করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মহামারী আকার ধারণ করছে তা প্রতিঘন্টার পরিসংখ্যান লক্ষ্য করলেই সুস্পষ্ট। ৮ মার্চ ২০২০ বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর এর সংক্রামন ঠেকাতে তৎপর গোটা দেশ। সংক্রামন ঠেকানোর প্রথম উপায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শ এড়ানো। বাংলাদেশ এই রোগ এসেছে বিদেশ থেকে।
গত দুই সপ্তাহে প্রায় দুই লাখেরও অধিক প্রবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশে ফিরেছেন।
বিদেশফেরত এসব ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য-পরীক্ষা করা হয়নি। তারা সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। আর এভাবেই গোটা দেশ করোনাভাইরাস ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
বিদেশ ফেরত ব্যক্তিরাই যেহেতু এইদেশে মরনঘাতী করোনাভাইরাস নিয়ে আসার একমাত্র উৎস, তাই তাদের নিজ নিজ বাড়িতে হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকার বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। ফরিদপুরের শিবচর ও গাইবান্ধার সাদুল্ল্যাপুরে জনমনে আতংক ছড়িয়ে পড়ার খবর গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। স্বভাবগতভাবেই বাঙালি-নির্ভীক, আলাপী এবং অতিথিপরায়ন এক জাতি। প্রশ্ন হলো তাদের পক্ষে সূদুর ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশ বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসে ঘরে বসে থাকা কি করে সম্ভব? দশ গ্রামের লোকজনকে আওয়াজ না দিলে, তাদের নিয়ে পাড়ার চায়ের স্টলে আড্ডা না দিলে, হাট বাজারে ঘুরে ঘুরে লোকজনের সাথে করমর্দন, কদমবুসি, কোলাকুলি না করলে জানবে কি করে লোকজন যে তিনি বিদেশ থেকে এসেছেন? জানবে কি করে যে গ্রামের সবচেয়ে রঙচটা নতুন সুরম্য ভবনখানির তিনিই মালিক? এদের অনেকেই আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে জেল-জরিমানা গুনছেন। অনেকেই অনেক অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতার শিকার হচ্ছেন। অধিকাংশই এখন বাধ্য হয়ে হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকছেন।
হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য বই হতে পারে সেরা এক সঙ্গী। মাত্র এই দুই সপ্তাহে আপনি গড়ে তুলতে পারেন এমন এক অভ্যাস যা মহামারী-লগ্নে কিংবা মহামারী-উত্তর গোটা জাতিকে পথ দেখাতে সক্ষম।
অতীতে একসময় হয়তো আপনি ভালো একজন পাঠক ছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় ব্যস্ততার নিরিখে সে অভ্যাসটি হয়তো ভোতা হয়ে গেছে। এই সুযোগে নিন না সেটি ঝালাই করে। ঘরে বসে মোবাইলে হাজারটা গুজব; টিভিতে শত রকমের দুঃসংবাদ শুনে মন ভারাক্রান্ত করে কি লাভ? পড়ুন না মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। পড়ুননা একটি ভালো প্রেমের উপন্যাস, রবীন্দ্রনাথ পড়ুন, শমরেশ, শংকর পড়ুন। হুমায়ুন আহমেদ পড়ুন। অথবা শামসুর রাহমানের লেখা বিখ্যাত কোনো কবিতা পাঠ করুন। এরপরও কিছুই ভালো লাগছেনা? পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করুন। সুস্থ-সুন্দর জীবন ধারনে যা সহায়তা করবে।
কোয়ারেন্টাইনের এই দুই সপ্তাহ আপনি উৎসর্গ করতে পারেন জ্ঞান-অন্বেষণে। এতদিন যে বইটি আপনি পাঠ করার প্রয়োজন অনুভব করেননি। ধুলোর আস্তর পড়ে আছে মলাটে। কোনোদিন ভাবেননি এত চমৎকার একটি বই অনাদরে অবহেলায় ফেলে রেখেছিলেন বুক-শেলফে। আজ যখন নিয়তি আপনাকে এ সুযোগ করে দিলো তাহলে আর বিলম্ব কেন? গ্রামের বাড়িতে যদি পাঠোপযোগী বই না থাকে তাহলে স্থানীয় প্রশাসনকে বলুন। তারা এর ব্যবস্থা করে দিবে। বাংলাদেশে এখন এমন একটি গ্রামও কি আছে যেখানে লাইব্রেরি বা তথ্যকেন্দ্র নেই?
গত ২৪ মার্চ ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে দেখলাম, পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা খালিদা খাতুন হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের মাঝে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে বই উপহার দিচ্ছেন। তার উপজেলায় ৫৮ জন ব্যক্তি বিদেশ থেকে এসে হোম-কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন। যাদের মধ্যে ৪৩ জনকে তিনি বই উপহার দিয়ে হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। দারুন এ-মহতী উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন অনেকেই। প্রতিটি উপজেলায় যদি এভাবে স্থানীয় প্রশাসন কিংবা কোনো বিত্তবান ব্যক্তি অথবা কোনো স্থানীয় পাবলিক লাইব্রেরি বা এনজিও লাইব্রেরি এই উদ্যোগ গ্রহণ করে নিঃসন্দেহে তা জ্ঞান-ভিত্তিক সমাজ গঠনে সহায়ক হবে। পাশাপাশি কোয়ারেন্টাইনের এই বন্দী সময়টা সুন্দর ও সুস্থ চিন্তায় কাটবে। লোপ পাবে করোনাভাইরাসের বিস্তার এবং বৃদ্ধি পাবে সচেতনতা।
তাছাড়া একজন তথ্য পেশাজীবী হিসেবে আমরা জানি যে মাতৃত্বকালীন গর্ভাবস্থায় একজন মাকে একটি বই কিভাবে তার মানসিক বিকাশে সহায়তা করে। ‘বিবলিওথেরাপী’ বলে সুপরিচিত একটি কৌশল এই হোম-কোয়ারেন্টাইনকালীন আমাদের সহায়তা করতে পারে। বিষয়টি একটু বিশ্লেষণ করা যাক। বিবলিওথেরাপী কি?
বিবলিওথেরাপী হচ্ছে এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে রোগীর মানসিক রোগী তার রোগ-সংক্রান্ত বিষয়ে সাকসেস-স্টোরি পাঠ করে মানসিক সাহস সঞ্চয় করেন। আরেকটু পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করলে বলা যায় যে- একজন রোগী যদি তার রোগ সম্পর্কে সুস্থ হওয়ার বিভিন্ন খুটিনাটি তথ্য পায় এবং বেষ্ট-প্রাকটিসগুলো আত্মস্ত করতে পারে তাহলে তার মানসিক সাহস অনেকগুন বেড়ে যায় যা তাকে দ্রুত নিরাময়ে সহায়তা করে। পৃথিবীর অনেক দেশ বিবলিওথেরাপীর মাধ্যমে অনেক ক্রোনিক-ডিজিজের চিকিৎসা করে থাকে।
ক্রান্তিকালীন হোম-কোয়ারেন্টইনের এই সময়টাতে চীনের উহানের সফল কাহিনী; ফ্রান্স ও জাপানের করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ কাহিনী হতে পারে আমাদের ১৭ কোটি বাঙালির মনোবল শক্ত রাখার এক অনন্য উদাহরণ। তাই বই, জার্নাল বা অন্য কোনো নন-বুক রিডিং ম্যাটেরিয়ালের সাহায্যে এসব সফল কাহিনী গল্প আকারে বোধগম্য ভাষায় পাঠ করলে হোম-কোয়ারেন্টাইনের এই সময়টা দারুন কাটবে। সকলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকতে উদ্বুদ্ধ হবে।
আর এভাবেই নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে দূরে রাখার মাধ্যমে সোসাল ডিস্টেন্স তৈরি করে করোনাভাইরাসের আগ্রাসী বিস্তার রোধ করা সম্ভব হবে।
করোনাভাইরাস ঠেকানোর দায়িত্ব শুধু সরকার বা প্রশাসনের নয়। আপনার-আমার সকলের। মহামারী কোনো দলীয় বা রাজনৈতিক বিষয় নয়। ধর্মীয় বা ব্যক্তির ইগোর বিষয় নয়। ধনী-গরিবের বিষয় নয়। এধরণের দৈব-দুর্বিপাকে সকল সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। স্বাস্থ্য-বিধি মেনে চলা প্রয়োজন। বিপদে সমালোচনা বা বিমুঢ়তা নয়। দরকার দক্ষতা। বিপদ চিরদিন থাকে না। কিন্তু অর্জিত জ্ঞান অনন্তকাল আলো ছড়ায়। তাই আসুন বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলি। সুস্থ ও সুন্দর চিন্তার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করি কোয়ারেন্টাইনের এই ক’টা দিন।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. নাসির উদ্দীন মিতুল, ডিন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
বিবার্তা/জাহিদ
সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি
এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)
১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫
ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫
Email: [email protected] , [email protected]