শিরোনাম
এ বি পার্টির উত্থান কওমি রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয়
প্রকাশ : ১৫ মে ২০২০, ১৬:৩৫
এ বি পার্টির উত্থান কওমি রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয়
মুফতি ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

শতবর্ষ যাবৎ কওমী আলেমরা আধুনিক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। দারুল উলুম দেওবন্দের কয়েকজন কেন্দ্রীয় মনীষী রাজনীতির সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত ছিলেন। রেশমি রুমাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপট শেষ হয়ে যাবার পর সর্বপ্রথম খেলাফত আন্দোলন শুরু হয় সারা ভারত জুড়ে। মহাত্মা গান্ধির মত হিন্দু নেতাও সে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। মাওলানা শওকত আলি ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলি নেতৃত্ব দিলেও শাইখুল হিন্দের শিষ্যরা সারা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এর শিখা। ইংরেজরা খুব শংকার ভেতর ছিল। ভারতজুড়ে যে কোনো সময় গণঅভ্যুত্থান হতে পারত ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে। দুর্ভাগ্যক্রমে তুরস্কের খেলাফত তুর্কিরাই বিলুপ্ত করে দেয়। এরপর নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি হয় মুসলিম বিশ্ব। ভারতেও নতুন পলিসি উদ্ভাবন করেন উলামায়ে দেওবন্দ। ১৯১৯ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের নামে নতুন সংগঠনের যাত্রা আরম্ভ হয়।


মাল্টার কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ভারত ফেরেন শাইখুল হিন্দ ও শাইখুল ইসলাম। ১৯২০ সালের ডিসেম্বরে পরলোকগমন করেন শাইখুল হিন্দ। মাওলানা মাদানি ও মুফতি কেফায়াতুল্লাহ রহ. জমিয়তের হাল ধরেন। এভাবে তিরিশ বছর তারা ইংরেজ আমলে মূলধারার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন। নির্বাচনে জয় পরাজয়ের মুখোমুখি হন। মুসলিম লীগের সাথে আলেমদের চরম সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হয়। লীগ নেতারা সমাজ থেকে দেওবন্দি আলেমদের প্রভাব নষ্ট করতে হেন কোনো কৌশল নেই যা প্রয়োগ করেনি।


১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হবার পর ভারতের জমিয়তে উলামা নেতৃবৃন্দ রাজনীতি থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সামাজিক সংগঠন হিসেবে নতুন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। একদিকে দাওয়াত ও তাবলিগ অন্যদিকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ নিরবে নিভৃতে মুসলমানদের ভেতর কাজ করতে থাকে। এর সুফল তারা পেতে থাকেন। বিশ্বব্যাপী তাদের আজকের যে গ্রহণযোগ্যতা তার পেছনে সেসময়ের নেতৃবৃন্দের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের ভূমিকা অনস্বিকার্য।


পাকিস্তানে এসময় রাজনীতির মাঠ গরম হয়ে ওঠে। মাওলানা আশরাফ আলি থানভি ছিলেন সিয়াসাত থেকে দূরে। তিনি নিজের উস্তাদ শাইখুল হিন্দের কর্মপন্থার ঘোর বিরোধী ছিলেন। আলেমদের রাজনীতিতে জড়ানো পছন্দ করতেন না। মুফতি কেফায়েতুল্লাহ ও মাওলানা মাদানী বহুবার রাজনীতির বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে বসতে চেয়েছেন কিন্তু সব সময় তিনি রাজনীতিকে এড়িয়ে গেছেন।


পাকিস্তানে দেখা গেল এই হযরত থানভী রহ.-এর শিষ্য মুরিদ খলিফারাই রাজনীতিতে অধিক সক্রিয়। তারা প্রথমে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম নামে একটি দল গড়েন। তারপর নিজামে ইসলাম পার্টির গোড়াপত্তন করেন। তেইশ বছরের রাজনীতিতে কোনো বাহ্যিক সফলতা তাদের না আসলেও তাদের গণসম্পৃক্ততা ছিল উল্লেখ করার মত।


বাংলাদেশ আমলে ভারতের মাওলানা সাইয়েদ আসআদ মাদানী রহ. ৭২ সালে নেতৃস্থানীয় আলেমদের ডেকে পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রথাগত রাজনীতি ত্যাগ করে সামাজিক সংগঠন গড়ে তুলতে। ইসলামের নামে রাজনীতি করতে তিনি নিরুৎসাহিত করেন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে কওমি আলেমরা আবারও রাজনীতির মাঠে সরব হয়ে ওঠেন।


মূলত জামায়াতে ইসলামীর চরম উত্থান হয় পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে। অনেক আলেম তখন ভাবেন এদের রোধ করতে হলে রাজনীতির মাঠে থাকতে হবে আমাদের। ধর্মের ঠিকাদারি নিয়ে নিয়েছিল জামায়াত। রাজনীতির গুরুত্ব এত বেশি প্রচার করা হয়েছিল যার কারণে সাধারণ মানুষ চরম বিভ্রান্তিতে পড়ে যাচ্ছিল। এ প্রেক্ষাপটেই হাফেজ্জি হুজুর খেলাফত আন্দোলন নামে দল গঠন করেন। সারা দেশে সাড়া পড়ে যায়। প্রায় সাত বছর ধরে বট গাছের ছায়া এদেশের ধর্মীয় অঙ্গনকে ছায়া দিয়ে যায়।


নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় চরমোনাই পীর সাহেবের ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলনের গোড়াপত্তন। কাছাকাছি সময়ে মাওলানা আযীযুল হক-এর খেলাফত মজলিস। খেলাফত আন্দোলন ভেঙ্গেই মজলিস গঠিত। জামায়াতে ইসলামীর কিছু পদত্যাগ করা নেতারাই খেলাফত মজলিস দলটিকে গুছিয়ে অগ্রসর হন।


জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের ভেতর পাকিস্তানি রাজনীতির প্রভাব থেকে যায় পুরো সময়। মূলে ফিরতে চেয়ে বেশ কিছু আলেম জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের আদলে নতুন করে দল গড়েন। মাওলানা ফরীদ উদ্দিন মাসউদ ভারতের জমিয়তের মত সামাজিক সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা সংগঠন গড়েন ২০১৪ সালে।


নির্বাচনের রাজনীতি করতে হলে ইসলামী দলসমূহকে দুটি দিকই রক্ষা করতে হবে। একদিকে যুগের চাহিদা দেখতে হবে অন্য দিকে রাসূল সা.-এর সীরাত। এ দুয়ের সুসমন্বয় না হলে তা ইসলামী রাজনীতি হবে না। দেখা যাচ্ছে এ দুটির সমন্বয় না থাকার কারণে আমাদের দেশের ইসলামী রাজনীতিগুলো না হচ্ছে ইসলামী না হচ্ছে রাজনীতি। রাজনীতির বদলে কেবল কেওয়াজ করে যাচ্ছেন রজপথে।


একসময় জামায়াত প্রভাব বিস্তার করেছে আমাদের ইসলামী রাজনীতির অঙ্গনে। রাজনীতির স্বাভাবিক নিয়ম অনুসারে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণী পেশার মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে জামায়াতের প্রভাব বলয় থেকে বের হতে না পারার কারণেই। উগ্রতা ও আস্ফালন করাকেই রাজনীতির ধর্ম বানিয়ে নেয়াও জামায়াত থেকে শেখা। সেকুলারিজমকে কুফুরি মতবাদ বলে প্রচার করার সবকও জামায়াতিদের কাছ থেকে হাসিল করেছেন কওমি রাজনীতিকরা। জামায়াত থেকে শেখা এমন অনেক বিষয় রয়েছে।


কথা হচ্ছে জামাআতে ইসলামীর এসব পদ্ধতি এখন এতটাই পুরনো ও দুর্গন্ধ হয়েছে যে খোদ জামায়াতের ভেতর বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থী গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে। জামাআতি আইডিয়ালোজির অন্তসারশূন্যতারই প্রমাণ বহন করে এ বি পার্টির উত্থান। তো এখন কওমী অঙ্গনে যারা এতদিন জামাআতের অনুকরণে রাজনীতি করেছেন তাদেরও একটু ভাবা উচিত। রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা যদি সেই পচা পুরনো চিন্তা চেতনা নিয়েই থাকেন। তাহলে একদিকে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা যেই তলানিতে ছিল তা থেকে সামান্য উন্নতি সম্ভব হবে না। অন্যদিকে ইসলামের দুর্নাম রটানোর ধারা আরা সুদৃঢ় হতে পারে। কারণ কওমী মাদ্রাসার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতামুক্ত সামাজিক সংগঠনগুলো এখনও ততটা শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি।


ইসলাম বিদ্বেষী মহল অন্তসারশূন্য ফাকা বুলির কওমী ছাত্র কেন্দ্রিক রাজনীতির সমালোচনা করতে গিয়ে ইসলামের সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে যাবে। তাদের সমালোচনায় নিঃসন্দেহে ইসলামের ক্ষতি হয় না কিন্তু এমন সুযোগ দিয়ে আমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। দেশে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামের সার্বজনীন দাওয়াতের পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এদের কারণে।


করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে একটা বড় পরিবর্তন আসবে। এসময় পুরোনো গোড়ামি নিয়ে বসে না থেকে নতুন করে ভাবতে হবে আমাদের নেতৃবৃন্দকে। জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের কাছ থেকে কওমি মাদরাসার রাজনীতিকদের অবশ্যই শিক্ষা নিতে হবে। নিজেদের টিকিয়ে রাখতে কৃত্রিমভাবে হলেও পরিবর্তন আনতে হবে চিন্তা চেতনায়। নতুন কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে ইসলামী রাজনীতিতে সরব সবাইকে। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা সবাইকে সুমতি দিন। আমীন।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ


বিবার্তা/জাহিদ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com