শিরোনাম
প্রণবদা অন্তর দিয়ে বারবার যে আকুতি জানাতেন
প্রকাশ : ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১১:৫৭
প্রণবদা অন্তর দিয়ে বারবার যে আকুতি জানাতেন
পীর হাবিবুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

একদিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অস্ত্রোপচার, আরেকদিকে করোনার ভয়ঙ্কর সংক্রমণ, সব মিলিয়ে ডিপ কোমায় চলে গেলে তিনি আর ফিরে আসবেন না, এমন আশঙ্কাই করছিলেন সবাই। সে আশঙ্কাকেই সত্যি করে, নিয়তির কাছে হেরে গিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতির সফলতম বর্ষীয়ান নেতা ও প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি শেষ নিঃশ্বাস ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। ৩১ আগস্ট দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারালেই একটি বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটল। বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। সোমবার বিকাল পৌনে ৬টা নাগাদ তাঁর ছেলে সাবেক কংগ্রেস এমপি অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুইট করে এ খবর দিলে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। কংগ্রেস রাজনীতির ‘ক্রাইসিস ম্যানেজার’ বলা হতো তাঁকে। রাজনীতির জটিল সমস্যার সরল সমাধান টানার এক অনবদ্য কারিগর ছিলেন তিনি। তাঁকে তাই রাজনীতির চাণক্য বলা হতো।


অভিজিৎ তাঁর টুইটে লিখেছেন, ‘গোটা দেশের মানুষের প্রার্থনা, আর হাসপাতালের চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও আমার বাবা প্রণব মুখার্জি একটু আগে মারা গেছেন। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ।’


ভারত সরকার সাত দিনের শোক ঘোষণা করেছে। সব মত-পথের নেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর জন্য এখানেও শোকের ছায়া নেমে এসেছে। যুদ্ধদিনের পরম বন্ধুর জন্য শেখ হাসিনার সরকার এক দিনের শোক ঘোষণা করেছে। রাষ্ট্রপতি ভবনেই এ মহান নেতার সঙ্গে আমার চারবার দেখা হয়েছে। আমি তাঁর মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম। আপন করে নেওয়ার সম্মোহনী শক্তিই নয়, তাঁর পড়াশোনার অগাধ পা-িত্য, ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বিনয়ী ব্যবহার ও প্রখর মেধা আর স্মৃতিশক্তিই আমাকে অভিভূত করে রাখত। ভারতের ছোটবড় সব দলের নেতার সঙ্গেই ছিল তাঁর নিবিড় যোগাযোগ। গান্ধী পরিবার অন্ধ আনুগত্যের দিকে না তাকিয়ে সেদিন যদি কংগ্রেস শাসনকালে প্রণব মুখার্জিকে প্রধানমন্ত্রী আর ড. মনমোহন সিংকে রাষ্ট্রপতি করত তাহলে হয়তো কংগ্রেসের বিগত দুটি নির্বাচনে এমন ভরাডুবি ও রাজনীতিতে করুণ পরিণতি হতো না- এমনটা আমার একান্ত পর্যবেক্ষণই নয়, বিশ্বাসও। ভারতের গণতন্ত্রের মহান নেত্রী ও শক্তিশালী কংগ্রেসের দুঃসাহসী সংগঠক ইন্দিরা গান্ধী বাঙালি এই রতœটিকে চিনে জাতীয় রাজনীতির আলোয় জ্বলতে দিলেও তাঁর মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর, ক্ষমতার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের গোষ্ঠীতন্ত্রের বলির শিকার হতে হয় প্রণব মুখার্জিকে।


রাজীব গান্ধী যেমন তাঁকে চিনতে ভুল করলেন তেমনি সোনিয়া-রাহুলও কি তাঁর প্রাপ্য জায়গা দিতে পারেননি? ভবিষ্যৎ রাজনীতিই এ প্রশ্ন আরও খোলাসা করবে। তবে তিনি শত ঝড়-ঝাপটার মধ্যেও সরকার ও জাতীয় রাজনীতিতে বারবার জায়গা করে প্রমাণ করেছেন তাঁর যোগ্যতার উচ্চতা কতটা ছিল। প্রণব মুখার্জির গ্রহণযোগ্যতা কতটা দলের বাইরেও ছিল তা সহজেই বোঝা যায়। তুমুল জনপ্রিয়তায় নিজের ক্যারিশমা নিয়ে দিল্লির মসনদে বিপরীত মেরু থেকে আসা নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েও তাঁর চরণধূলি নিয়েছেন। মমতাসহ সবাই শ্রদ্ধার সম্পর্ক রেখেছেন। একজন উদার গণতন্ত্রী প্রণব মুখার্জির দরজা সবার জন্য খোলা ছিল। তিনি গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। সহিংসতা-সংঘাতের চরম বিরোধী যুক্তিতর্কনির্ভর রাজনীতিবিদ ছিলেন।


রাষ্ট্রপতি ভবনের দরজাও প্রণব মুখার্জি সবার জন্য খুলে দিয়েছিলেন। এ দেশের অনেক রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন জনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। প্রথমবার এক ঘণ্টার বৈঠকেই বলেছিলেন, মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও বাঘা তাঁর বোন ও ভাই। বাঘা মানে বীর মুক্তিযাদ্ধা কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। বলছিলেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে সপ্তায় দুবার তাঁর কথা হয়। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে ৪৫ মিনিটের আলাপে তিনি জানান, শেখ হাসিনা তাঁর জন্য বই পাঠান। সেলিনা হোসেনের ‘আগস্টের একরাত’ তাঁর কাছে ভগবদ্গীতা। তিনি এটা বারবার পড়েন। বাঘা সিদ্দিকী ’৮৬ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় নামার আগে একটি পানির জার দিয়েছিলেন। সেটি নির্বাচনে ব্যবহার ছাড়াও তিনি যতেœর সঙ্গে তুলে রেখেছেন। আমার বিশ্বাস, প্রণব মুখার্জিকে নিয়ে সেরা লেখাটি শেখ হাসিনা ও কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমই লিখতে পারবেন। তৃতীয়বার দেখা করতে গেলে তাঁকে অনেক বই দিয়ে এসেছিলাম। হুমায়ূন আহমেদের জোছনা ও জননীর গল্প, সেলিনা হোসেনের গায়ত্রী সন্ধ্যা, ইমদাদুল হক মিলনের নূরজাহান, আবু হাসান শাহরিয়ারের জীবনানন্দ দাশও ছিল। বাংলাদেশের লেখকদের সম্পর্কেও তাঁর উচ্চ ধারণা ছিল।


এমনিতেই উপমহাদেশের এমন একজন রাজনীতিবিদের মৃত্যু বেদনার। করোনাকালে হওয়ায় তা আরও বিষাদময়। এ করোনার পর যতবার দিল্লি যাব মনে হবে খুব একজন অতি প্রিয় শ্রদ্ধার আপন মানুষ আমার হারিয়ে গেছেন। একটা ঠিকানা হারিয়ে ফেলেছি। শেষবার যখন দিল্লি গেলাম তখন তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি। দেখা হয়নি, কারণ তিনি তখন পশ্চিমবঙ্গে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধীর পর বাঙালি রাজনীতিবিদ সিদ্ধার্থ শংকর রায়, জ্যোতি বসু এ দেশের জন্য যে প্রেম রাখতেন তাঁদের পর শেষ ঠিকানা ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সেটিও হারিয়ে গেল।


আমরা ১২ জন সিনিয়র সাংবাদিক ২০১৩ সালে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লি গিয়েছিলাম। ১৫ সেপ্টেম্বর সকালেই আমরা নামলাম ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। তখন কংগ্রেস জোটের ড. মনমোহন সিং সরকারের টানা দুই মেয়াদের শাসনকালের পড়ন্ত বিকাল। রাজনৈতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বিজেপিকেও ছাপিয়ে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতায় আসার পূর্বাভাস। ভারতের রাজনীতির প্রতিভাবান প্রবাদপুরুষ প্রণব মুখার্জি তখন রাষ্ট্রপতি। আমার হৃদয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু বলেই শ্রদ্ধা ভালোবাসায় ‘প্রণবদা’ হয়েই ঠাঁই নিয়ে আছেন। মনমোহন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন সুদর্শন সালমান খুরশিদ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন উপসচিব আমাদের আন্তরিকভাবে দেখভাল করছেন। আমাদের তোলা হলো শাংগৃলা হোটেলে। দুপুরের খাবার খাইয়ে দিল্লির কুতুব মিনারসহ শহরের নানা দিক ঘুরিয়ে আনা হলো। খান মার্কেটে গিয়ে ডলার ভাঙিয়ে দিল্লি প্রেস ক্লাবে আড্ডাও দিয়ে এলাম।


যাক, দিল্লি আসব আর প্রণবদার সঙ্গে দেখা হবে না তা কি হয়? আগেই ব্যবস্থা করেছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের একসময়ের সভাপতি প্রদ্যুৎগুহ তখন তাঁর একান্ত সচিব। এখন দুবাই থাকেন। আমি তখনো বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক। কলাম লেখায় পাঠক মন কাড়লেও রক্তে রিপোর্টিংয়ের নেশা। রিপোর্টিং জীবন আমার জীবনের সেরা সময়। রাতে হোটেলে ফিরতেই রাষ্ট্রপতি ভবনের টেলিফোন। প্রণব মুখার্জি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফিরেছেন। কাল বেলা ২টায় রাষ্ট্রপতি ভবনে আমার আমন্ত্রণ। আমার গাড়ির নম্বরটি জানাতে হবে। আমি এনাম ভাইকে বললাম একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে। ফোন নম্বর দিন। ভাড়া গাড়ির নম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়ে দিলাম। এদিকে গাইড বললেন সকালে নাশতা সেরেই নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের বৈঠক। তারপর বেলা ১টায় একটি হোটেলে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক কজন হাইকমিশনার, সিনিয়র সাংবাদিকসহ চিন্তাশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে মতবিনিময় ও মধ্যাহ্নভোজ। ৩টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বৈঠক।


সকালে নাশতা করে সবাই যখন গাড়িতে উঠলেন আমি তখন বললাম মাথায় পেইন। রেস্ট নেব। গাইড দুপুরের বৈঠকে এসে নেবেন কিনা জানতে চাইলে না করে দিলাম। বললাম, ৩টায় আমি সাউথ ব্লকে আসব, আপনাকে কল করলে কষ্ট করে রিসিভ করবেন। তিনি সম্মত হলেন। দুপুরে খেয়ে আমি দেড়টার দিকে রাষ্ট্রপতি ভবনে রওনা হলাম। রাষ্ট্রপতি ভবন পর্যন্ত কঠোর নিরাপত্তা। কিন্তু কোথাও কোনো প্রশ্ন নেই। গাড়ির নম্বরই পরিচয়। ২টার একটু আগেই পৌঁছে গেলাম। সামরিক সচিব অভ্যর্থনা জানালেন। পাশের রুমে বসালেন। জলখাবারে হরেক রকম মিষ্টির আয়োজন। ঠিক ২টায় রাষ্ট্রপতির কক্ষে নেওয়া হলো। প্রণব মুখার্জির কি বিনয় আর আন্তরিকতা! আমার মুগ্ধতার শেষ নেই। মানুষ যত বড় হয় ততই এমনই হয়। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে নেতৃত্বের মেধা জ্ঞান প্রজ্ঞা ধৈর্য আর সংগ্রাম তাঁকে এতটা বড় করেছে। তিনি সৌহার্দ্যপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। পরমতসহিষ্ণু ছিলেন। অন্যের মতামতের প্রতি শুধু শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না, সবাইকে সম্মান করার প্রবণতাও ছিল প্রবল। রাষ্ট্রপতি হওয়ায় স্যুট পরতেন। বলেছিলেন সফেদ পাঞ্জাবি ও ধুতিতেই জীবন কাটিয়েছেন স্বচ্ছন্দে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতায় ড্রেসকোড ফলো করতে হয়।


সেদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে টানা এক ঘণ্টা মুহূর্তে চলে গেল। প্রণবদার প্রখর স্মৃতিশক্তি আর পড়াশোনা ও জ্ঞানের পরিধি আমাকে সবচেয়ে মুগ্ধ করেছিল। এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া যেন। জীবনে যা পড়তেন হৃদয় দিয়ে পড়তেন। ফটোকপি হয়ে যেন মাথায় থাকত। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি, দর্শন, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সব বিষয়েই তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল বিস্ময়কর। তিনি একেক করে তথ্যবহুল কত ঘটনা বলছিলেন আমি অভিভূত হয়ে শুনছিলাম। আমি সুনামগঞ্জের প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মধুর সম্পর্কের গল্প করছিলাম। তিনি নড়াইলের জামাই। নড়াইলকন্যা শুভ্রা চক্রবর্তীকে ’৫৭ সালে বিয়ে করেছিলেন। সুখময় দাম্পত্য জীবন ছিল তাঁদের। নড়াইল যে আমার দ্বিতীয় প্রেমের শহর বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে সেটি উল্লেখ করে সেই শহরের বর্ণনা দিয়েছিলাম। চিত্রা নদী ও সুলতানের গল্পও করি। তিনি সুনামগঞ্জের গল্প শুনে বলেছিলেন, আমাদের এলাকার একজন মানুষ তাঁর বাবার কাছে যেতেন। তিনি সুনামগঞ্জ পাবলিক লাইব্রেরির সিলমারা রবীন্দ্রনাথের ‘চয়নিকা’ বইটি ফেলে আসেন তাঁদের বাড়ি। সেটি প্রণবদা ছোটবেলায় পড়েছেন। আমি অবাক তাঁর স্মৃতিশক্তির আরেকটি তথ্যে। ভিতরে এখনো কৌতূহল কে আমার শহরের সেই বিখ্যাত মানুষটি! তিনি বলেছিলেন, এখন তাঁর অখ- অবসর। রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছাড়া বাইরেও যান না। রাষ্ট্রপতি ভবনের লাইব্রেরিও সমৃদ্ধ। প্রচুর বই পড়েন। বই তাঁর সঙ্গী। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির কোনো সাক্ষাৎকার দেওয়ার রেওয়াজ নেই। প্রেস সচিবকেই যা বলার বলতে হয়। তিনি বই লিখছেন জানিয়েছিলেন, সেসব প্রকাশও হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধেই নয়, ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কারাগার থেকে দুই নেত্রীর মুক্তি ও গণতন্ত্র এবং নির্বাচন দিতেও ভূমিকা রাখেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নৃশংস হত্যাকা-ের পর দিল্লিতে নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার পাশেও দাঁড়ান। তিনি বলেছিলেন, তাঁর কাছে বিস্ময়কর এক শ্রদ্ধার নেতা ছিলেন আমাদের স্বাধীনতার মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সেদিন আরও বলেছিলেন, একাত্তরের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ তাঁর জীবনে দেখা এক বড় বিস্ময়কর ঘটনা। বলছিলেন, রাজপথের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পার্লামেন্ট, নয়াদিল্লির সব বিখ্যাত স্থাপনাই ব্রিটিশদের তৈরি। ১৯৫০ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি হন রাজেন্দ্র প্রাসাদ, এ ভবনের নাম হয় রাষ্ট্রপতি ভবন। প্রণব মুখার্জি প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়ে এখানে থাকেন ২০১২ সালের ২৫ জুলাই থেকে ২৪ জুলাই, ২০১৭, টানা পাঁচ বছর। উঠে আসার সময় বলেছিলেন, বাংলাদেশের মানুষকে আমার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেবেন। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক। এ কথা প্রতিবার বলেছেন। এটি তিনি অন্তর থেকে বলতেন। যেন এক আকুতি। এমন আন্তরিকতা নিয়ে আর কখনো বলবেন না।


রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে ১০ মিনিটেরও কম সময়ে চলে যাই সাউথ ব্লকে। গাইড রিসিভ করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ ছাড়াও তখনকার পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিংয়ের সঙ্গেও বৈঠক হয়। সেখান থেকেই ডে ইভেন্ট পাঠিয়ে নঈম নিজামকে জানাই প্রণবদার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। কালকেই পাঠাচ্ছি নিউজ।


’৭১ সালে প্রণব মুখার্জি বড় নেতা ছিলেন না। তবে ইন্দিরা গান্ধীর বার্তা নিয়ে রাজ্যসভার সদস্য হিসেবে ভারতীয় সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হয়ে প্যারিসে অনুষ্ঠিত আইপিইউর সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষে অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন। এ দেশ ও মানুষের জন্য তাঁর গভীর মমত্ববোধ ছিল। দুই দেশের উন্নতি, মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন এবং তিস্তাসহ সব সমস্যার সমাধান চাইতেন।


প্রণব মুখার্জির জন্ম ১১ ডিসেম্বর, ১৯৩৫ সালে। পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্নাহার শহরের নিকটস্থ মিরাটি গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায়, মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী। বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি ১০ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য হন। প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন; এ কলেজটি সে সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। তিনি ইতিহাস, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ডাবল এমএ ও আইনশাস্ত্রে ডিগ্রি নিলেও কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা করেন।


পা-িত্য আর পড়াশোনা তাঁকে বিদ্যানগর কলেজে শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতায় গেলেও রক্তই তাঁকে টেনে আনে রাজনীতিতে। ১৯৬৬ সালে বিদ্যানগর কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা হরেন্দ্রনাথ মজুমদারের হাত ধরে শুরু হওয়া রাজনৈতিক সফর প্রণবকে ভারতীয় নেতায় পরিণত করে।


১৯৬৯ সালে রাজ্যসভার সদস্য হয়ে সংসদীয় রাজনীতির ইনিংস শুরু করলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার নজরে পড়েন প্রণব। পরে তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ’৭৫ সালে কংগ্রেসের টিকিটে দ্বিতীয়বার রাজ্যসভার সদস্য হন প্রণব মুখার্জি। তার আগে, ’৭৩ সালে শিল্প প্রতিমন্ত্রী হিসেবে প্রথমবার ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় প্রবেশ। প্রণব মুখার্জি প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। এরপর ’৭৫, ’৮১, ’৯৩ ও ’৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।


ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ’৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ’৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাঁকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়। তাঁর এ মন্ত্রিত্বকালে ড. মনমোহন সিং ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। ইন্দিরা হত্যার পর রাজীব গান্ধী তাঁকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। কিছুকালের জন্য তাঁকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। এ সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ’৮৬-তে বের হলেও ’৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন। পরবর্তীকালে পি ভি নরসীমা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় তিনি ক্যাবিনেট মন্ত্রীরূপেও যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৯৫-৯৬ সালে তিনি রাওয়ের মন্ত্রিসভায় বিদেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ’৯৭ সালে তিনি শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত হন।


প্রণব মুখার্জি জাতীয় কংগ্রেসের পশ্চিমবঙ্গ শাখারও সভাপতি ছিলেন। ২০০৪ সালে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল জোট কেন্দ্রে সরকার গঠন করে। এ সরকারের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাজ্যসভার সদস্য হওয়ায় প্রণব মুখার্জি লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতার দায়িত্ব পান। উল্লেখ্য, এ বছরই তিনি প্রথমবার জঙ্গিপুর কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত হন।


প্রণব মুখার্জি বিভিন্ন সময় প্রতিরক্ষা, অর্থ, বিদেশ, রাজস্ব, জাহাজ-চলাচল, পরিবহন, যোগাযোগ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রকের মতো একাধিক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। তিনি সারা দেশের কংগ্রেস সাংসদ ও বিধায়কদের নিয়ে গঠিত কংগ্রেস সংসদীয় দল ও কংগ্রেস বিধানসভা দলেরও প্রধান। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাইপাস সার্জারির সময় তদনীন্তন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি রাজনীতিবিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেন। মনমোহন তাঁকে সেরা প্রশাসকের পুরস্কারেও সম্মানিত করেন।


২০০৬ সালের ২৪ অক্টোবর প্রণব মুখার্জিকে আবার ভারতের বিদেশমন্ত্রী করা হয়। তাঁকে ‘ভারতরতœ’ ও ‘পদ্মবিভূষণে’ও সম্মানিত করা হয়। প্রণব মুখার্জি মায়ের ভক্ত ছিলেন। তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন মা হচ্ছেন সবার শ্রেষ্ঠ আদর্শ শিক্ষক। রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি প্রথম বিদেশ সফর করেন বাংলাদেশে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন বক্তা তিনি যিনি বাংলায় বক্তৃতা করেন। আর ৪০ বছর পর তিনিই ভারতের রাষ্ট্রপতি যিনি ঢাকা সফর করেন। রাষ্ট্রপতি থেকে বিদায় নিয়েও তিনি বাংলাদেশে আসেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তা হন। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ই তাঁকে ডি.লিট উপাধি প্রদান করে। আর তিনি শুনিয়ে যান আমাদের বীরত্বের ইতিহাস। আমাদের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসার নির্মল হৃদয় স্পর্শ করা দরদ। উপমহাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রণব মুখার্জি অমর হয়ে থাকবেন, আমাদের তো তাঁকে ভুলে যাওয়ার সুযোগই নেই। বিদায়কালে বিনম্র শ্রদ্ধা প্রণবদা। যেখানেই থাকুন মাতৃকোলের মতোন শান্তিতে থাকুন।


লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।


বিবার্তা/এনকে

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com