শিরোনাম
বিদ্যানন্দ, যাকাত এবং ইসলাম কি বলে?
প্রকাশ : ২১ মে ২০২০, ২৩:০৫
বিদ্যানন্দ, যাকাত এবং ইসলাম কি বলে?
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

বিদ্যানন্দ নামটি শুনলেই স্বামী বিবেকানন্দ ও জীবনান্দের মত মনে হয়। হিন্দু হিন্দু একটা গন্ধ বের হয় যেন। এই হিন্দু হিন্দু ভাবটা আমাদের দেশের সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশের কারণেই হয়ত। তা না হলে আনন্দ শব্দ শুনে কেবল হিন্দু নামগুলির দিকে চিন্তা ঘুরে যাবে কেন? ঈদের আনন্দও তো আনন্দ? ইবাদতের আনন্দের মতই ইলম বা বিদ্যার আনন্দ।


বিদ্যানন্দ একটি স্বেচ্ছাসেবি সংগঠন। পথশিশুদের নিয়ে কাজ করে। তাদের এক টাকায় আহার প্রোগ্রাম খুব সাড়া ফেলেছিল। সম্প্রতি করোনাভাইরাস চলাকালে তারা নতুন করে আলোচনায় আসে। এরই ভেতর যাকাত উশুলের ঘোষণা দেয় তারা। এর ফলে কিছু আলেম উলামা তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে যায়। তাদের কাছে যাকাত দিলে যাকাত আদায় হবে না এমন ফতোয়াও দেন।


আমি তাদের পক্ষে বা বিপক্ষে কোনো ফতোয়া দিবো না। কারণ আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্যানন্দের কাউকে চিনি না। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে ঘনিষ্টভাবে জানার সুযোগও আমার হয়নি। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট করব, যাকাতের হকদারদের কাছে যাকাত পৌঁছে দিলে যাকাত আদায় হয়ে যায়। একটা হিন্দুর মাধ্যমেও যদি কেউ গরিবের কাছে যাকাত পাঠিয়ে দেয় তাতেও যাকাত আদায় হয়ে যাবে। কোনো হিন্দুকে যাকাত দেয়া যাবে না। কিন্তু কোনো হিন্দুর মাধ্যমে যদি কোনো মুসলিম দরিদ্র মানুষের কাছে যাকাতের অর্থ পৌঁছানো হয় তাতে সমস্যা নেই। আর বিদ্যানন্দ কোনো হিন্দু নয়। এর দায়িত্বে কিছু হিন্দুও আছে। হিন্দু দায়িত্বশীল থাকার কারণেই যে তাদের মাধ্যমে যাকাতের অর্থ গরিবের কাছে পৌঁছানো যাবে না তা নয়। অবশ্য বিদ্যানন্দের উচিত এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা। কারণ মাসআলার বিষয় নয়, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক কোন্দল বাধুক তা আমরা চাই না। কুচক্রি মহলকে অবশ্যই কোনো সুযোগ দেয়া উচিত হবে না।


কিছু আলেম ভাবছেন, বিদ্যানন্দ যাকাত নেয়া শুরু করলে মাদরাসাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এত শঙ্কার কী আছে তা বুঝে আসে না। কারণ এদেশের মানুষ সবাই সব যাকাত যে তাদের দিয়ে দিবে এমন তো নয়। মানুষ এসব বিষয়ে খুব সাবধানী না হলেও সন্দেহবাতিক সাধারণ বাঙালির অধিকাংশেরই আছে। বিদ্যানন্দ আস্থাভাজন হতে হলে তাদের অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। পূজার জন্য কোনো দান উঠানোর দায়িত্ব কোনো মুসলমান যদি নেয় তাহলে হিন্দুরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেই পারে। যাকাতের টাকা উঠানোর ক্ষেত্রে একই রকম ব্যাপার।


একটি মাসআলা উঠিয়েছে রাজারবাগি দরবারের আল বাইয়েনাহ পত্রিকা। বিদ্যানন্দ যাকাতের টাকা দিয়ে গরিব লোকদের রিকশা কিনে দিচ্ছে বা অন্য কোনো কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করতে ব্যয় করছে বলে একটা খবর রটেছে। শরিয়াতের দৃষ্টিতে এটা ঠিক আছে কি না। আলবাইয়েনা ফতোয়া দিয়েছে এটা ঠিক হচ্ছে না। টাকা না দিলে যাকাত আদায় হবে না। রিকশা নয় টাকাই দিতে হবে। তারা এ ফতোয়া কোথায় পেল কে জানে? যাকাত হিসেবে টাকাই দিতে হবে একথা কোনো কিতাবেই নেই। ফতোয়ার সব কিতাবেই এর বিপরীত ফতোয়া রয়েছে।


বিদ্যানন্দের কথা মাথা থেকে বের করে দিলাম। দারিদ্র বিমোচনে নগদ অর্থের তুলনায় এমন পদ্ধতি গ্রহণ আরো বেশি সুফল বয়ে আনতে পারে। যাকাতের টাকা ব্যবহারের ভালো একটি নজির হতে পারে এটি। এতে মন্দ কোনো দিক নেই। আমাদের দেশে যাকাতের লুঙ্গি, যাকাতের শাড়ি দেয়ার নিয়ম আছে। এই শাড়ি লুঙ্গি গ্রহণ করতে গিয়ে বহু মানুষ মারা যাবার মত ঘটনাও ঘটেছে। শাড়ি লুঙ্গি বিতরণের চেয়ে বরং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত। একটা মাছ ধরে দিলে একবেলা খেতে পারবে আর মাছ ধরার ব্যবস্থা করে দিলে সারা জীবন মাছ ধরে খেতে পারবে। এ ঠিক এমনই এক ব্যাপার। তবে শর্ত হচ্ছে রিকশার মালিক বানিয়ে দিতে হবে গরিবকে। মালিক বানিয়ে না দিলে যাকাত আদায় হবে না। যদি কোনো সংগঠনে রিকশা কিনে রেখে রিকশা চালকদেরকে রিকশা সাময়িক চালানোর জন্য দেয়া হয় তাহলে হবে না। যাকাতের জন্য মালিক বানিয়ে দেয়ার শর্ত কিতাবাদিতে রয়েছে।


যাকাতের ক্ষেত্রে সব সময় ফিকহের কিতাবাদিতে গরিবের ফায়দার দিকটিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। যে পদ্ধতিতে গরিবের অধিক উপকার হয় সেটি-ই গ্রহণ করা উচিত।


বিদ্যানন্দে কেউ যাকাত দিতে চাইলে তাকে অবশ্যই বিদ্যানন্দ সম্পর্কে জানতে হবে। তারা শরিয়ত সম্মতভাবে বিলি বণ্টন করবে কি না। যাচাই করে নেয়ার মানসিকতা থাকা উচিত সব ক্ষেত্রেই। শুধু বিদ্যানন্দ কেন, মাদরাসায় দান করার ক্ষেত্রেও অবশ্যই খোঁজ খবর নেয়া উচিত। অনেক মাদরাসার নির্মাণ কাজ করা হয় যাকাত দিয়ে। ফিকহের দৃষ্টিতে এটা বৈধ নয়। অনেক মাদরাসায় যাকাতের টাকা হিলা করে উস্তাদদের বেতন দেয়া হয়। এটাও বৈধ নয়। দারুল উলুম দেওবন্দের ফতোয়া আছে এ বিষয়ে।


সদ্য প্রয়াত দেওবন্দের শাইখুল হাদীস মুফতি সাইদ আহমাদ পালনপুরি রহ. বোম্বের এক ব্যবসায়ির ঘটনা শোনাতেন। এক মাদরাসার মুহতামিম যাকাত চাইলেন মাদরাসার উস্তাদদের বেতন ভাতা পরিশোধের জন্য। ব্যবসায়ী জিজ্ঞেস করলেন, উস্তাদদের বেতনে যাকাত ব্যয় করা কি যায়েয? মুহতামিম উত্তর করলেন, না, কিন্তু আমরা হিলা করে নিব। ব্যবসায়ী জানতে চাইলেন, হিলা কিভাবে করবেন? মুহতামিম বললেন, একটা গরিব ছাত্রকে ডেকে সব টাকা তাকে দিয়ে দিব, তারপর বলব, তুমি এ টাকাগুলো মাদরাসায় দিয়ে দাও। তাকে আপনার টাকা যাকাত হিসেবে দেব কিন্তু সে আমাদেরকে দান করে দিবে। তার দান করার পর আর আমাদের জন্য হারাম থাকবে না। ব্যবসায়ী বললেন, এমন হিলার সুরত থাকলে আর আপনাদেরকে আমি টাকা দিব কেন? এমন হিলা তো আমিও করতে পারি। আমার একজন কর্মচারীকে সব টাকা যাকাত হিসেবে দিয়ে দিব। সে আমাকে হাদিয়া দিবে। এভাবে আমার যাকাত আমিই হালাল করে নিতে পারি। আপনাদের দেয়ার কী দরকার? হাহ হা।


সত্যি কথা হচ্ছে মাদরাসাগুলিতেও যাকাতের বিষয়ে সতর্কতা কমে গেছে। গরিবের হক এভাবে নষ্ট করা ঠিক নয়। যে মাদরাসা সম্পর্কে আপনার ধারণা নেই তাদের যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। মাদরাসা কর্তৃপক্ষেরও উচিত যাকাতের ক্ষেত্রে শরিয়াতের নির্দেশনা পুরোপুরি অনুসরণ করা। মাদরাসার ক্ষেত্রেই যখন সতর্ক থাকতে বলছি তাহলে বিদ্যানন্দ বা এধরনের যে কোনো স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনের ক্ষেত্রেও যে আমাদের জেনে বুঝে কাজ করা উচিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। একদিকে স্বেচ্ছাসেবি সংগঠনগুলিকে উৎসাহিত করতে হবে অন্যদিকে কোনো ধরনের অনিয়ম বা বিশৃংখলা সৃষ্টি না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।


যাকাত দেয়ার ক্ষেত্রে যে সতর্কতা কাম্য সাধারণ দান সদকার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সতর্কতার কিছু নেই। বিদ্যানন্দ হিন্দু মুসলিম সব দরিদ্র শ্রেণীর মাঝেই কাজ করে। সে ক্ষেত্রে তারা যাকাত গ্রহণ করলে অবশ্যই যাকাতের ফাণ্ড পৃথক রাখতে হবে। ফিতরার টাকা তারা অমুসলিমদেরও দিতে পারবে। কিন্তু পূজা উৎসবে ব্যয় করতে পারবে না। মনে রাখবেন, ধর্মীয় বিষয়াদি নিয়ে কোনো ধরনের গোলযোগ না হয় সেদিকে আমাদের সবারই খেয়াল রাখা একান্ত আবশ্যক।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com