শিরোনাম
সমাজটা কী করে এতটা পচে গেল?
প্রকাশ : ১৭ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৫৪
সমাজটা কী করে এতটা পচে গেল?
অনিকেত রাজেশ
অনিকেত রাজেশ
প্রিন্ট অ-অ+

খুন-ধর্ষণ যেখানে নিত্যদিনের স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেখানে দিন-দুপুরে প্রকাশ্যে রাস্তায় কুপিয়ে হত্যা খবর বটে। একটি শিশুকে বীভৎসভাবে খুন করে গাছে ঝুলিয়ে রাখাটাও একটা আগ্রহ উদ্দীপক খবর। আবরার হত্যার বিষয়টি এতটা আলোচিত খবর হতে পেরেছে এবং এতটা নাড়া দিতে পেরেছে, সে বুয়েটের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিল বলে।


এমন অসংখ্য ঘটনা দেশে ঘটে চলেছে, যেগুলো হয়তো আলোচিত খবর হয়ে ওঠে না। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বরগুনার হিংস্র পাশবিক ঘটনার ভিডিওটি দেখিনি আমি, দেখার সাহস নেই বলে। কেবল সংবাদটি পড়েছিলাম আর কিছু ছবি দেখেছিলাম। সেই চাপ নিতে অনেকদিন লেগেছে। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরপর একেকটি নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলেছে। কেন হচ্ছে এমন?


পত্রিকায় প্রায়ই খবর আসছে- বাবা ছেলেকে খুন করিয়েছে, বাবা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে, পরকীয়ায় আসক্ত মা প্রেমিকের যোগসাজশে ঠাণ্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে নিজের স্বামীকে খুন করছে, তার নিজের সন্তানকে খুন করছে। দুর্নীতি যেখানে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেখানে হারিয়ে যাওয়া একটি মানিব্যাগ ফেরত পাওয়াও গুরুত্বপূর্ণ খবর। যেহেতু ঘটনাটিকে অস্বাভাবিক হিসেবেই গণ্য করে সমাজ।


জন-নিরাপত্তা (সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়টি আরও অনেক ব্যাপক ও ভিন্ন) বলতে কিছু নেই আসলে। ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও আত্মস্বার্থকেন্দ্রিক মানসিকতার বাইরে যেতে পারে না এ সময়ের মানুষ। বিবেকবোধ নামক বিষয়টিকে মাটিচাপা দিয়েই আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অন্ধভাবে ধাবিত হচ্ছে যেন প্রত্যেকে। মানবিকতা তো বহুদূরের বিষয়। মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়ের এ সময়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কি আদৌ কোনো প্রচেষ্টা আছে কোন দিক থেকে? নেই তো!


এই যে একেকটি অপরাধমূলক ঘটনার পরপর আমরা অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলি আমরা অথবা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিশ্রুতি শুনি অহরহ, তার পরিপ্রেক্ষিতে কতটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে আসলে? সামাজিক অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে তেমন দৃষ্টান্ত তো আমি খুঁজে পাই না খুব একটা। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানে তো যে শাস্তির কথা মাথায় নিয়ে অপরাধী নিশ্চিত শাস্তির ভয়ে অপরাধ করা থেকে বিরত থাকবে। তেমন দৃষ্টান্ত কই?


বরগুনার মতো একটি মফস্বল শহরে প্রকাশ্য রাস্তায় রিফাতকে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার যে ঘটনাটি ঘটেছিল, সেখানে কি স্থানীয় পর্যায়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সামাজিক প্রতিরোধ লক্ষ করা গিয়েছিল? সেখানে কিন্তু সবাই সবাইকে চেনে-জানে। যে মারা গেল, যারা মারল আর যারা পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভয়ংকর রক্তপাতের দৃশ্যটি দেখছিল, তারা সবাই সবাইকে চিনত। অথচ মানুষ ছিল নির্বিকার ! বুয়েটের ঘটনাটিও অনেকটা তাই। অথবা মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনাটির পর কী প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল? মাদ্রাসার অভিযুক্ত অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে সেখানে প্রকাশ্য মিছিল হয়েছে!


সুনামগঞ্জের দিরাইতে মাত্র ৫ বছরের ছোট্ট শিশু তুহিনের খুনের ঘটনাটি কি মানুষের বিবেককে এতটুকু নাড়া দেবে? পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, নিষ্পাপ তুহিনের বাবা-চাচাই ওই নৃশংস ঘটনাটি ঘটিয়েছে। গ্রামের প্রতিপক্ষ গ্রুপকে ফাঁসানোর পরিকল্পনা থেকে নিজের সন্তানকে বীভৎস পন্থায় খুন! এও সম্ভব! কী করে পারল তারা! এই সয়ে-যাওয়া ক্ষয়ে যাওয়া সমাজ কি এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারবে?


একেকটা খুন, ধর্ষণ বা বড় কোনো অপরাধমূলক ঘটনার বিচার চাওয়াটাও এখানে মমতা বা সহমর্মিতার জায়গা থেকে আসে না (সকলের ক্ষেত্রে নয়)। এদেশের মানুষের একটা বড় অংশেরই অপরাধের বিচার দাবি করার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে এক ধরনের প্রতিহিংসা, জিঘাংসা। অনেকেই হয়তো মানতে চাইবেন না। কিন্তু এ বাস্তবতাই বিরাজ করছে দেশে। বাঙালি জাতীয়বাদের চেতনার ভিত্তিতে ৩০ লাখ শহীদের রক্তের মূল্যে অর্জন করা দেশে এখন উগ্র ধর্মভিত্তিক চেতনা ক্রমশ বিস্তার লাভ করছে। অথচ সেখানে মূল্যবোধের বা নীতি-নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। ধর্মের কোনো অনুশাসনের বালাই নেই। নেই মানবিকতার কোনো শিক্ষা। ধর্ম কেবলই নিজের গা বাঁচানো এবং প্রভাব বিস্তারের একটি শক্তিশালী অমোঘ হাতিয়ার মাত্র।


এখানে দিকে দিকে নিত্যদিন কেবল হিংসার চাষাবাদ হচ্ছে। যারা ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই’ বলে নিয়মিত চিৎকার করেন, তারাই ভিন্নমত গ্রহণ করতে পারা বা তার প্রতি শ্রদ্ধা তো দূরে থাক, ভিন্নমতের প্রতি বরং বেশি আক্রমণাত্মক! তাদের কাছে ভিন্নমত প্রকাশ করা মানে হচ্ছে, প্রতিপক্ষকে গালাগালি করার স্বাধীনতা, ভিন্নমত মানে প্রতিপক্ষের বিপক্ষে নিজের পক্ষের মত! এ দেশটিতে অনেক পক্ষ এবং সবারই একটি প্রতিপক্ষ আছে। প্রতিপক্ষ অপরাধের দায়ে বেকায়দায় পড়লে তাদের খুব আনন্দ হয়। অথচ মন থেকে তারা চান না, অপরাধটি না হোক। কেবল নিজের প্রতি বা নিজের সাথে না হলেই হলো। নিজের পক্ষের লোকের সাথে হলে ভালো।


বাঙালির হাজার বছরের লালিত সমাজ কী করে এতটা পচে গেল? কবে পচে গেল? আমরা কি ভাবছি? রাষ্ট্রের যথাযথ চরিত্র কি নির্মাণ করতে পারছি আমরা? আমাদের রাজনীতিকরা? এত এত উন্নয়ন, একটি গর্বিত জাতি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার স্বপ্ন- সব কি মিথ্যে হয়ে যাচ্ছে না? একজন শেখ হাসিনাকে আর কতটা পারতে হবে- কতটা ভার বইতে হবে একা একা?


লেখক: অনিকেত রাজেশ, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী


বিবার্তা/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com