শিরোনাম
জানাযার নামাযে শোডাউন: ইসলাম কি বলে?
প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২০, ১১:৫৭
জানাযার নামাযে শোডাউন: ইসলাম কি বলে?
মুফতী ফয়জুল্লাহ আমান
প্রিন্ট অ-অ+

একটা মানুষ যখন মারা যায় তখন তার পরিবারের সদস্যরা মুষড়ে পড়ে। তারা শোকে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। যত শোক আর যন্ত্রণাই থাক রাসূল সা. এর নির্দেশ হচ্ছে দ্রুতই তার দাফন কাফন সম্পন্ন করা। হযরত ইবন উমর থেকে বর্ণিত, তোমাদের কেউ সকালে মারা গেলে দুপুরের বিশ্রাম যেন কবরে গিয়েই করে। আর সন্ধ্যায় মারা গেলে রাত যাপন যেন কবরে গিয়েই করে। মৃত ব্যক্তিকে তোমরা আটকে রেখ না। দ্রুত কবরস্থ করো। [তবারানি শরীফ] আবু দাউদ শরীফের বর্ণনায় রয়েছে, কোনো মুসলিমের লাশ যেন তার পরিবারের ভেতর আটকে রাখা না হয়। বিখ্যাত তাবেয়ি আইয়ুব সাখতিয়ানি রহ. বলেন, আমরা পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শুনেছি, মৃত ব্যক্তির লাশের প্রতি সম্মান প্রকাশের পদ্ধতি হচ্ছে তাকে দ্রুত কবরস্থ করা।


ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বল রহ.-এর একটি প্রসিদ্ধ উক্তি ছিল, আমার এবং আমার প্রতিপক্ষ মুতাযিলাদের মাঝে কে সঠিক তা প্রকাশ পাবে জানাযার দিন। দেখা গেল আহমাদ ইবন আবু দাউদের মৃত্যুর পর তার জানাযায় তেমন কোনো লোক ছিল না। আর ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের মৃত্যুর পর তার জানাযায় অসংখ্য লোক অংশগ্রহণ করে এবং খলীফার পরিবারের শতাধিক সদস্য তাকে গোসল দিতে আসে। বাগদাদের প্রায় ২০ হাজার অমুসলিম সেদিন ইসলাম গ্রহণ করে। তা সত্বেও আসর বাদ তার দাফন সম্পন্ন হয়। মৃত্যু বরণ করেছিলেন ২৪১ হিজরির ১২ রবিউল আউয়াল শুক্রবার সকালে। দাফন হতে হতে আসর হয়ে গিয়েছিল। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বলের এ উক্তিকে হাতিয়ার বানিয়ে আজকাল অনেকে জানাযা নিয়ে রাজনীতি শুরু করেছে। অনেক আলেমের জানাযায় শো ডাউন হতে দেখা যাচ্ছে। যা শরীয়াতের দৃষ্টিতে স্পষ্ট বিদআত। একমাত্র অভিভাবকের জন্য বিলম্ব করা শরিয়তে বৈধ। এছাড়া বিরাট জনসমাগমের উদ্দেশে করোনাভাইরাসের বিশেষ অবস্থা ছাড়াও অন্য সময়েও জানাযা বিলম্বিত করা নাজায়েজ।


হাদীসের ভাষ্য অনুসারে জানাযা নামাজে জনসমাগম কাম্য। কিন্তু কতটা? কত লাখ মানুষ হতে হবে? মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে কোনো মৃত ব্যক্তির যানাযায় ৪০ জন মানুষ উপস্থিত হয়ে যদি তারা আল্লাহর দরবারে তার জন্য সুপারিশ করে তাহলে তাদের দুআ বা সুপারিশ কবুল হয়। আবু কুরাইব বর্ণনা করেন, হযরত ইবন আব্বাসের সন্তান মারা গেলেন উসফান বা কাদিদ নামক স্থানে। ইবন আব্বাস বললেন, দেখ তো জানাযার নামাযের জন্য কত জন মানুষ আছে? আবু কুরাইব বললেন, সামান্য কয়েকজন। ইবন আব্বাস বললেন, চল্লিশ জন হয়েছে কি? আবু কুরাইব বললেন, হ্যাঁ। ইবন আব্বাস বললেন, ৪০ জনই যথেষ্ট। এরপর রাসূল সা.-এর উপরোক্ত হাদীস শোনালেন।


ইয়া জামাল ইয়া হাবীবাল মালাইন। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাসের মৃত্যু বরণ করেন ১৯৭০ সালে। তার জানাযায় কয়েক মিলিয়ন লোক হয়েছিল। জানাযায় শরীক হওয়া মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ গান বানিয়েছিল। ইয়া জামাল ইয়া হাবীবাল মালাইন। মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের প্রিয় নেতা হে জামাল আব্দুন নাসের। জামাল নাসের মিসরের জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। মিসরের বিখ্যাত গায়ক আন্দালিব ও গায়িকা উম্মে কুলসুমের শেষকৃত্যেও কয়েক মিলিয়ন মানুষ হয়েছিল। অনেকে শোকে আত্মহত্যাও করেছিল।


পাকিস্তানের স্বৈর শাসক জিয়াউল হক বা কায়েদে আজম জিন্নার জানাযায়ও অসংখ্য মানুষ হয়েছে। আবার বঙ্গবন্ধুর দাফনের সময় হাতে গোনা কিছু মানুষ ছিল। নবী দুহিতা জান্নাতের নারীদের সর্দার মা ফাতেমা রা.-এর জানাযায় মাত্র ছয় সাত জন মানুষ ছিল। এমন অসংখ্য বুযুর্গ আছেন যাদের জানাযার খবর আশপাশের মানুষও জানতে পারেননি। ইমাম বুখারী, হারেস মুহাসেবি ও অসংখ্য মনীষীর ক্ষেত্রেই এমন ঘটেছে। মূলত জানাযায় লোক বেশি হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কোনো বিরাট কিছু নয়।


বিগত কয়েক বছরে আমরা দেখতে পাচ্ছি কোনো রাজনৈতিক আলেম মারা গেলে তার জানাযা পড়ার জন্য প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষ দল ধরে নামাজ পড়তে আসছে। আমাদের তথাকথিত আলেমদের জানাযায় কয়েক লক্ষ মানুষের ভীড় হয়েছে যা হযরত আবু বকর বা হযরত উমরের জানাযায়ও এত মানুষ হয়নি। রাসূলের যুগে নাজাসির জানাযায় দু কাতার হয়েছিল মাত্র। সাহাবায়ে কেরাম ইচ্ছা করলে দূর দূরান্ত থেকে অংশগ্রহণ করতে আসতে পারতেন। রাসূল সা. ও পারতেন বিরাট বড় জানাযা উৎসব করতে। কিন্তু করা হয়নি। এখন আমাদের যুগে এ কি শুরু হলো? আমাদের জন্য বোঝা মুশকিল। কোনো বড় আলেমের জানাযায় অনেক মানুষ হলে অন্য আলেমদের ভক্তবৃন্দও চেষ্টা তদবির করে যেন আরো বেশি মানুষ হয় তার অনুসৃত আলেমের মৃত্যুতে। তা না হলে সম্মান থাকে না। এ জন্যই মনে হয়, এ হচ্ছে এক ধরনের শো ডাউন। যা শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ বিদআত।


যারা দূর দূরান্ত থেকে এই জানাযা উৎসবে আসেন তারা কেন আসেন? মৃত ব্যক্তিটি অনেক ভালো মানুষ ছিলেন এজন্য? ভালো মানুষের জানাযায় না এসে খারাপ মানুষের জানাযায় যাওয়া উচিত। কারণ ভালো মানুষ তো এমনিতেই তার ভালো কাজের দ্বারা জান্নাত লাভ করবে। যারা খারাপ লোক তাদের দরকার হবে আপনার দুআ ও সুপারিশের।


যদি বলেন জানাযায় শরীক হলে এক কিরাত সওয়াব হয়। সহি হাদীসে রয়েছে। তাহলে বলব, বাড়ির পাশে লোক মরলে তার জানাযায় শরীক হন না, আর কয়েকশ মাইল পাড়ি দিয়ে সওয়াব হাসিল করতে আসছেন? আপনি চরম মিথ্যুক। নিজেকে ধোঁকা দিচ্ছেন। মূলত আপনি দল ভারি করতে আসছেন। সওয়াব পেতে চাইলে আমি বলব, এসময় প্রতিদিন তালতলায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে যারা শহীদ হচ্ছেন তাদের জানাযায় লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দয়া করে এখানে এসে সওয়াব হাসিল করুন। ইসলাম ধর্মকেই একটা হালকা বানিয়ে ছেড়েছে ভণ্ড লোকেরা। এদের মূর্খতার কোনো সীমা নেই। হয়ত ভবিষ্যতে মনীষীরা ওসিয়ত করে যাবেন তাদের জানাযায় লোকসমাগমের জন্য যেন অপেক্ষা না করা হয়। আমার মনে হয় শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এ ফিতনার যুগে এমন ওসিয়ত করাটা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।


কারো জানাযায় লোক বেশি হলে সে মহৎ হয়ে যায় না। কার কি অবস্থা আল্লাহই ভালো বলতে পারবেন। পরকালে প্রত্যেকের প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পাবে। এখন যারা সাধারণ মানুষকে ধোঁকা দেয়ার জন্য সবখান থেকে লোক জড়ো করে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ দিতে চাচ্ছেন তাদের ভণ্ডামি ঠিকই মানুষের কাছে প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে।


মাওলানা আনসারির জানাযার আগে মাইকিং করে বহু দূর পর্যন্ত জানানো হয়েছে। আপনারা ঘরে বসেই তার জন্য দুআ করুন, প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিষেধ আছে কেউ জানাযায় শরীক হবেন না।


মানুষের স্বভাব হচ্ছে যে বিষয়ে নিষেধ করা হয় তাতে আরো বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে। যারা যেত না তারাও ভাবে প্রশাসন কেন নিষেধ করবে? আমরা যাবই। এসব হচ্ছে নোংরা রাজনীতি, যা দুঃখজনকভাবে নামধারি তথাকথিত আলেমদের ভেতরও ঢুকে পড়েছে। মরহুম জুবায়ের আহমেদ আনসারীর মৃত্যু হয় ১৭ এপ্রিল বিকাল ছয়টায়। সেদিন রাতযাপন হাদীসের ভাষ্য অনুসারে কবরে হওয়া উচিত ছিল। পরদিন সকাল দশটায় জানাযা কোনোভাবেই হাদীসের উপর আমল নয়। বিশেষত এই করোনার সময়ে যারা ঢাকা থেকে সেখানে গিয়েছে তারা গর্হিত অপরাধ করেছেন। আল্লাহ তাদের তাওবা নসীব করুন। মরহুম আনসারিসহ সকল বিদেহি মুসলিম নর নারীকে ক্ষমা করুন। মৃতদের লাশ নিয়ে এমন নোংরা রাজনীতির ধারা আমাদের দেশে বন্ধ হোক। আমীন।


লেখক: মুফতী ও মুহাদ্দিস, জামিআ ইকরা বাংলাদেশ।


বিবার্তা/জহির

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com