শিরোনাম
হলি আর্টিজানে হামলা কি জিহাদ ছিল?
প্রকাশ : ০২ জুলাই ২০২০, ১৭:১৬
হলি আর্টিজানে হামলা কি জিহাদ ছিল?
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে একটি ভয়ঙ্কর হামলা সংঘটিত হয়। সেই ভয়াবহ সময়ের কথা আজও মনে পড়লে শিউরে উঠি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা এই প্রথম ছিল। পাঁচজন তরুণ এই হামলা পরিচালনা করেছিল। ইসলামের জিহাদের নাম করে আল্লাহু আকবর বলে হামলা করেছিল। ২২ জনকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করেছিল। চরম নিষ্ঠুরতা করেছিল ধর্মের নামে। আমি ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ লিখতে বসিনি। গুগলে সার্চ দিলেই এসংক্রান্ত সব তথ্য উঠে আসবে। অনাগত সময়ের জন্য সেই কালো রাত্রির সব বিবরণ সংরক্ষিত হয়ে আছে। আমি সেই ঘটনাকে সামনে রেখে তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিব।


এক. আমাদের দেশে কি জঙ্গিবাদ বলে কিছু আছে?


কেবল আমাদের দেশেই নয় সারা বিশ্বেই জঙ্গিবাদ আছে কি না এ নিয়ে সংশয় তৈরির চেষ্টা করতে দেখেছি আমরা বিভিন্ন সময়। এক শ্রেণির ইসলামি স্কলার সব সময় জঙ্গিবাদ বিরোধী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপগুলো সংশয়ের দৃষ্টিতে দেখেন। মনে করেন কিছুই হয়নি, সব সাজানো নাটক। সমাজের মূল সমস্যাগুলো থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখতেই জঙ্গিবাদের নাটক সাজানো হয়। এধরনের কথা আজও আমরা অনেককে বলতে শুনি। এর সপক্ষে ভালো যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন তারা। কিন্তু অন্ধ হলেই যদি প্রলয় বন্ধ হতো তাহলে অন্ধত্বের চেয়ে ভালো কিছু হতো না।


ধর্মীয় অঙ্গনে এই ধরনের কথা কেউ কেউ সারল্যের কারণে বলে থাকেন। সারল্য বলতে তারা সমাজের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে কোনো ধারণা রাখেন না। এই সারল্য ক্ষমার অযোগ্য। আর কিছু মানুষ আছে যারা সরলতার কারণে নয় বরং সব বুঝেও না বোঝার ভান করেন। মানুষকে ধোকা দেওয়াই যার উদ্দেশ্য হয়। এমন লোকও আমাদের ধর্মীয় পরিমণ্ডলে রয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক। ২০০৫ সালে যখন আমাদের দেশে বাংলা ভাই, শাইখ আব্দুর রহমানরা ৬২ জেলায় একযোগে বোমা হামলা করল, সেসময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির তৎকালীন আমির যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি ও অন্য আরো কয়েকজন নেতা বলেই ফেললেন, ‘বাংলা ভাই বলে কিছু নাই, এসব মিডিয়ার সৃষ্টি।’ সেই তিমিরাচ্ছন্ন সময় পার হয়ে এসেছি আমরা। কিন্তু পরিস্থিতি এখনো খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।


মাদরাসা অঙ্গনে আলেম উলামা সব সময় জঙ্গিদের অস্তিত্তের ব্যাপারে সন্দেহ করে এসেছেন। এ থেকে বোঝা যায় জঙ্গিবাদ দমনে সাধারণ আলেমদের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল না, কারণ তারা জঙ্গিবাদকে স্বীকারই করতেন না। সেই ২০১৬ সালের ঘটনাই হয়ত প্রথম যেটাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় ছিল না। এর আগে উদীচী ও রমনা বটমূলে হামলার ঘটনা ঘটেছিল এ ছাড়া পল্টনের রাজনৈতিক সভায় হামলার ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু সেগুলোর চেয়ে অনেক বেশি স্পষ্ট ছিল হলি আর্টিজানের ঘটনাটি। এখানে স্বস্বীকৃত জঙ্গিরা নিজেদের চেহারা প্রকাশ করে এবং জিহাদের শ্লোগান দিয়েই তারা সন্ত্রাস ছড়ায়। আই এসও এর দায় স্বীকার করে। ফলে আলেম উলামার ভেতরও কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়। প্রসংগত বলব আলেম উলামার এসব ক্ষেত্রে সচেতনতা অতি আবশ্যক।


দুই. এ ধরনের হামলা কি জিহাদ হতে পারে?


জিহাদ শব্দটি বর্তমান দুনিয়ায় হয়ত সবচেয়ে মাজলুম একটি শব্দ। যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে একশ্রেণীর সুবিধাবাদি লোক জিহাদের নাম দিয়ে তার বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করছে। জিহাদের নাম দিয়ে এসব কাজ হচ্ছে অথচ আমরা এর প্রতিবাদ সেভাবে করছি না। কারণ হচ্ছে এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে আবার জিহাদকে অস্বীকার করা হয়ে যায় কি না। এমন এক চিন্তা চতুরতার সাথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ ইসলামের জিহাদের সাথে এসব সন্ত্রাসের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সৌভাগ্য, আমরা হলি আর্টিজানের ঘটনার কয়েকদিন আগেই এক লাখ আলেমের জঙ্গিবাদ বিরোধি ফতোয়ার কাজ শেষ করতে পেরেছিলাম। এর আগে যখনই কোনো জঙ্গি হামলা হতো তখনই আলেম উলামার দিকেই আঙ্গুল উঠত, এবার সরকার থেকে নিয়ে সুশীল সমাজ সবাই মূল বিষয়টির স্পর্শকাতরতা বুঝতে পারেন। কেউ আলেম উলামাদের নিয়ে আর কথা বলেন না।


এই জঙ্গিবাদ কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। দু একজন চক্রান্ত করে এর বিস্তার ঘটাচ্ছে এমন নয়। এর পেছনে বিশে^র বড় বড় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি কাজ করছে। হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে একে প্রমোট করতে। এজন্য অনেক সময় সাধারণ মানুষ এর বিপরীতে নিজেদেরকে অসহায় মনে করে। অথচ সত্য পথের পথিকদের বিচলিত হতে হয় না। ইসলামের অনুসারীদের সব সময় আত্মবিশ্বাস থাকা উচিত। যত বড় শক্তিই হোক মিথ্যা মিথ্যাই। ইন্নাল বাতিলা কানা যাহুকা। মিথ্যা নিঃসন্দেহে মিটে যাবে। অপসৃয়মান হবে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এ ঘোষণা আমাদের মনে শক্তি যোগায়। আশাবাদি করে।


তিন. এ ধরনের জঙ্গি হামলার কোনো সুফল সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে আছে কি না?


শিরোনাম শুনে স্তম্ভিত হয়েছেন তাই না? পুরো বিষয়টি পড়ুন একটু পরই বুঝতে পারবেন।


আমার এক আত্মীয় গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারির কাছেই থাকতেন। এখনও সেখানে আছেন। খুবই সাধাসিধে একজন দ্বীনদার মানুষ। কদিন তাবলিগে গিয়ে ভালো ধার্মিক হয়ে গিয়েছিলেন। দেখতাম সুন্দর দাড়ি টুপি পরে চলা ফেরা করতেন। হঠাত দেখি তার মুখে দাঁড়ি নেই। লেবাস পোশাকেও পরিবর্তন। জিজ্ঞেস করলাম, কি ব্যাপার ভাই? তিনি তার গল্প শোনালেন। হলি আর্টিজানে হামলার পরদিন প্যান্ট ও পাঞ্জাবি পরে বাসার পাশে দোকানে গিয়েছিলেন কিছু কিনতে। এমন সময় পুলিশের গাড়ি আসল। এলাকাটায় সেসময় সুনসান অবস্থা বিরাজ করছিল। পুলিশ দাঁড়ি টুপি দেখে জঙ্গি সদস্য বলে সন্দেহ করে। তুলে নিয়ে যায় থানায়। খুব মারধর করা হয়। কয়েকদিন ধরে তাকে পিটানো হয়। ভাইটি প্রায় কেঁদে ফেলে বললেন, ভাই আমি তার পর মুক্ত হয়েই দাড়ি কেটে ফেললাম।


এ ঘটনা থেকে কী শিক্ষা পাচ্ছি? মূলত প্যান্ট পরে যারা দাঁড়ি টুপি পরে চলা ফেরা করে তাদের দেখলে আমার মত সাধারণ আলেমেরও সন্দেহ হয় লোকটা নিবরাসের মত কেউ না তো? সুন্নাতি লেবাস পোশাকের প্রতি মানুষের এই যে ভীতি পশ্চিমে যেটাকে ইসলামো ফোবিয়া বলা হয় সেটা এধরনের কর্মকাÐ যারা পরিচালনা করে তাদের এক বিরাট সাফল্য।


আমার এক পরিচিত ব্যক্তির সাথে কথা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ফ্রান্সে বা আমেরিকায় যেসব হামলা হয়েছে এর দ্বারা ইসলামের কি ফায়দা হয়েছে? সে বলল, এসব হামলার পর অসংখ্য কাফের মুসলমান হয়েছে। আমি বললাম, আমরা তো দেখছি মানুষ ইসলাম থেকে আরও দূরে সরছে। সে বলল, না, অমুসলিমরা দেখছে ইসলাম কাপুরুষতার ধর্ম নয় তাই তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে।


পাঠক বুঝতেই পারছেন কতটা মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটানো হয়েছে।


দীর্ঘ দিন ধরে জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করেছি। অনেক জঙ্গির জীবনধারা নিয়ে গবেষণা করেছি। জঙ্গিদের অনেক বই পড়তে হয়েছে। যখনই আমরা এ নিয়ে কিছু বলি, তখনই আমাদেরকে সরকারের দালাল, র-এর এজেন্ট, জিহাদ বিরোধী, ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী, ইসলাম ধর্মের বিকৃতিকারী ইত্যাদি নানান অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। মূলত সমাজে যেন আমরা কাজ না করতে পারি সেই অপচেষ্টা করা হয়। যার কারণে এসব বিষয় নিয়ে কাজ করা বেশ কষ্টসাধ্য। কিন্তু তাই বলে সত্যনিষ্ট মানুষ বসে থাকবে না। আর পথ যতই দুর্গম হোক আমাদের তো সামনে অগ্রসর হতেই হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সব সময় সমাজের কল্যাণে কাজ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com