শিরোনাম
প্রবারণা পূর্ণিমা ও বুদ্ধের শিক্ষা
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০১৯, ২০:৫১
প্রবারণা পূর্ণিমা ও বুদ্ধের শিক্ষা
রোমানা পাপড়ি
প্রিন্ট অ-অ+

আজ পবিত্র প্রবারণা পূর্ণিমা, বৌদ্ধদের দ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব যার অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা বা বড় ছাদাং। বৌদ্ধ বিশ্বে এ পূর্ণিমা বিশেষ একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। শরতের মেঘমুক্ত আকাশ ও নির্মল পরিবেশে বাংলাদেশের বৌদ্ধ সম্প্রদায় যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসব মুখর পরিবেশের মধ্য দিয়ে পালন করছে দিনটি। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর জন্য একটি স্মৃতিবিজরিত, তাৎপযপূর্র্ণ, বৌদ্ধ জাতির গর্ব ও আনন্দের দিন। কারণ মহামতি বুদ্ধ বর্ষাব্রতের পর প্রবারণান্তে ৬০ জন অর্হৎ ভিক্ষুকে দেব-দানবের হিতার্থে ধর্ম প্রচারের নির্দেশ প্রদান করেন “ভিক্ষুগণ আত্মহিত ও পরহিতের জন্য, বহুজনের হিতের ও সুখের জন্য আদি-মধ্য-অন্তে কল্যাণকর ধর্ম দিকে দিকে প্রচার কর।”এবং স্নেহময়ী মাতৃদেবীকে নির্বাণ পথ প্রদর্শান্তে তাবতিংস স্বর্গ হতে সাংকাশ্য নগরে অবতরণ ও নানাবিধ ঋদ্ধি প্রদর্শন এবং ভিক্ষুগণের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত সমাপ্তি ঘটে। বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যা জনগণের হিত কামনার জন্য মূলত মহাকারুণিক বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমার তিথিতে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের তিন মাস বর্ষাব্রত পালনের জন্য নিজ বৌদ্ধমন্দির ও প্যাগোডায় অবস্থান করার বিধান করেছিলেন। এভাবেই আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে শ্রাবণী পূর্ণিমা হয়ে মধু পূর্ণিমা বা ভাদ্র পূর্ণিমা তারপরই আজকের প্রবারণা পূর্ণিমা। এসময় ধর্মপ্রাণ গৃহীরা উপোসথ/অষ্টশীল অধিষ্ঠান শেষ করে প্রবারণা পূর্ণিমায় অংশগ্রহণ করেন।


সংস্কৃত ‘প্রবারণা ‘পালিতে’ পবারণা’ শব্দটির বিশেষ অর্থ রয়েছে। বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট, ঢাকা থেকে প্রকাশিত পালি-বাংলা অভিধানে (দ্বিতীয় খ-), পৃ. ১০৫৮ এ প্রবারণা শব্দের অর্থ দেয়া আছে, নিমন্ত্রণ, আহ্বান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, ত্যাগ, শেষ, সমাপ্তি, ভিক্ষুদের বর্ষাযাপনের শেষ বা পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগ, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার বিধি। ’প্র’ উপসর্গের সাথে ‘বারণ’ শব্দ যোগে প্রবারণা অর্থাৎ প্রকৃষ্টভাবে অকুশল কর্ম করা বারণ। মহাবর্গের পৃ. ১৬৭ এ উল্লেখ আছে, ভগবান বুদ্ধ যখন শ্রাবস্তীর জেতবনে ছিলেন, কোশল থেকে ভিক্ষুরা এসেছিলেন বর্ষাবাসের শেষ করার পর বুদ্ধের সাথে সাক্ষাৎ করতে। বুদ্ধ তাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন বর্ষাবাস কিভাবে উদযাপন করেছে, তারা উত্তর না দিয়ে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করেন। ভিক্ষুদের অবস্থা দেখে বলেন, “ভিক্ষুগণ, তোমাদের এ আচরণ প্রশংসাযোগ্য নহে। ভিক্ষুসংঘ এক স্থানে বাস করতে গেলে বহু বাদ-বিসংবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নহে। বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা একত্রিত হয়ে প্রবারণা করবে। পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং পরস্পরকে সত্যিকারভাবে বরণ করে নিবে। তোমার যেমন দোষ-ত্রুটি থাকা অস্বাভাবিক নহে, সেরূপ অন্যের দোষ-ত্রুটি থাকাও স্বাভাবিক। এক স্থানে থাকবার সময় পরস্পর পরস্পরকে অনুশাসন বা ক্ষেত্র বিশেষ বারণ করলে উভয়ের মঙ্গল হয়। শাসন পরিশুদ্ধ হয়।’ আশ্বিনী পূর্নিমার গাথা (সদ্ধর্ম-রত্ন সংগ্রহ, চৌধুরী, সাধক শিশির বড়ুয়া সংকলিত, চট্টগ্রাম, ২০১৬, পৃ. ৯১ ও ৯২


১. আশ্বিনী পূর্ণিমা তিথি অতি শোভাময়,


প্রকৃতির রাজ্যে সবে আনন্দিত রয়।


মাঠভরা ধানক্ষেত সোনার বরণ,


দেখিতে সুন্দর কত না যায় ব্যর্ণন।


২. মৃদু মৃদু বায়ু যবে প্রবাহিত হয়,


অপূর্ব তরঙ্গ খেলে ধানক্ষেত ময়।


গোলাপ, টগর, চাঁপা, শেফালি, মালতি,


জলপদ্ম, স্থলপদ্ম, বেল, জবা, জ্যোতি।


৩.সুন্দর কুসমরাশি বিকাশিয়া যবে,


সুমধুর গন্ধদানে তৃপ্ত করে সবে।


কমলিনী, কুমুদিনী ফোটে সরোবরে,


অলিকুল তাহে নিত্য গুণ গুণ করে।


৪.পূর্ণ শশাঙ্ক আলো শান্ত ¯স্নিগ্ধময়,


কুমুদিনী পেয়ে তারা আনন্দিত হয়


প্রত্যুষে বিহঙ্গকুল ডানা বিস্তারিয়া,


কলকল শব্দ করে আনন্দে মাতিয়া।


৫.এমন সুন্দর দিনে বুদ্ধ প্রাণধন,


তাবতিংসে বর্ষাবাস করি সমাপন।


মাতৃঋণ শোধ করেন ধর্ম দান দিয়া,


স্রোতাপত্তি লভেন মাতা স্বর্গেতে বসিয়া


৬.তিনমাস পরে বুদ্ধ আসেন ফিরিয়া,


স্বর্ণ-রৌপ্য-মণিময় দিব্য সিঁড়ি দিয়া।


সাংকাশ্য নগর দ্বারে আসেন নামিয়া,


উঠিল সাধুবাদ ধ্বনি রহিয়া।


৭. দেব-ব্রহ্মা-নর সবে তদা পরস্পর,


অবাদ দৃষ্টিতে দেখে পরম সুন্দর।


এই সম্মেলন ক্ষণে দেব-ব্রহ্মা-নর,


সাধুবাদ করি তোলে ভুবন মুখর।


৮. এমন সুন্দর দিনে মোরা সবে মিলি


সর্বজ্ঞ বুদ্ধকে পূজি ভক্তি প্রাণ খুলি।


আশ্বিনী পূর্ণিমা দিনে আজি ভক্তগণ,


মিলন প্লাবনে কর মন সংযোজন।


বৌদ্ধধর্মের মূলবাণী হচ্ছে অহিংসা, শান্তি, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহাবস্থান করা। অন্যান্য ধর্মের মধ্যেই এই মর্মবাণী উচ্চারিত হয়েছে। ক্ষমাশীলতার আদর্শে উজ্জীবিত হতে বুদ্ধ মানুষকে জীবন-ধারণ করতে বলেছেন । সুতারাং ক্ষমাশীলতা, ধৈর্য, সহনশীলতা, বিনয় এবং উদারতা পারে বিজয় ও সফলতা এনে দিতে। এছাড়া আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে বুদ্ধ পরিবেশের কথা চিন্তা করে ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের তিনমাস বিহারে থাকার প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এসময় অনেক ছোট ছোট গাছপালার জন্মে ও বর্ষার কারণে ছোট প্রাণিদেরকে দেখা যায় না তবে হাঁটতে বা চলাফেরা করতে গেলে প্রাণি বা উদ্ভিদের নাশ ঘটতে পারে এই আশংকাতেই তিনি এ নিয়ম চালু করেন। ফলে, বর্ষা অতিবাহিত হওয়ার পর প্রবারণা পূর্ণিমা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ভিক্ষুদের ২২৭টি এবং ভিক্ষুনীদের ৩১১ টি শীল পালনের কথা বিনয় পিটকে উল্লেখ আছে। এর সাথে পরিবেশ রক্ষার দিক নির্দেশনার কথা শীল প্রতিপালনে উল্লেখ করা হয়েছে। বুদ্ধ শুধু প্রাণিদের জীবন রক্ষার কথা বলেননি তিনি উদ্ভিদ ও তৃণের জীবন রক্ষার কথা বলেছেন। সুতারাং আমরা সবাই পরিবেশ সংরক্ষণে বুদ্ধের ভাবনাগুলোকে কাজে লাগিয়ে সুন্দর, নির্মল ও স্নিগ্ধ পরিবেশ প্রজন্মকে উপহার দিতে পারি।


সাধারণত যেকোনো পর্বদিনে বৌদ্ধরা নিজেদের বাড়ি-ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করেন। এদিকে বিহারগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও আলোক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়। ধর্মপ্রাণ বৌদ্ধরা সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান সেরে তাদের দৈনন্দিন কাজ করে পরিষ্কার বা নতুন পোষাকে বিহারে যান।বৌদ্ধ বিহারে-নারী পুরুষের সমান অধিকার তাই তারা একসাথে বসে দান-শীল পূন্য কাজ করেন। বিহারে অনুষ্ঠানমালায় থাকে জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, ভিক্ষুসংঘের প্রাতরাশ, মঙ্গলসূত্র পাঠ, বুদ্ধপূজা, পঞ্চশীল ও অষ্টাঙ্গ উপোসথ শীল গ্রহণ, মহাসংঘদান, অতিথি আপ্যায়ন, পবিত্র ত্রিপিটক থেকে পাঠ, আলোচনা সভা, প্রদীপ পূজা, বিশ্বশান্তি কামনায় সম্মিলিত বুদ্ধোপাসনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বুদ্ধ-কীর্তন। বুদ্ধকীর্তনের সময় ঢাক-ঢোল, মন্দির-কাসা শব্দে মুখরিত হয় বিহার প্রাঙ্গন। সর্বোপরি বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে সন্ধ্যায় ফানুস উড্ডয়ন পর্ব থাকে। ফানুস উড়ানো দেখার জন্য ধর্ম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সবাই অংশগ্রহণ করে এবং আনন্দ ভাগ করে নেন সবাই। পত্র-পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশনে প্রবারণা পূর্ণিমা তাৎপর্য তুলে ধরে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয় সাথে দিবস উপলক্ষ্যে বিশেষ প্রকাশনা প্রকাশিত হয়ে থাকে। ফলে এভাবেই সবার মাঝে অসম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির বন্ধন বিরাজ করে।


লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/জাই


সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com