শহীদ দিবস রক্তে রাঙানো ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের জন্যে ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃতি লাভের মধ্যে দিয়ে। এই স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে তিনি ব্যাপক কূটনৈতিক উদ্যোগের গ্রহণ করেন। শেখ হাসিনার ভাষায়:


১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সদস্যপদ প্রাপ্তির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে নিউইর্য়ক যাই। জাতিসংঘ রজতজয়ন্তী উদযাপন করি। জাতিসংঘের মহাসচিব এবং অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধানদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনও উপস্থিত ছিলেন। ...জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালি জাতির অবদানের কথা বিশেষভাবে তুলে ধরি। মাতৃভাষাকে আমরা কত ভালোবাসি তা গর্বভরে উল্লেখ করি। ...নিউইর্য়ক থেকে আমি প্যারিস যাই ইউনেস্কো কর্তৃক শান্তি পুরস্কার গ্রহণের জন্য। ২৪ সেপ্টেম্বর আমাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। ইউনেস্কোর প্রধানের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বিষয়ে আলোচনা করি। ২১ ফেব্রুয়ারির কথাও উল্লেখ করি। ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ সম্মেলনে সর্বসম্মতিভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়।


কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের আন্দোলন-সংগ্রাম


ঢাকার গভর্নমেন্ট ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (আজকের সরকারি বদরুন্নেসা কলেজ) বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্যে ভালোই কাটছিলো তাঁর নানা রঙের দিন। ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়ে কলেজে শহীদ মিনার স্থাপনের আন্দোলনের নেতৃত্বদান তাঁর জীবনের পথ ঘুরিয়ে দেয়। গ্রেফতারের হুমকিও দেয়া হয় তাঁকে। তবে তাঁকে নানাভাবে দমিয়ে রাখার লক্ষ্যে কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনো চেষ্টাই সফল হয় নাই। সেই সময় কলেজ থেকে স্বল্প দূরত্বে নাজিমুদ্দিন রোডের কারাগারে তাঁর পিতা শেখ মুজিব বন্দি ছিলেন। গ্রেফতারের হুমকির প্রতিক্রিয়ায় শেখ হাসিনার উপলব্ধি ছিলো এরকম:


আমাদের আন্দোলন বেশ তুঙ্গে। শহীদ মিনার আমাদের চাই। ঢাকার ডিসিকে প্রিন্সিপাল খবর দিলেন। আমাকে হুমকি দিলেন অ্যারেস্ট করার। আব্বা তখন জেলে, নাজিমুদ্দিন রোড বকশীবাজার থেকে বেশি দূরে না। চার আনা রিকশা ভাড়া লাগে। প্রায় ১৫ দিন পরপর আব্বার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পেতাম। কলেজ থেকে প্রায়ই যেতাম। আমাকে যখন হুমকি দেওয়া হলো গ্রেপ্তারের, বললাম, আপত্তি নেই। কারণ প্রায়ই তো যাচ্ছি। আর আব্বা যখন ভেতরে আছেনই আমি যাব জেলে।


কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রনেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, বাঙালির মুক্তির সনদ ছিষট্টির ছয় দফার সংগ্রাম এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানসহ সকল ছাত্র-গণআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সেই উত্তাল সময়ের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরেছেন তাঁর ‘সংগ্রামে আন্দোলনে গৌরবগাথায়’শিরোনামের লেখাটিতে। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ফাঁসির ভয় দেখিয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাবার প্রস্তাব করেন, তখন পিতার রাজনৈতিক সহযাত্রী প্রজ্ঞাময়ী মা ফজিলাতুননেছা কন্যা শেখ হাসিনাকে দিয়ে লিখিত বার্তা পাঠিয়েছিলেন কারাবন্দি বঙ্গবন্ধুর কাছে। কিন্তু সেদিন সেই বার্তা না দিতে পেরে কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা শুধু বলে আসতে পেরেছিলেন যে: ‘মা দেখা করার চেষ্টা করছেন। মার সাথে দেখা না করা পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না’। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি অবস্থায় সন্ধ্যায় নিয়মিত হাঁটার সময় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যার চক্রান্তও করেছিলো সামরিক জান্তা আইয়ুব খান। যা হোক, এভাবে প্রাথমিক প্রচেষ্টায় ব্যর্থ প্যারোলপন্থীরা বঙ্গমাতা ফজিলাতুননেছা মুজিব ও শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করেছিলেন। এখানে মাতা-কন্যার দৃঢ়তা ও আবেগঘন কথাগুলো পাঠকের জন্যে উল্লেখ করা অপরিহার্য:


আমি যখন ফিরে এলাম অনেকে আমার সাথে আমাদের বাড়িতে ফিরে এলেন এবং আমার মাকে দোষারোপ করলেন। তারা ভয় দেখাচ্ছিলেন যে, আপনি এত কঠিন, আপনি জানেন না যে ওনাকে ফাঁসি দেবে, ফাঁসি দিয়ে মেরে ফেলবে। আমার মা বলেছিলেন যে, “বিধবা হলে তো আমিই হবো আর পিতা হারালে আমার সন্তানরা হারাবে। আপনারা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সারা বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে পদদলিত করে তিনি প্যারোলে যেতে পারেন না।” এরপর এলো আমার ওপর আক্রমণ। আমাকে তারা বললেন, তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাও না তোমার বাবা ফেরত আসুক? আমি শুধু একটি কথাই বলেছিলাম যে, “হ্যাঁ, আমি চাই, আমার বাবা আমার মতো উঁচু করে ফিরে আসবেন। আমার বাবা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটিই সঠিক সিদ্ধান্ত। আপনারা অযথা বাবাকে বিরক্ত করবেন না।” আমি মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার মা আমাকে সান্ত¡না দিয়েছিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন যে, “কিছুই হবে না। তোমার বাবা মাথা উঁচু করে ফিরে আসবেন।”


বঙ্গবন্ধু মুজিবের সঠিক সিদ্ধান্তেÍ সেদিনই নির্ধারিত হয়ে যায় হাজার বছরের পরাধীন বাঙালির ভাগ্য অর্থাৎ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ ধরে সেই বাংলাদেশ আজ শেখ হাসিনার হাতের ছোঁয়ায় পত্র-পল্লবে ও ফুলে-ফলে প্রতিদিন বিকশিত হয়ে চলেছে।


একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস


বঙ্গবন্ধু ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের মধ্যে দিয়ে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতায় অভিষিক্ত হন এবং ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক ভাষণে পরাধীন বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। অতঃপর ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সেদিনই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রাখে। বাঙালির প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিব ফাঁসির দ- মাথায় নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুণতে থাকেন। প্রিয় দুই ছোটো ভাই শেখ কামাল ও শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। এমন বিধ্বস্ত মানসিক অবস্থার মধ্যে মমতাময়ী মা বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব, স্নেহের ছোটো বোন শেখ রেহানা, আদরের ভাই শেখ রাসেল, চার মাসের শিশুপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস কীভাবে অসহনীয় মৃত্যুভীতি ও যাতনার মধ্যে কেটেছে মুজিব পরিবারের সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার খ-চিত্র পাই আমরা শেখ হাসিনার লেখায়:


সমগ্র দেশটাই ছিল এক বন্দিশালা। এরই মাঝে জীবনের ধ্বনি যেন পাওয়া যেত, যখন শোনা যেত কোনো মুক্তিযোদ্ধার গুলি বা বোমার শব্দ... তাদের যে কেনো আক্রমণ বা গ্রেনেড ফোটার বিকট শব্দ হলেÑ শত্রুপক্ষ সন্ত্রস্ত হতোÑ মনে হতো আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকবো, আমাদের অস্তিত্ব এখনও আছে। অমৃতের বরপুত্র এই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের যেন নতুন করে জীবন দান করে যেত।


আমরা যে বাড়িটাতে বন্দি ছিলাম তার ছাদের উপর দুদিকে দুটো বাঙ্কার করে মেশিনগান বসানো হয়েছে। এছাড়া আরও একটা বাঙ্কার গ্যারেজের ছাদে করা হয়েছে। বাগানের মাটি কেটে ট্রে খোঁড়া হয়েছে। দিনরাত গুলির আওয়াজ। যখন বিমান আক্রমণ হয় তখন সব সৈন্য ঢুকে যায় এবং বাঙ্কারে গিয়ে দাঁড়ায়। কেবল আমরা যারা বন্দি আমাদের মৃত্যুর প্রতীক্ষায় প্রহর গুণতে হয়। চার মাসের জয়কে নিয়ে হয়েছে অসুবিধা। বিছানায় শোয়ানো যায় না, গুলির আওয়াজে কেঁপে ওঠে। রাসেল পকেটে তুলো রাখে। ওর কানে তুলো গুঁজে দেয়, যাতে গুলির আওয়াজে কানের পর্দা ফেটে না যায়।


গত কয়েক দিন থেকে সীমাহীন দুর্দশায় সময় কাটছে আমাদের। মৃত্যুর মুখোমুখি যেন। যখনÑতখন মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে ওরা হাজির হতে পারে। সারা দিন সারা রাত এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্য দিয়ে কাটাতে হচ্ছে। আব্বা কি বেঁচে আছেন? কোথায় কি অবস্থায় আছেন কিছুই জানি না। কামাল, জামাল, নাসের কাকা, মণিভাইসহ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, আওয়ামী লীগের, ছাত্রলীগের সবাই তো মুক্তিযুদ্ধে। কে আছে, কে নেই, কোনো খবর জানা নেই। যদিও এই বন্দিদশার মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কিছু যোগাযোগ ছিল, কয়েকদিন থেকে তাও একেবারেই বিচ্ছিন্ন। চারদিকে এতো প্রতিধ্বনি রেডিওতে শুনেছি দেশের প্রায় সব এলাকা স্বাধীন, মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে। ভারতীয় বাহিনীর সৈন্যদের সাথে তারা এখন ঢাকার পথে মার্চ করে চলেছে। আওয়ামী লীগ নেতা, কর্মী, ছাত্রলীগের সাথীরা কে কোথায় কি অবস্থায় রয়েছে জানি না।


মা তাঁর দুই ছেলেকে দেশমাতৃকার মুক্তির যুদ্ধে উৎসর্গ করেছেন; পিতা দুই হাজার মাইল দূরে শত্রুর কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন; সকল স্বজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন পরিবারের অন্যদের নিয়ে মৃত্যু অথবা মুক্তির প্রতীক্ষায় ঢাকায় গৃহবন্দী। দেশের একাত্তরের পরের বা আজকের নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মুজিব পরিবারের এমন ভয়াবহ ও দুঃসহ করুণ ইতিহাস প্রত্যক্ষদর্শী শেখ হাসিনা রচিত ভাষ্য ছাড়া আর কার কাছে ও কোথায় পাবো আমরা?


দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি


১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু জাতীয় সংসদে ৭ই মার্চের পরে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ ভাষণে বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা তুলে ধরেন। তখন ষড়ন্ত্রকারীরা গণতন্ত্রহরণের খোড়া যুক্তি দেখিয়ে গরীবের মুক্তির কর্মসূচির বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব রটিয়ে বাংলার মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে এবং দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ফলে ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হন। স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি ও তৎকালীন আন্তর্জাতিক আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচির ঘোষণাকে বঙ্গবন্ধু হত্যার অজুহাত হিসেবে তুলে ধরে। স্বাধীনতা বিরোধী ও কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্টীর অপপ্রচারের জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর লেখায় বলেছেন:


বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের একটা লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্য মূলত গরিব-দুঃখী মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন। অন্তত প্রতিটি মানুষের জীবনের ন্যুনতম চাহিদা ভাত, কাপড়, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, ও কাজের ব্যবস্থা করা।... সেই লক্ষ্য সামনে রেখে বঙ্গবন্ধু এক মে র ডাক দিয়েছিলেন। ...দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দিয়েছিলেন। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি আনতে চেয়েছিলেন। সেটা কি অপরাধ ছিল?


এই সময়ের বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করলে শেখ হাসিনার উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর আমরা দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণার পর ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে পাই:


...শিক্ষিত সমাজের কাছে আমার একটি কথা, শতকরা কতজন শিক্ষিত লোক। তার মধ্যে শতকরা পাঁচজন আসল শিক্ষিত। শিক্ষিতদের কাছে আমার একটি প্রশ্ন, আমি এই যে কথা বলছি, আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে করা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান করে কারা? এই আমরা, যারা শতকরা পাঁচজন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যে আছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্র সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে।


আজ দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, পরিবহন, ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সকল ক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি ও বিদেশে অর্থ পাচারের ঘটনা আমরা প্রতিদিন যেভাবে প্রত্যক্ষ করিÑ বঙ্গবন্ধু তা সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। আমরা আশান্বিত হই যে, বঙ্গবন্ধুকন্যা সামজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় দরিদ্র মানুষের ঘরবাড়ি, বয়স্কভাতা, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অ লের মানুষের স্বাস্থ্য ও প্রযুক্তিসেবাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে বঙ্গবন্ধুর ‘দুঃখী মানুষে’র মুখে হাসি ফোটানোর ব্রত নিয়ে দেশের শাসক নয়Ñ সেবক হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।


পনেরই আগস্টের শোক, শক্তি ও সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন


সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের কাক্সিক্ষত ফসল আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা, প্রিয় বাংলাদেশ। তিরিশ লক্ষ শহীদের অমূল্য জীবন আর প্রায় দুইলক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ যখন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিলো, তখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীরা ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে। বিদেশে অবস্থান করায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর প্রিয় দুইকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাঙালি জাতি নিক্ষিপ্ত হয় ঘোর কালো অন্ধকারে। শুরু হয় স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির ক্রমবর্ধমান উত্থান। একে একে ধ্বংস হতে থাকে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সকল সাফল্য। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার উক্তি প্রণিধানযোগ্য:


১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঠিক ফজরের নামাজের সময় ধানমন্ডির বত্রিশ নং সড়কের বাড়িতে ইতিহাসের কলঙ্কতম অধ্যায় রচিত হয়। ঘাতকের দল বাঙালির জাতির মহানায়ক বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ঘাতকের হাত থেকে শিশু-নারীরাও রেহাই পায় নি। এ হত্যাকা-ের মধ্যদিয়ে জনগণের নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়।


১৯৭৫-এর ৩০শে জুলাই জার্মানির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের পূর্বে এম. এ. ক্লাশের ছাত্রী শেখ হাসিনা ছুটির প্রয়োজনে ও ‘আশীর্বাদ চাইবার ইচ্ছায়’ ছোটো বোন শেখ রেহানা ও ভ্রাতৃবধু রোজী জামালকে সাথে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। উপাচার্য তাঁকে ১৫ই আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনের দিন পর্যন্ত দেশে থেকে যেতে বলেন। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনার লেখা পড়লে সর্বদেহমন বেদনায় হিম হয়ে আসে:


...এর মাত্র পনেরোটা দিনের মধ্যে যে নারকীয় ঘটনা ঘটে গেল, আমি তার জন্য কখনোই প্রস্তুত ছিলাম না। এতো বড় রোজকিয়ামত আমি কোনো দুঃস্বপ্নেও দেখি নি। এ আমি ভাবি নি। ...১৫ তারিখে আমার বাবা, মা, তিন ভাই, চাচা, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে আমি হারালাম। ঐ দিনটি আমার জন্য যেমন ছিল, এমন দিন যেন কারও জীবনে কখনই না আসে। আমার ছোট বোন রেহানা তখন আমার সঙ্গেই জার্মানীতে ছিল।... মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন যদি স্যারের কথা অমান্য না করে ঢাকায় থেকে যেতাম, আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। বেঁচে থাকা এই জীবনটাতে যে কি যন্ত্রণা, তা লিখে প্রকাশ করার ক্ষমতা আমার নেই। প্রিয় পাঠক, সে আমি বোঝাতে পারছি না। সব হারিয়ে এমন বেঁচে থাকতে তো আমি চাই নি। এই যে প্রতিদিন পলে পলে দগ্ধ হওয়া, এই যে সকল হারানোর প্রচ- দাবদাহ সমস্ত অন্তর জুড়ে, এই যে, তুষের আগুনের ধিকিধিকি জ¦লুনির জীবন, এ জীবন তো আমি চাই নি। এর চেয়ে মা, বাবা, ভাইদের সঙ্গে যদি আমিও চলে যেতে পারতাম, তবে প্রতিেিদনের এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে তো বেঁচে যেতাম। আমার জন্য সেটাই ভালো হতো। আমি কেন যে তখন স্যারের নিষেধ শুনলাম না। সেই গ্লানি, সেই অন্তর্দাহ আজও আমাকে কুরে কুরে খায়। আমি নিয়তই সেই কেন’র জবাব খুঁজে ফিরি। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়। দলা-পাকানো বেদনায় আমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। স্মৃতির নিদারুণ কশাঘাতে আমি জর্জরিত হই।


প্রসঙ্গত শেখ হাসিনার ‘ড. আবদুল মতিন চৌধুরী: আমার স্মৃতিতে ভাস্বর যে নাম’ শীর্ষক লেখাটি বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সমাজের জন্যেও একটি শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয় অমূল্য দলিল। এই লেখায় একদিকে প্রতিষ্ঠানের রীতিনীতি ও শিক্ষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যার শ্রদ্ধাবোধ, অন্যদিকে একজন উপাচার্যের মর্যাদা, চিরায়ত শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক ও দেশপ্রেম কীভাবে বিশ^বিদ্যালয়কে উচ্চতার আসনে অধিষ্ঠিত করে তা দেশের জাতির পিতা এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর কন্যার বিনয়ী আচরণে উপলব্ধি করা যায়।


১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর থেকে সামরিক স্বৈরশাসনে নিষ্পেষিত প্রিয় মাতৃভূমির ঘোরতর সংকটকালে, ১৯৮১ সালে, মুক্তির বারতা নিয়ে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ান বাবা-মা-চাচা-ভাইসহ সকল স্বজন হারানোর ব্যথা-বিষে নীলকন্ঠ বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ছিন্ন করে, দীর্ঘ সময় ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি সামরিক স্বৈরাচারের নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে মুক্ত করেন বাঙালি জাতিকে। ১৯৮৩ সালের আগস্টে ‘বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সেনাবাহিনী’ শীর্ষক এক নিবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেন:


স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্য তাঁর [বঙ্গবন্ধুর] স্নেহ ও দায়িত্ব কম ছিল না। ...বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ক্ষমতার লোভে অভ্যুত্থানকারী ও তাদের দোসররা সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করছে তাদের প্রতিপক্ষরূপে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট এদেশে সূচনা করা হয়েছে হত্যার রাজনীতি। ...ক্ষমতার লড়াইয়ে এক-একটি সামরিক অভ্যুত্থানে যেমনি প্রাণ দিতে হয়েছে বীর সৈনিকদের তেমনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রামে গত এক দশকে শহীদ হয়েছে বহু ছাত্র-জননেতৃবৃন্দ।


প্রসঙ্গত সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৭ সালের ১০ই নভেম্বর ঢাকা অবরোধ দিবসে সাদা কালিতে বুকে ‘স্বৈরাচার নিপাত যাক’, পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ লেখা নূর হোসেনকে ডেকে আন্দোলনের নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেনÑ ‘জামাটি গায়ে দাও, একি সর্বনাশ করেছে। ওরা যে তোমাকে গুলি করে মারবে’। জবাবে নূর হোসেন বলেছিলোÑ ‘জান দিয়া দিমু আপা। আপনে শুধু আমার মাথায় হাত বুলাইয়া দ্যান’। বঙ্গবন্ধুকন্যা নূর হোসেনের কথার ভীষণ প্রতিবাদ করে বলেছিলেনÑ‘না জীবন দেবে ক্যানো? আমি আর শহীদ চাই না, গাজী চাই’। তারপর জামাটি গায়ে দিতে বলে তিনি নূর হোসেনের মাথাভরা কালো ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর জনতার স্্েরাতে হারিয়ে যায় নূর হোসেন! আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রামে যারাই শেখ হাসিনার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন সবাইকে তাঁর লেখায় স্মরণ করেছেন শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় ও মমতায়। কবি সুফিয়া কামাল থেকে শুরু করে শহীদ নুর হোসেন সবাই তাঁর স্মৃতির পাতায় দীপ্যমান। কবি সুফিয়া কামালের মাতৃস্নেহ, আশ্রয় ও অনুপ্রেরণার কথা লিখেছেন এভাবে:


যদি কখনও কখনও বিরক্ত হতাম ফুফুর [কবি সুফিয়া কামাল] কাছে গিয়ে বলতাম আর পারছি নাÑ আমি পার্টির পদ ছেড়ে দেব। ফুফু আমাকে বোঝাতেন, বলতেন, “তোর উপর অনেক বড় দায়িত্ব, এই দেশ তোর আব্বা স্বাধীন করেছেন এখন তাঁর আদর্শ বাস্তবায়ন তোকে করতে হবে। দেশের মানুষের জন্য তোকে কাজ করতে হবে। সাহস রাখ, তুই পারবি।”


২০০৭ সালে ১/১১-এর সেনাসমর্থিত তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসেই জননেত্রী শেখ হাসিনার নামে অসংখ্য মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা, বাঙালির নেত্রী, বাঙালির পিতা মুজিবের মতোই কোনো ভয়-ভীতি ও প্রলোভনের কাছেই মাথা নোয়ান নি। জোর করে বিদেশে রাখার অপচেষ্টা, বন্দি জীবনের একাকিত্ব ও অসুস্থতা তাকে এতটুকু দমাতে পারে নি। দলের বাঘা নেতাদের ভীরুতা, আত্মস্বার্থপরতা ও দায়িত্বহীনতার মধ্যেও অগণিত সাধারণ নেতা-কর্মী আর দেশের মানুষের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস ছিল দৃঢ়। অতি সম্প্রতি আর্মড ফোর্সেস সিলেকশন বোর্ড সভা ২০২০-এ এক বক্তৃতায় তিনি বলেছেন ‘মার্শাল ল’ রক্তপাত ছাড়া দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীর কোনো কল্যাণ বয়ে আনতে পারে না। তাই ‘সামরিক অভিধান’ থেকে আমাদের ‘মার্শাল ল‘ শব্দটি বাদ দেয়া উচিত।‘


উল্লেখ্য, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক দেশসমূহে সরকার পরিবর্তন হয় নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে; সে সকল দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়ে থাকে। এটাই গণতন্ত্রের রীতি। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, ১৯৪৭ সাল থেকে বাংলাদেশ ভূখ-ে ১৯৭৩ সালে একবার মাত্র বঙ্গবন্ধুর নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে শান্তিপূণভার্বে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়েছিলো। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হলো ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে শান্তিপূণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর। অতঃপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। তাই জননেত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্রের মানসকন্যা।


বঙ্গবন্ধুর বই ও গোয়েন্দা দলিলপত্র সম্পাদনা


বাঙালির ভাষা আন্দোলন থেকে বঙ্গবন্ধুর সকল রাজনৈতিক সংগ্রামের বস্তনিষ্ঠ তথ্য, সঠিক ইতিহাস ও অমূল্য দলিল বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী (২০১২), কারাগারের রোজনামচা (২০১৭), আমার দেখা নয়াচীন (২০২০) এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর ১৯৪৮ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তৈরি পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট


Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman


প্রকাশিত হওয়ায় আজ বাংলাদেশের ইতিহাসপাঠে, চর্চায় ও গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে।


প্রসঙ্গত, রাজনীতিক ও দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইস্টন চার্চিল তাঁর একটি উপন্যাস ও বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত ভাষণ-বক্তৃতা-বিবৃতির সংকলনের জন্যে ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। তারও পূর্বে ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তনকারী সম্রাট বাবরের আত্মজীবনী বাবুরনামাকে এশিয়ার একমাত্র সুলিখিত ও প্রাণবন্তু আত্মজীবনী রূপে উল্লেখ করা হয়। সেক্ষেত্রে আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশে^ রাজনীতির কবি অভিধায় অভিষিক্ত আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক সংগ্রাম, ভাষণ-বক্তৃতা এবং তিন খণ্ডের মহাকাব্যোপম আত্মজীবনী রচনাশৈলী ও কাব্যময়তার দিক থেকে রাজনৈতিক এবং আত্মজীবনী সাহিত্যে অমূল্য সংযোজনÑ যা নানা ভাষায় অনুদিত হয়ে আমাদের গৌরবান্বিত করে চলেছে।


জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনখানা মহাকাব্যিক গ্রন্থ এবং চৌদ্দ খণ্ডের (ইতিমধ্যে ছয় খণ্ড আমাদের হাতে এসেছে) Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman এর ভূমিকা ও মুখবন্ধ পাঠ করলে শেখ হাসিনার তীক্ষè অনুসন্ধিৎসা, অক্লান্ত পরিশ্রম, অপরিসীম ধৈর্য্য, গভীর নিষ্ঠা এবং সযত্ন প্রয়াসে যুগপৎ বিস্মিত ও আলোড়িত হতে হয়। সর্বোপরি, লেখক শেখ হাসিনা তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর শুরুতে যে কয়টি ‘ভূমিকা’ও ‘মুখবন্ধ’রচনা করেছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। যেমন অসমাপ্ত আত্মজীবনী-এর পান্ডুলিপি প্রস্তুতের সময়ের সতর্কতা ও আবেগঘন অনুভূতির কথা এখানে উল্লেখ্য:


আব্বার হাতে লেখা চারখানা খাতা। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খাতাগুলো নাড়াচাড়া করতে হয়েছে। খাতাগুলোর পাতা হলুদ, জীর্ণ ও খুবই নরম হয়ে গেছে। অনেক জায়গায় লেখাগুলো এত ঝাপসা যে পড়া খুবই কঠিন। একটা খাতার মাঝখানের কয়েকটা পাতা একেবারেই নষ্ট, পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত কঠিন। পরদিন আমি, বেবী মওদুদ ও রেহানা কাজ শুরু করলাম। রেহানা খুব ভেঙে পড়ে যখন খাতাগুলো পড়তে চেষ্টা করে। ওর কান্না বাঁধ মানে না। প্রথম কয়েক মাস আমারও এমন হয়েছিল যখন স্মৃতিকথা ও ডায়েরি নিয়ে কাজ শুরু করেছিলাম। ধীরে ধীরে মনকে শক্ত করেছি। প্রথমে খাতাগুলো ফটোকপি করলাম। ...এরপর মূল খাতা থেকে আমি ও বেবী পালা করে রিডিং পড়েছি আর মনিরুন নেছা নিনু কম্পোজ করেছে। ...সময় বাচাঁতে এই ব্যবস্থা।


একাত্তরে গৃহবন্দী মায়ের নির্দেশে শেখ জামাল, শেখ রেহানা ও শেখ রাসেলের স্কুলের বই-খাতা আনার নাম করে ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে রুলটানা খাতায় বঙ্গবন্ধুর হাতের লেখা কারাগারের রোজনামচা-এর পা-ুলিপি উদ্ধার করেন; এবং ১৯৮১তে খাতাগুলো যেভাবে পুনরুদ্ধার করেন তা শেখ হাসিনার বেদনাভরা লেখায় উঠে এসেছে:


১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের পর বাড়িঘর লুটপাট করে সেনাসদস্যরা। কী দুর্ভাগ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সেনারা জাতির পিতাকে হত্যা করে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। আর জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হলো ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে। ...১২ই জুন বাড়িটা আমার হাতে হস্তান্তর করে। প্রথমে ঢুকতে পা থেমে গিয়েছিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। ...যখন হুঁশ হয়, আমাকে দিয়ে অনেকগুলি কাগজ সই করায়। কী দিয়েছে জানি না যখন আমার পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে আসে তখন আমার মনে পড়ে আব্বার লেখা খাতার কথা, আমি হেঁটে আব্বার শোবার ঘরে ঢুকি। ড্রেসিং রুমে রাখা আলমারির দক্ষিণ দিকে হাত বাড়াই। ধূলিধূসর বাড়ি। মাকড়সার জালে ভরা তার মাঝেই খুঁজে পাই অনেক আকাক্সিক্ষত রুলটানা খাতাগুলি।...আমি শুধু খাতাগুলি হাতে তুলে নিই। ...আব্বার লেখাগুলি পেয়েছিলাম এটাই আমার সব থেকে বড় পাওয়া, সব হারাবার ব্যথা বুকে নিয়ে এই বাড়িতে একমাত্র পাওয়া ছিল এই খাতাগুলি। খুলনায় চাচির বাসায় খাতাগুলি রেখে আসি, চাচির ভাই রবি মামাকে দায়িত্ব দেই, কারণ ঢাকায় আমার কোনো থাকার জায়গা ছিল না, কখনো ছোট ফুফুর বাসা, কখনো মেজো ফুফুর বাসায় থাকতাম।


বঙ্গবন্ধুর ওপর তৈরি Secret Documents এ দেখা যায়, পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স ব্রা ১৯৪৮ সালের মার্চের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকে বঙ্গবন্ধুর ওপর কড়া নজরদারি শুরু করে এবং ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করে তা উর্ধতন কর্তৃপক্ষে কাছে প্রেরণ করে। এ বিষয়ে ইন্টেলিজেন্স ব্রা তাঁর নামে একটি ব্যক্তিগত ফাইল বা পিএফ খোলে এবং তাতে সকল তথ্য সংরক্ষণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাইলটির নম্বর ছিলো পি. এফ. ৬০৬-৪৮। এই Secret Documents of Intelligence Branch on Father of the Nation Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman এর মুখবন্ধ থেকে কিছু উদ্ধৃতি না দিলেই নয়:


... ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের ‘মার্শাল ল’ জারি ও ১৯৬৬ সালের ৬ দফা দাবি পেশ ও আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, জনগণের আন্দেলন, গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব সরকার কর্তৃক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, সকল বিষয়ের তথ্য পাওয়া যাবে। ...বহু দুর্লভ ও মূল্যবান তথ্যসমূহ আমরা পেয়েছি... যা বাংলাদেশ নামে ভূ-খ-ের স্বাধীনতার সংগ্রামের অমূল্য দলিল হিসেবে পাওয়া গেছে। ... একটা কথা সকলেরই জানা যে, বাংলাদেশের মানুষের অর্জন, দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা, এবং বাঙালির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট কর্মপন্থা নিয়ে রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।


আমার দেখা নয়াচীন-এর ভূমিকায় বর্ণিত পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটে মা হারানোর কষ্ট ও বেদনায় উথলে ওঠে বাঁধভাঙা অশ্রুজল! এই বই প্রকাশে বারবার তাঁর মায়ের স্মৃতি ভেসে ওঠে; মায়ের কথা মনে পড়ে। শেখ হাসিনা অশ্রুসজল চোখে লিখেন:


সবসময়ে আমার মায়ের কথাই মনে পড়ে। আমার মা যে কত রাজনীতি-সচেতন ছিলেন, কত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, আমার আব্বাকে তিনি লেখার প্রেরণা দিতেন। খাতাগুলি কিনে দিতেন আবার আব্বা যখন জেল থেকে মুক্তি পেতেন তখন খাতাগুলি সংগ্রহ করে সযতেœ রেখে দিতেন। তিনি নিশ্চয়ই আশা করেছিলেন যে এই লেখাগুলি একসময় বই আকারে ছাপা হবে। ...১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট কালরাতে বাবার সাথেই শাহাদত বরণ করেছেন। ঘাতকের বুলেটের নির্মম আঘাতে চিরদিনের মতো না ফেরার দেশে চলে গেছেন। ...আমার মা দেখে যেতে পারলেন না তাঁরই সযতেœ রাখা অমূল্য সম্পদ জনতার কাছে পৌঁছে গেছে। মায়ের কথাই সবসময় আমার মনে পড়ে। মাকে যদি একবার বলতে পারতাম, দেখাতে পারতাম আব্বার লেখাগুলি পুস্তক আকারে প্রকাশিত হয়েছে তাহলে কত খুশি হতেন। মা, তোমার কথাই বারবার মনে পড়ে মা।


পরিশেষ


বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা একদিকে স্বজন হারানো বুকে কষ্টের পাথর চেপে; পিতা মুজিবের মতোই অন্ধকার সময়ের সকল জটিল-কুটিল ষড়যন্ত্র, ভয়-ভীতি, প্রলোভন ও প্রতিনিয়ত মৃত্যুবাণ উপেক্ষা করে, দেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়ে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের পথে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন; অন্যদিকে বেদনামথিত হৃদয়ে দেশে-বিদেশে, কারা অভ্যন্তরেÑ এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার সীমাহীন ব্যস্ততা উজিয়ে চলমান রেখেছেন তাঁর লেখনি। শেখ হাসিনা রচিত গ্রন্থসমূহে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় বর্ণিত ঘটনাসমূহের তীব্র-তীক্ষè পর্যবেক্ষণ যেমন আমাদের নতুন পথের সন্ধান দেয়; তেমনি মুজিববর্ষে ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শতবর্ষ স্মারকগ্রন্থ’সহ তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থ ও গোয়েন্দা দলিলপত্র উত্তর প্রজন্মের জন্যে বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজবাস্তবতার গতিগথ অনুধাবনে সচেতন ও সতর্ক হতে সহায়তা করে। তাই, শেখ হাসিনা রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসমূহ পাঠ করা আমাদের জন্যে অপরিহার্য। আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারিÑ সত্য ইতিহাসের আলোকে মূলধারার রাজনীতির গবেষক, শিক্ষার্থী, নাগরিক সমাজ, এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী পৃথিবী সকল প্রান্তের পাঠক-গবেষকের জন্যে ইতিহাসের এই বিশাল তথ্যভা-ার উপহার দিয়ে তিনি আমাদের অপরিশোধ্য ঋণে আবদ্ধ করলেন। লেখক ও সম্পাদক শেখ হাসিনার কাছে আমাদের ঋণ ও কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। শেষ করি রবীন্দ্র সংগীতের দুটি চরণ উচ্চারণ করে:


অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো


সেই তো তোমার আলো!


সকল দ্বন্দ্ব-বিরোধ মাঝে জাগ্রত যে ভালো


সেই তো তোমার ভালো।।


শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে বাংলা একাডেমির সেমিনারে পঠিত।


বিবার্তা/জাই

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com