শিরোনাম
করোনা মহামারীতে তারাবীর নামাজের ক্ষেত্রে করনীয়
প্রকাশ : ২৩ এপ্রিল ২০২০, ১১:০২
করোনা মহামারীতে তারাবীর নামাজের ক্ষেত্রে করনীয়
মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

আগামী ৫ তারিখে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। ইতিমধ্যে আলেম উলামার সাথে আলোচনার মাধ্যমেই ধর্মমন্ত্রণালয় থেকে মসজিদসমূহে মুসুল্লি সংখ্যা নির্ধারণের সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। আলহামদুলিল্লাহ দু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সারা দেশে কম-বেশি নিয়ম মানার চেষ্টা করেছে সচেতন নাগরিকরা। সব দেশেই অসতর্ক অবিবেচক মানুষ রয়েছে। মূলত তাদের বিষয় ধর্তব্যের ভেতর নয়। সাধ্যমত চেষ্টা করতে হবে সবাইকে বোঝানোর। তারপর না হলে দুর্ভোগ যতটুকু আছে তা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।


কোভিড ১৯ বা নভেল করোনাভাইরাসের গতি প্রকৃতি বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আরো বেশ কিছু দিন লকডাউন ঘোষণা করতে হবে সরকারকে। অন্যান্য দেশেও পরিস্থিতি অনুসারে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি বিচার করেই ফতোয়া দিচ্ছেন সারা বিশ্বের মুফতীরা। মিসরের মারকাযুল আযহার আল আলমী থেকে মসজিদ বন্ধ করার বিষয়ে স্পষ্ট ফতোয়া দেয়া হয়েছে। হারামাইনসহ আরব বিশ্বের আলেমদের ফতোয়ার বিষয়েও ইতোমধ্যেই আমরা জানতে পেরেছি। দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে প্রকাশিত ফতোয়ায়ও চার পাঁচজনের অধিক মানুষ যেন তারাবিতে শরিক না হয় সে বিষয়ে ফতোয়া জারি করা হয়েছে আরো কয়েকদিন পূর্বেই। কেবল পাকিস্তানের আলেমরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছেন। বেশ কিছু শর্ত দিয়ে তারা মসজিদ উন্মুক্ত করে দেয়ার দাবি জানিয়েছে সরকারের কাছে। সে দাবি অনুসারে পাকিস্তান সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।


পাকিস্তানের আলেমদের বৈঠকের পর আমাদের দেশের পাকিস্তানপন্থী আলেমরা সারা বিশ্বের সব বিদগ্ধ সচেতন আলেমের মতামতকে উপেক্ষা করে নতুন করে মিটিং সিটিং করেন। মূলত তারা নিজেদের বিচার বুদ্ধি দিয়ে চলার চেয়ে পাকিস্তানকেই তারা সব ক্ষেত্রে আদর্শ মনে করে থাকেন। এটা তাদের চিরাচরিত স্বভাব। আরব, মিশর বা দেওবন্দের ফতোয়া তারা দেখলেন না। আরবের ফতোয়া তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন এই বলে যে, ওখানের আলেমরা সরকারের দালালি করে। আর দেওবন্দের ফতোয়া বাদ দিচ্ছেন এই বলে যে, ভারত একটা হিন্দু রাষ্ট্র। আমরা মুসলিম রাষ্ট্রে বাস করি। মুসলিম রাষ্ট্রের বিধান হিন্দু রাষ্ট্রের মত হতে পারে না। এককথায় তারা কেবল পাকিস্তানকেই অনুসরণ করবেন। পাকিস্তান একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। ইসলামের অপব্যাখ্যা করে এ রাষ্ট্রটির অবৈধ জন্ম। বাংলাদেশ অধিকাংশ মুসলিম সংখ্যাগুরু দেশের মত মুসলিম প্রধান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এটা পাকিস্তান বা আই এস-এর মত কোনো জঙ্গি রাষ্ট্র নয়। কাজেই পাকিস্তানের সঙ্গে সব কিছুতে মিল করতে যাওয়ার মানসিকতা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?


এমতাবস্থায় আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে আমাদের দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। এখানে জনসমাগম যদি এখনো ক্ষতির কারণ হয় তাহলে পূর্বের নির্দেশনা বহাল রাখা একান্ত আবশ্যক হবে। কারণ মানুষের প্রাণ রক্ষা করা যে কোনো দেশের সরকারের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হওয়া উচিত। ইসলামেও জানের নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। [সুরা বাকারা ১৯৫ আয়াত দ্রষ্টব্য] স্বাস্থ্য ঝুঁকির জন্য অজুর বদলে তায়াম্মুমের বিধান দেয়া হয়েছে ইসলামি শরিয়তে। [সুরা মায়েদা] জখমের পট্টির উপর পানি না ঢেলে হাত রাখা যথেষ্ট করা হয়েছে। [ইবন মাজাহ হযরত আলি বর্ণিত হাদীস] অসুস্থতার কারণে বসে এবং শুয়ে নামাজ পড়ার বিধান দেয়া হয়েছে। [বুখারি ও মুসলিম] সফরে কষ্ট হয় বলে চার রাকাত ফরজ নামাজ কমিয়ে দু রাকাত করা হয়েছে। [সিহা সিত্তা] পুরো শরিয়তের বিধানগুলি দেখলেই আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট হয়ে যাবে।


করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে ইতোমধ্যেই প্রায় দু লাখ মানুষ মারা গিয়েছে। আমাদের দেশেও দিন দিন বেড়ে চলেছে মৃতের সংখ্যা। এ অবস্থায়ও আমাদের দেশের একশ্রেণির অবিবেচক আলেম হালকা আবেগের কথা বলে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। যেমন কেউ বলছেন, রমজানে আল্লাহর রহমতের দরজা খুলে যায় তাই মসজিদের দরজা সবার জন্য খুলে দেয়া উচিত। অন্য অনেক আলেম মসজিদকে তুলনা করছেন বাজারের সাথে। বাজার খোলা তাই মসজিদ খুলতে হবে। এধরনের অসংখ্য অপযুক্তি তারা দিয়ে যাচ্ছেন।


আল্লাহর রহমত রমজানে অবশ্যই আসবে। দুর্যোগের কারণে যুক্তিসংগতভাবে মসজিদ বন্ধ রাখলে যে আল্লাহর রহমত বন্ধ হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। এ ধরনের কথা শুনে সাধারণ মানুষকে ঝুঁকিতে ফেলানোর মত সিদ্ধান্ত মোটেও শরিয়তসম্মত হবে না। সাধারণ অবস্থায় মসজিদে প্রবেশে বিধি নিষেধ আরোপ করা অন্যায় হতো। এখন বিশেষ প্রয়োজনেই বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর দ্বারা সরকার বা আলেম উলামা কোনো পাপ করেননি। বরং রাসুলের হাদীস থেকেই তারা এ নির্দেশনা পেয়েছেন। রাসূল সা. বৃষ্টি বা ঠাণ্ডার কারণে মসজিদে না এসে ঘরে নামাজ পড়ার বিধান দিয়েছেন। [বুখারী] এ অবস্থায় নবীজী সা.-এর নির্দেশনার বিপরীতে এ ধরনের আবেগি কথার মূল্য আসলে কতটুকু?


শংকার ভেতরেও বাজার সীমিত সময়ের জন্য খোলা রাখার অনুমতি সরকার দিয়েছে। সারা বিশ্বেই দেয়া হয়েছে। কেন? বাজার খোলা না রাখলে মানুষ বাঁচবে না। মানুষের নিত্য প্রয়োজন মিটবে না। না খেয়ে মারা যাবে মানুষ। জান বাঁচাতে ইসলাম মরা পশু এমনকি শুকর খাওয়ারও অনুমতি দেয়। পক্ষান্তরে বর্তমানে জানের সুরক্ষার জন্যই সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে মসজিদে প্রবেশের ক্ষেত্রে। কাজেই বুঝতে পারা যায় বাজারের সাথে এই তুলনা মোটেও ঠিক নয়। নামাজ মসজিদে না গিয়েও পড়া যায়। মসজিদে পড়লে বেশি সওয়াব হতো। কিন্তু এই বিশেষ অবস্থায় মসজিদে না গিয়ে বাসায় পড়লেও হাদীসের ভাষ্য অনুসারে মসজিদে গিয়ে পড়ার সওয়াব পাওয়া যাবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, বান্দা যদি কখনো অসুস্থ হয়, আর সে আগের আমলগুলি করতে অক্ষম হয়ে যায় তাহলে তার আমলনামায় সাধারণ সময়ের মতই নেকি লেখা হতে থাকে। [বুখারী] এ হাদীস থেকে বোঝা যায় মসজিদে না গিয়েও মসজিদে যাবার সওয়াব লাভ করতে থাকে দুর্যোগাক্রান্ত মুসল্লি সাধারণ।


সাধারণ মানুষের আবেগ নিয়ে রাজনীতি করার হীন মানসিকতা আছে আমাদের দেশের কিছু আলেমের ভেতর। আবার কিছু বরেণ্য আলেম আছেন যারা বাস্তবতা সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা রাখেন না। এজন্য করোনাভাইরাসের ব্যাপারে তাদের ভেতর কোনো ভাবনা তৈরি হতে পারেনি। এ অবস্থায় তাদের অসম্মান করা ঠিক হবে না। কিন্তু তাদের কথার উপর ভিত্তি করে কোনো সিদ্ধান্তও নেয়া যায় না। মূলত রাষ্ট্রের স্বাস্থ্য অধিদফতর ও অভিজ্ঞ দক্ষ বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। বিশেষ কোনো শ্রেণী বা গোষ্ঠীর আলেমের মতামত গ্রহণ না করা হলে ধর্ম অবমাননা হবে এমন কোনো কথা নেই।


দায়িত্বজ্ঞানহীন আলেমের কথার সমালোচনা করে সময় নষ্ট করা অর্থহীন। কিন্তু হাইআতুল উলিয়ার পক্ষ থেকে সর্বজনমান্য হযরত মাওলানা আহমদ শফী সাহেবের নাম ব্যবহার করে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। পাকিস্তানের মতই ১৪টি শর্তে মসজিদ উন্মুক্ত করার দাবি সেখানে জানানো হয়েছে। বিবৃতিদাতাদের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখেই সাধারণ মানুষের কয়েকটি প্রশ্ন উল্লেখ করতে চাই। আশা করি তারা বিষয়গুলো স্পষ্ট করে মানুষের মনের বিভ্রান্তি দূর করবেন।


১. পঞ্চাশোর্ধ্ব লোকদের মসজিদে যেতে বারণ করা হয়েছে। বিবৃতিদাতাদের অধিকাংশই এ শর্ত অনুসারে মসজিদে যেতে পারবেন না। কারণ তাদের বয়স ৫০এর অধিক। এবং এরা প্রায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনো মসজিদের দায়িত্বে আছেন। তারা কি অব্যাহতি নিবেন। অনেক মসজিদের মুআযযিন বা খাদেমের বয়স পঞ্চাশের বেশি তাদের চাকরিরই বা কি হবে?


২. মুসল্লিরা কি সবাই পাসপোর্ট বা বার্থ সার্টিকিফেট নিয়ে মসজিদে যাবে? তা না হলে কার বয়স কত তা কীভাবে বুঝা যাবে?
৩. হ্যান্ড স্যানিটাইজার কেনার টাকাটা কি হাইআতুল উলিয়া বা বেফাক থেকে দেওয়া হবে? আমরা যতদূর জানতে পারলাম বেফাকের কর্তৃপক্ষ বরং সরকারের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছেন। ইতোমধ্যেই এ টাকা বণ্টন নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নিতির অভিযোগও শোনা যাচ্ছে। তাহলে তারা তো হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে দিবেন বলে মনে হয় না। যেভাবে দাম বাড়ছে কয়টি মসজিদে এর ব্যবস্থা করা যাবে?


৪. কার জ্বর বা সর্দি আছে এটা মাপার জন্য থার্মো মিটার নিয়ে কে দাঁড়িয়ে থাকবে মসজিদের গেটে? বিমান বন্দরের মত পরীক্ষা করার দায়িত্ব কে নিবে? যদি কেউ অসুখ নিয়ে মসজিদে এসেই যায় তাকে বের করা নিয়ে হাঙ্গামা হলে এর দায় বর্তাবে কার উপর?
আশা করি বিবৃতিদাতাগণ এ সব প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিয়ে গণ মানুষের মন শান্ত করবেন।


এই মুহূর্তে আমাদের বেশি বেশি দুআ করতে হবে যেন দ্রুতই আমরা এ মহামারি থেকে মুক্তি পাই। আর অবশ্যই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও দেশের স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে যেসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে সেগুলি মেনে চলতে হবে। ফিকহের কিতাবে একটি কথা আছে, স্বাস্থ্য বিষয়ে মুসলিম দ্বীনদার ডাক্তার বললেই সে অনুসারে শরিয়তের বিধান ত্যাগ করা যাবে সুস্থতার খাতিরে। এজন্য কোনো কোনো আলেম বলছেন, চিকিৎসকরা যেহেতু ফাসেক বা কাফের তাই তাদের কথা গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই আলেমরা ভেবে দেখেননি, এ দ্বীনদার হওয়ার শর্ত হচ্ছে যখন একজন দুজন ডাক্তার বলে। এখন তো সারা বিশ্বের সমস্ত চিকিৎসক একমত হয়েছেন সোশ্যাল ডিস্টেন্সিংয়ের ব্যাপারে। তাওয়াতুরের পর্যায়ে চলে গেলে আর দ্বীনদারী দেখার কথা ইসলামী ফিকহমতেও জরুরি নয়। সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই। চিকিৎসকদের পরামর্শ অবশ্যই মেনে চলতে হবে। এটা রাসূলের সুন্নত। ইসলামের অনন্য বৈশিষ্ট। কোরআনের নির্দেশ। সারা বিশ্বের বিদগ্ধ সচেতন আলেমদের ঐকমত্য রয়েছে এসব বিষয়ে। সাধারণ মানুষকে বোঝালে অবশ্যই তারা বর্তমান সময়ে তাদের কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ হবেন। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা আমাদের সহায় হোন। আমীন।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ


বিবার্তা/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com