ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ভূমিকা বিশ্ব সমাদৃত। ২০২০ সালে এসে বাংলাদেশ যেন তার পুনরাবৃত্তি দেখলো। তবে সেটা ভিন্ন পরিসরে ও ভিন্ন আঙ্গিকে। তখন ছিলো ব্যক্তি, আর এবার সংগঠন৷ বৈশ্বিক মহামারীর এই সংকটে সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তা সত্যিই ভূয়সী প্রশংসার দাবি রাখে৷ ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় নিজের নামের প্রতি সুবিচার করে চলছে সংগঠনটি। এ যেন হারানো ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধার; এমন মানবিক ছাত্রলীগইতো প্রত্যাশিত ছিলো সবার।
১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে এদেশের প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৫৪'র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ৫৮'র আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ৬২'র শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্রলীগ অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে। ৬৬'র ছয় দফা আন্দোলনে এই ছাত্রলীগই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে ছয় দফার দাবীগুলো মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছে। ৬৯ 'র গনঅভ্যুণ্থান ও ৭০'র নির্বাচনেও ছাত্রলীগ গৌরবউজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ সংগঠনটির ভূমিকাতো বলার অপেক্ষা রাখে না। নিজেদের বুকের শেষ রক্তবিন্দুটি পর্যন্ত ঢেলে দিয়েছিলো সেদিন তারা। বস্তুত ছাত্র সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এর যে গৌরবময় অর্জন রয়েছে তা বিশ্বে বিরল বলে আমি মনে করি।
এত অর্জন সত্যেও কোনো কোনো সময় কিছু নেতাকর্মী বিপদগামীও হয়েছে। কেউ কেউ আবার ব্যক্তিগত সুবিধার জন্য পরবর্তী জীবনে অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শও ধারণ করেছে। সেগুলো অবশ্য তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেগুলো বিষয়ে প্রশ্ন করার এখতিয়ারও অবশ্য আমার নেই। প্রায় ৫০ লাখ নেতাকর্মীর এই সংগঠনটি ছাত্র সংগঠন হিসেবে অনেক বড়; একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এত এত নেতাকর্মীর মধ্যে অল্প সংখ্যক খারাপ মানসিকতার লোক থাকবে; এটা অস্বাভাবিক কিছু না। গোলাভরা ধানেওতো কিছু কিছু চিটা ধান থাকে। এটাতো প্রকৃতির-ই নিয়ম। গোলাভরা ধানে পাঁচ সাতটা চিটা ধান থাকলেতো আমরা গোলায় থাকা সকল ধানকে চিটা ধান বলতে পারি না৷ ঠিক তেমনিভাবে দু'এক জনের ব্যক্তিগত অপরাধের দায় কোনোভাবেই সংগঠনের উপর বর্তায় না বলে আমি মনে করি। তবে হ্যাঁ, এ দায় সংগঠনের উপর বর্তাতো, যদি সংগঠন উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করতো৷ কিন্তু আমি দেখেছি যে, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী যখনই কোনো অন্যায় করেছে তখনই তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এমনকি সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসলে তাদেরকেও সাংগঠনিক শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে।
২০২০ সালটা আসলে সবারই মনে থাকার কথা। হলিউডের কাল্পনিক কাহিনীর দৃশ্যায়নে নির্মিত মুভির মতই আচমকা অতি ক্ষুদ্র এক ভাইরাসের আগমন! পৃথিবীতে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারী অবস্থা ঘোষণা করেছে! একজন থেকে আরেক জনে অতি দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে এই ভাইরাস! ভাইরাসের আক্রমণে মৃত্যুবরণও করেছে অনেকে। কিন্তু ভাইরাসের ভয়ে মৃতের স্বজনেরা লাশ দাফন করতে আসে না! অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ঘোষণা অনুযায়ী করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির শরীরে তিন থেকে চার ঘন্টার বেশি ভাইরাসটি সক্রিয় থাকে না। কিন্তু তারপরেও লাশ দাফনতো দূরের কথা, দেখতেও আসে না অনেকে। ঠিক সেই মূহূর্তে ত্রাতার ভূমিকায় ছাত্রলীগ৷ বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির লাশ দাফন করে দিচ্ছে। এমনকি অন্য আদর্শধারী কিংবা জীবিত অবস্থায় সব সময় ছাত্রলীগের বিরুদ্ধাচরণ করে গিয়েছে এমন লোকেরও লাশ দাফন করেছে এই ছাত্রলীগ।
মানুষের সকল মৌলিক চাহিদার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো খাদ্য। এই করোনা মহামারীতে অনেকে নিজেকে কোয়ারান্টাইনে রেখেছে৷ ভাইরাসের ভয়ে অনেকটা শ্রমিক সংকটও দেখা দিয়েছিলো। শ্রমিক সংকটের কারণে বোরো ধানের এই মৌসুমে ধান কাটতে পারছিলো না কৃষক। ধান ঠিকমত কাটতে না পারলেতো দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে৷ কিন্তু ছাত্রলীগ থাকতে কিসের এত চিন্তা! মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কাস্তে হাতে কৃষকের পাশে এসে দাঁড়ায় এই ছাত্রলীগ৷ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অসহায় কৃষকের ধান কেটে মাড়াই করে গোলায় ভরে দিয়ে এসেছে তারা। সেই ধান থেকে উৎপন্ন চালের ভাত খেয়ে এখন আপনারা-আমরা জীবনধারন করছি।
মহামারীর এই সময়টাতে দেশের উপকূলবর্তী অঞ্চলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। সেখানেও ত্রাতার ভূমিকায় ছাত্রলীগ৷ যেকোন দুর্যোগে মূলত তিনটি পর্যায় থাকে; দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন ও দুর্যোগ পরবর্তী। দুর্যোগ পূর্ববর্তী সময়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করেছে ছাত্রলীগ। এমনকি তখন ক্ষেতের ফসল তোলা থেকে শুরু করে মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে সড়ানোর কাজেও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে এই ছাত্রলীগ। দুর্যোগকালেও তারা যথাসম্ভব মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছে। দুর্যোগ পরবর্তী সময়টাতে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সাহায্যে সর্বাত্বকভাবে নিজেকে নিয়োজিত করেছে।
নোভেল করোনা ভাইরাস এর আক্রমনে সৃষ্ট রোগ কভিড ১৯ এর কারনে বিশ্বে বর্তমানে একটি সংকট চলছে৷ বাংলাদেশে এই করোনা সংকট শুরু হওয়ার সময় থেকেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংকট মোকাবেলায় একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ছাত্রলীগের নেতা কর্মীরা চাইলে কিন্তু ঘরে বসে অন্যান্যদের মত নিরাপদে থাকতে পারতো। কেননা এই স্বেচ্ছাসেবা দেয়াটা তাদের কোনো চাকরির মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তারা নিজেরাই স্বপ্রণোদিত হয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে মানুষের জন্য নিজের মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে এগিয়ে এসেছে। তারা অসহায় মানুষের ঘরে খাদ্য পৌঁছে দিচ্ছে, তারা রাস্তায় রাস্তায় মাইকিং করে করোনা ভাইরাসের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করছে, নিজেরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রস্তুত করে বিনামূল্যে মানুষের কাছে সরবরাহ করছে। মাস্ক সহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম মানুষের দোরগোড়ায় পৌছে দিচ্ছে, অসহায় কোভিড ১৯ রোগীকে নিজের টাকা খরচ করে অ্যাম্বুলেন্স সাপোর্ট দিচ্ছে, এমনকি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কেউ কেউ নিজে রিক্সা চালিয়ে মানুষকে নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছে; এ যেন আলোকবর্তিকা হাতে মানুষের তরে নিজেদের বিলিয়ে দিতে এসেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ৷ সাবেক ছাত্র পরিবহন সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।
বিবার্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]