শিরোনাম
আগস্ট পরবর্তী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রথম সংকলন
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়
প্রকাশ : ০১ অক্টোবর ২০১৯, ১৬:১১
এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ফাইল ফটো)
সোহানুজ্জামান
প্রিন্ট অ-অ+

‘চাটুকারিতা’ ও ‘সময়ের প্রয়োজন’- কথা দুটির মধ্যে পার্থক্য আকাশ-সমান। সময়ের প্রয়োজনে ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি যে কাজ করে, তার মূল্য যে চাটুকারিতায় সম্পাদিত কাজের অনেক ঊর্ধ্বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চাটুকারিতা ব্যাপারটা সংগঠিত হয় চাটুকারের পক্ষের ক্ষমতা-কাঠামোর সাথে সাথে। কিন্তু সময়ের প্রয়োজনে যারা কাজ করে তারা যে বেশ অসহায়ত্বের মধ্য দিয়ে কাজ চালিয়ে যান; তাদের মাথার ওপর রয়ে যায় হাজার ঝুঁকি-ঝামেলা।


ক্ষমতা-কাঠামোর সাথ আঁতাত করে ফায়দা হাসিল করার জন্য লোকজনের অকেজো কাজের দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু বর্তমানে ক্ষমতায় আসীন নয়, একইসাথে বর্তমানের ক্ষমতাকাঠামোর বিপক্ষ ও বিপরীতে অবস্থান করছে এমন মানুষকে নিয়ে, বিষয় নিয়ে চাটুকারিতা হয় না; হয় না সামান্য লেখাজোকা, বা উচ্চবাচ্য। কিন্তু এমন অবস্থানে আসলেই যারা এ উচ্চবাচ্যের দাবিদার, তাদের নিয়ে যারা কথা বলেন, মূলত তারাই সময়ের প্রয়োজনে কাজটা করেন; আসলে যার গুরুত্ব অপরিসীম। এ রকমই একটা সংকলন : এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়, প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। এটা একটি কবিতার সংকলন; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর।


কেউ কেউ বলবেন, এটা তো নিছকই একটা কবিতার সংকলন, এর কী এমন মূল্য থাকতে পারে। কিন্তু বাংলা সাহিত্যের দিকে নজর দিলে আমরা দেখি যে, তিন যুগের মধ্যে দুই যুগই সামনে এগিয়েছে কবিতা নিয়ে। কবিতাই বাংলা সাহিত্যের ভিত্তি-উপাদান। কবিতাই ছিল বাংলা সাহিত্যের আসল ও অকৃত্রিম রূপ হিসেবে।


এ সংকলনকে তুলনা করা যেতে পারে একুশের সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারির সাথে। একুশে ফেব্রুয়ারির সম্পাদক ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সওগাতের অফিসে বসে এই সংকলনের পরিকল্পনা করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। হাসান হাফিজুর রহমান কী করেননি এই সংকলন করতে গিয়ে! টাকার ভীষণ অভাব, গ্রামের বাড়ি গিয়ে বাপের আধ-শুকনো পাট বিক্রি করে টাকা জোগাড় করেছেন। সেই টাকা দিয়ে করেছেন সংকলন। সৈয়দ শামসুল হককে বলেছেন গল্প দিতে। এক পৃষ্ঠায় সৈয়দ হক গল্প দিতে পারছেন না। পরে টেবিলে বসিয়ে লিখিয়ে নিলেন ‘সভ্যতার মণিবন্ধে সময়ের ঘড়ি’।


হাসান হাফিজুর রহমান যে সময় এই সংকলন করছেন, তখন পাকিস্তান পূর্ব বাংলা শাসন করছে শোষণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু এমন সময়েও হাসান হাফিজুর রহমান এমন একটা সংকলন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ এর আগস্টের পর অনেক বাঘা বাঘা সম্পাদকও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কিছু করেননি। গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা লেখার চেষ্টা করেননি। এমনকি এড়িয়ে গেছেন একেবারে। কারো কারো অবস্থা এমন ছিল যে তারা বঙ্গবন্ধুর নাম শোনেনি! ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের যে বিরাট প্রভাব প্রতিপত্তি বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি জগৎকে দখল করেছিল তার প্রাথমিক উদাহরণ ছিল একুশে ফেব্রুয়ারি। মনে রাখা জরুরি যে, একুশে ফেব্রুয়ারিই ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রথম দলিল, যেখানে একইসাথে উঠে এসেছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস; ঠিক সেই সাথে সাথে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিও।


একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলন যখন সম্পাদনা করছেন হাসান হাফিজুর রহমান, তখন তিনি পাশে পাচ্ছেন অনেককে; অনেককে বলতে দেশের এখনকার হিসেবে সবচেয়ে বড় বড় সাহিত্যিকদের। এছাড়া সাহিত্য নির্মাণের দিক থেকে এতোটা বন্ধ্যা সময়ও পাননি হাসান হাফিজুর রহমান। কিন্তু সূর্যতরুণ গোষ্ঠী যখন এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় সম্পাদনা করে সংকলন বের করতে যাচ্ছেন, তখন তেমন কাউকেই পাশে পাননি। পাবেন কী করে! যখন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার মন্ত্রীরাই মিশে গেছে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায়! সে যাই হোক। ফলে এ সংকলনের সম্পদনায় যারা নিযুক্ত ছিলেন, যারা লেখা দিয়েছিলেন, তাদের জন্য ব্যাপারটা কতটা সঙ্কাজনক ছিল; আর কতোটাই বা ঝুঁকি নিয়ে এ তরুণেরা সেদিন বঙ্গবন্ধু-হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সংকলন করেছিলেন, তা সামান্য অনুধাবনেই স্পষ্ট হয়। কিন্তু এই সাহসী তরুণেরা সেদিন তা করে দেখিয়েছিলেন।


বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকতে তার কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণকারীরাও সেদিন আর বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়নি, নিয়েছিল অন্য নাম; যে নাম নিলে ফায়দা লুটা যায়, হাসিল হয় স্বার্থ। হাসান হাফিজুর রহমান একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পদনা করেছিলেন সময়ের প্রয়োজনেই, লেখকরাও লিখেছিলেন সময়ের প্রয়োজনেই। ঠিক তেমনি করেই এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় সম্পাদনা করেছিলেন এই সংকলনের সম্পাদকবৃন্দ; এবং সময়ের প্রয়োজনেই লেখা দিয়েছিলেন এই সংকলনের লেখকরা। সময়ের প্রয়োজন ও স্বার্থ হাসিলের মধ্যে যে বিস্তর পার্থক্য বিদ্যমান, তা এই সংকলনই আমাদের আবার মনে করিয়ে দেয়।


কিন্তু এ সংকলনের নাম কি এমন কেউ মনে রখেছে? রাখেনি। রাখবে না, এটাই স্বাভাবিক। কারণ এ সংকলনের সম্পদাকবৃন্দ এবং লেখকেরা লিখেছিলেন মোহশূন্যতায়, লোভশূন্যতায়। কিন্তু সেই দুঃসময় পার করে দেশ আবার স্থির অবস্থায় ফিরলে আমরা দেখি যে, এবং এখনো দেখছি : বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শয়ে শয়ে নয় হাজারে হাজারে সংকলন বের হচ্ছে। এবং তা যে শুধু দালালি, চাটুকারিতা এবং স্বার্থ হাসিলের জন্যই, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষমতাবানের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ভাঁড়েদের কর্মকাণ্ড সেই মধ্যযুগের রাজদরবারে যেমন ছিল, এখনো তার পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু ক্ষমতাবান ও চলতি ক্ষমতা-কাঠামোর বাইরে গিয়ে এসব দালাল আর ভাঁড়েরা পারে না কিছু বলতে; কিংবা করতে। তাই ক্ষমতার পরিবর্তনের সাথে বদলে যেতে থাকে এ ভাঁড় ও দালালেরা। কিন্তু এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়ে-এর সম্পাদক ও লেখকেরা ছিল এই দালালি ও ভাঁড়ামির ঊর্ধ্বে।


তারা সময়ের প্রয়োজনে, সেই অবরুদ্ধ সময়ের বিরুদ্ধে বসে নির্মাণ করেছিলেন এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়-এর মতো সংকলন; যা অবশ্যই সে সময়কার সবচেয়ে সাহসী পদক্ষেপ ছিল; বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ হিসেবে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই যে, পঁচাত্তর পরবর্তী বিভীষিকাময় সময় বদলে গেলে এবং আবার বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণের সময় এলে একদল স্বার্থ-শকুন প্রচার করতে থাকে, এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় তাদের প্রচেষ্টায় বের হয়েছিল!


সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর ব্যানারে বের হয়েছিল এ সংকলন : এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়। সূর্য তরুণ গোষ্ঠী নামটা দিয়েছিলেন সেই সময়কার বাংলা বিভাগের তরুণ ছাত্র ও খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ভীষ্মদেব চৌধুরী। এ নামকরণের পেছনেও একটা কারণ ছিল, ছিল আবাসিক ছাত্রাবাসের একটা ব্যাপার। এ সংকলনের প্রধান সম্পাদক আবদুল আজীজ থাকতেন সূর্যসেন হলের ১০২ নম্বর কক্ষে। এ কক্ষই ছিল সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর তখনকার কার্যালয়। আর এই কক্ষ থেকেই এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়-এর পরিকল্পনা এবং পরিকল্পনা-পরবর্তী সকল কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছিল।


এ সংকলন প্রকাশে, জড়বস্তু হলেও সূর্যসেন হলের ১০২ নম্বর কক্ষের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অপরদিকে এ সংকলনের নামকরণের একটি ইতিহাস রয়েছে। ‘এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়’ মূলত শামসুর রাহমানের একটি কবিতার শিরোনাম; কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯৬৯ সালের গণঅভুত্থানের প্রেক্ষাপটে। কিন্তু এই সংকলনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন, তবুও এ নামের সাথেই তৎকালীন সময়ের প্রেক্ষাপটের মিল ছিল। এই কারণেই সংকলনের নামকরণ করা হয়েছিল এ লাশ আমরা রাখবো কোথায়। এই নামকরণটিও করেছিলেন ভীষ্মদেব চৌধুরী; যেমন করেছিলেন সূর্য তরুণ গোষ্ঠীর নামও, তিনি।


এ সংকলনের এককভাবে কোনো সম্পাদক না থাকলেও প্রথম থেকে শেষাবধি এর কর্মযজ্ঞের দেখভাল করেন আবদুল আজীজ। সহযোগী হিসেবে লেখা সংগ্রহসহ নানা কাজে সাহায্য করেন ভীষ্মদেব চৌধুরী, সিরাজুল ফরিদ, আলতাফ আলী হাসু, নূর-উদ-দীন শেখ। এ সংকলনের প্রচ্ছদ করেন আর্টিস্ট মানিক দে। প্রচ্ছদের ব্যাপারেও দেখা যায় যে, তদানীন্তন সময়ে বহু প্রথিতযশা শিল্পী থাকলেও মানিক দে-ই এই সংকলনের প্রচ্ছদ করেন। ব্যাপারটাকে ধরতে হবে ঠিক ওইভাবে, পূর্বে বর্ণিত হয়েছে যা, গুরুত্বপূর্ণ কবিরাও লেখা দেননি : ঠিক এমন করেই এ সংকলনের প্রচ্ছদের কাজেও হয়তো বা সেদিন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী এগিয়ে আসেননি!


আরেকটা দারুণ ব্যাপার হলো, এ সংকলনের উদ্যোক্তরা সকলে ছিলেন একেবারে তরুণ; বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি কেউ পেরোননি তখনো, অধিকাংশই। এদের মাথার ওপরও যে কেউ ছিল, তেমনও না। সম্পূর্ণ নিজেরাই, ওই রকম কাঁচা বয়সে সবকিছু তোয়াক্কা না করে বের করেছিলেন এ রকম একটি সাহসী সংকলন। নানা ঝুঁকি-ঝামেলার কথা যে তারা মাথা থেকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, তেমন না। সেসব তাদের বিবেচনায় ছিল। কিন্তু অন্যরা যখন ঝুঁকি-ঝামেলার ব্যাপারটা বিবেচনা করতে গিয়ে অবিবেচক হয়ে পড়ছেন, পালিয়েছেন বর্তমানের দায়িত্ব থেকে। তখন এ তরুণেরা সমসাময়িক ঝুঁকি-ঝামেলার ব্যাপারে অবিবেচক হয়ে আসলে বিবেচকের মতোই কাজ করেছিলেন।


সংকলনটির জন্য লেখা সংগ্রহের ব্যাপার ছিল সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। কারণ আগেই বর্ণনা করা হয়েছে, সেই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি। রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে সাহিত্যকে বদলে দিতে পারে, নিয়ে যেতে পারে অন্যদিকে, তা আমরা দেখে আসছি সেই দেশবিভাগের পর থেকেই। ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে, তামাম দিন বঙ্গবন্ধুর তোষামোদকারীকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি এই সংকলনের জন্য একটা শব্দ লিখে দিতে!


সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ কবিদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও লেখা পাননি এই সংকলনের কর্মীরা। এমনকি এমন সব পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন এই সংকলনের জন্য লেখা সংগ্রহ করতে গিয়ে, তা ভাষায় বর্ণনা সম্ভব নয়। এ সংকলনটি ছিল মূলত কবিতার সংকলন।


সবচেয়ে আজব ব্যাপার, মাহমুদুল হক এবং রাহাত খানের মতো নির্ভেজাল কথাসাহিত্যিক লিখে দিয়েছিলেন একটি করে কবিতা! এই সংকলনের সহযোগী সম্পাদক ভীষ্মদেব চৌধুরীর মতে, এ সংকলনের এদের লেখা কবিতা-ই এদের প্রথম এবং শেষ কবিতা। আর ভীষ্মদেব চৌধুরীও লিখেছিলেন একটি কবিতা, সময়ের প্রয়োজনে; ওই তার প্রথম এবং শেষ কবিতা। কিন্তু সেই সময়কার প্রভাবশালী কবিদের কাছ থেকে কোনো কবিতা পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠিত লেখকদের লেখা প্রদানে অনীহার ব্যাপারটা ছিল আসলেই দুঃখজনক।


প্রতিষ্ঠিত লেখকরা তো লেখা দিচ্ছেন না, সেটা একটা যেমন ব্যাপার, তেমনি যারা লেখা দিয়েছিলেন তাদের লেখা সংগ্রহের ব্যাপারেও এই সংকলনের কর্মীদের পোহাতে হয়েছে নানা ঝাক্কি-ঝামেলা। যে সময় এই সংকলন প্রকাশিত হয়েছে, তখন তো টেকনোলজি আজকের মতো নয়।


হাতে লিখিত লেখা সংগ্রহ করে তা খামে পুরে ডাকে করে লেখার আদান-প্রদানের রীতি ছিল। তবে অনেক লেখা লেখকের কাছে বসেও লিখিয়ে নেয়া হয়েছিল, নিয়েছিলেন উদ্যোক্তারা : যেমন নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি। হায়াৎ মামুদ, রাহাত খান, মাশুক চৌধুরী, শান্তিময় ঘোষ, আখতার হুসেন, মাহমুদুল হক, আমিনুল ইসলাম বেদু, মোহাম্মদ রফিক, জাহিদুল হক, মহাদেব সাহা, জাফর ওয়াজেদ, কামাল চৌধুরী ও জিয়াউদ্দিন আহম্মদের লেখা সংগ্রহ করেছিলেন আলতাফ আলী হাসু। সুকুমার বড়ুয়া, মোহাম্মদ মোস্তফা, ইফসুফ আলী এটম, লুৎফর রহমান রিটন, নূর-উদ্-দীন শেখ, ওয়াহিদ রেজা, খালেক বিন জয়েন উদ্দীন ও ফরিদুর রহমান বাবুলের লেখা সংগ্রহ করেছিলেন সিরাজুল ফরিদ। কবি দিলওয়ার ও তুষার করের কবিতা সংগ্রহ করেন ভীষ্মদেব চৌধুরী।


নির্মলেন্দু গুণের কবিতাটি সংগ্রহ করেন ভীষ্মদেব চৌধুরী ও সিরাজুল ফরিদ। ফজলুল হকের কবিতাটি সংগ্রহ করেন এই সংকলনের মূল উদ্যোক্তা আবদুল আজীজ। এবং মানিক দে ব্যতীত অন্যান্য উদ্যোক্তরাও লেখা দেন এই সংকলনে ছাপার জন্য।


আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদী লেখা ছাপার ক্ষেত্রে ছদ্মনামের ব্যবহার দেখি। এর ফলে লেখক যেমন নিরাপদ বোধ করেন, তেমনি করে সম্পাদকও। কিন্তু এই সংকলনের লেখায় লেখকদের কোনো ছদ্মনাম ব্যবহার করার নিয়ম থাকবে না, এ বিষয়টা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন আবদুল আজীজ। এরই ফলে অনেকে লেখা দিতে পারেননি। কিন্তু মূল উদ্যোক্তরা ছিলেন কঠোর; এ ব্যাপারে কোনো নড়চড় হয়নি শেষাবধি।


ফজলুল হক চাকরি হারাবার ভয়ে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে চাইলে তার লেখা ছাপা হবে না বলে জানানো হয়। পরবর্তীতে তিনি সবকিছু জেনেও এই সংকলনে লেখা জমা দেন, নিজের নামেই। এটা একটা সাহসী উদ্যোগ ছিল নিঃসন্দেহে। এভাবেই প্রাথমিক লেখা সংগ্রহের কাজ শেষ হয়।


এ সংকলনের প্রকাশের অর্থের প্রায় সম্পূর্ণটাই দিয়েছিলেন আবদুল আজীজ। শেষে দিকে অর্থের টানাটানির সময় সিরাজুল ফরিদ ধার করে কিছু টাকা দেন, তার পরিমাণ শ’ তিনেক। দৈনিক সংবাদের অফিস ও প্রেস ব্যবহার করেছিলেন উদ্যোক্তরা।


এ সংকলনটি ক্ষুদ্র হলেও এর ব্যয়ভার ছিল অত্যধিক। এর মূল কারণ ছিল এককভাবে কোনো প্রেস থেকে এ সংকলন ছাপা সম্ভব হয়নি; সেটা গোপনীয়তার জন্যই করা হয়েছিল। প্রচ্ছদ ও প্লেট মেকিং এর কাজ খুবই দরদের সাথে করেছিলেন আর্টিস্ট মানিক দে। কোনো ধরনের বাণিজ্যিক উদ্দেশে এই সংকলন প্রকাশিত হয়নি। এরই ফলে কোনো বিজ্ঞাপন বা কোনো প্রতিষ্ঠান, কিংবা কোনো একক ব্যক্তির কাছ থেকে সাহায্য নেয়া হয়নি। এমনকি স্বার্থহীনতার ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয় সংকলনের মূল্য নির্ধারণের দিকে তাকালেই। কোনো ধরনের বিনিময়-মূল্য ছিল না। প্রকাশের পর কেউ কেউ সংগ্রহের সময় কিছু টাকা দিলেও এই সংকলনের অধিকাংশ কপিই বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।


ছড়া ও কবিতা মিলে মোট লেখার সংখ্যা ছিল ত্রিশ। কোনো ভূমিকা এ সংকলনে ছিল না; ছিল না নির্দিষ্ট করে কোনো সম্পাদকেরও নাম। এই সংকলনে ছিল না কোনো সূচিপত্রও। সংকলনের প্রথমে ছাপা হয়েছিল অন্নদাশংকর রায়ের একটা ছড়া, যা সেই সময় খুব আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল, দেখা যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দেয়ালসহ দেশের নানা স্থানে। ছড়াটি যদিও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ১৫ আগস্টের পর এই ছড়া আবার নতুনভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পরপরই। সেই ছড়াই সংযুক্ত করা হয়েছিল সংকলনের প্রথম ছড়া হিসেবে।


কবি দিলওয়ারের ছড়াটি ছাপা হয়েছিল ‘ছড়া’ শিরোনামে। হায়াৎ মামুদের কবিতা ছাপা হয়েছিল ‘মুজিবের এপিটাফ’ শিরোনামে, কবিতার শেষ দু’ লাইন ছিল এমন : আমরাও বেঁচে থাকি স্মৃতি নিয়ে তোর/তোর রক্ত ফুল হবে, আঙিনায় ভোর। কথাসাহিত্যিক রাহাত খান ‘যখন সময় হবে’ শিরোনামে লেখেন একটা কবিতা। আলতাফ আলী হাসু লেখেন ‘অঙ্গীকার’ শিরোনামে। মোহাম্মদ রফিকের কবিতার শিরোনাম ছিল ‘ব্যাঘ্র বিষয়ক’; কবিতাটা তিনি একটানাভাবে লিখে শেষ করেন, ছিল না কোনো স্তবক বিন্যাস; কবিতার শেষ ক’ লাইন ছিল এমন : দীর্ঘদেহী সুন্দরী গরান শাল অতন্দ্র সেগুন/পাহারায়, নিজস্ব শাবকগুলো দুঃখে আঁচড়ায়/নখ, ফোঁসে; প্রমত্ত গর্জনে সাড়া তুলবে অকস্মাৎ;/বাঙালির শুদ্ধ নাম শেখ মুজিবুর রহমান। ‘চিৎকার’ কবিতাটি ছিল মাশুক চৌধুরীর। ‘ছড়া : সাম্প্রতিক’ নামে ছড়া লেখেন ফরিদুর রহমান বাবুল; ছড়াটা ছন্দের দিক থেকে চমৎকার, ক’ লাইন তুলে দেয়া হলো : জানেন বোঝেন সবাই ভালো/শীত কাটেনা মাঘে/উল্শী বনে হালুম ডাকে/তুলশী বনে বাঘে। নির্মলেন্দু গুণের রচনা তিনি তাৎক্ষণিক লিখে দিয়েছিলেন, শিরোনাম ছিল : ‘মুজিব মানে মুক্তি’। তুষার কর লেখেন ‘বঙ্গবন্ধুর জন্য’ শিরোনামে; সুকুমার বড়ুয়া লেখেন ‘৭ই মার্চ’ শিরোনামে; মোহাম্মদ মোস্তফা লেখেন ‘আবার আসে ‘বাং-কর্ণো’ শিরোনামে।


মাহমুদুল হক লেখেন ‘বকুল গন্ধ বাঘের চোখে’ শিরোনামে, লেখার কিছু অংশ ছিল এমন : জেগে থাকে বাঘের চোখে/লক্ষ মুজিব দামাল ছেলে/জেগে থাকে ধানের খেতে/ঘূর্ণিঝড়ে বানের জলে। মাহমুদুল হকের এটাই বোধ হয় প্রথম কবিতা, এর আগে বা পরের কবিতার কথা জানা যায় না। আমিনুল ইসলাম বেদুর কবিতার শিরোনাম ছিল ‘প্রণাম, তোমাকে বঙ্গবন্ধু’; জিয়াউদ্দীন আহমদের কবিতার শিরোনাম ছিল ‘শেখ মুজিব’; জাহিদুল হকের কবিতার শিরোনাম ছিল ‘গোলাপ’; ইফসুফ আলী এটম লেখেন ‘ছবির ছড়া’ শিরোনামে, সিরাজুর ফরিদও ‘ছড়া’ শিরেনামেই লেখেন।


আখতার হুসেনের ছড়ার শিরোনাম ছিল ‘সোনার বরণ ছেলে’; ছড়ার কিছু অংশ : আর কত আর/খেলবে কানামাছি/মুজিব তোমর আসন পেতে/আমরা জেগে আছি। ভীষ্মদেব চেীধুরীর সেই তরুণ বয়সে লেখা ‘পিতা : তোমার জন্য’ কবিতাই তার প্রথম ও শেষ কবিতা; তিন স্তবকে বারো লাইনের এই কবিতায় অন্নদাশংকর রায়ের প্রভাব ভীষ্মদেব চৌধুরী নিজেই স্বীকার করেছেন, কবিতার শেষ স্তবক ছিল এমন : নদী ছলো ছলো নাম বহমান, বাঁধ দিতে আসে কে?/বাতাস বৈরী গুমোট হাওয়া তবু গাবো তার জয়/ফুলের জলসা তোমার জন্যে রক্ষিত আছে পিতা/জয় বাংলার বঙ্গবন্ধু অবিনাশী অক্ষয়।


ফজলুল হক সরকার লেখেন ‘শেখ মুজিব’ শিরোনামে। মহাদেব সাহা এক স্তবকে চার লাইনের একটি কবিতা লেখেন ‘আাবার আসিব ফিরে’ শিরোনামে; সম্পূর্ণ কবিতাটি ছিল এমন : আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়/ কোনো শংখচিল নয়, শেখ মুজিবের বেশে,/হেমন্ত কুয়াশা আর এই প্রিয়/মানুষের বেশে। কবিতাটি যে জীবনানন্দ দাশের অনুকরণে লেখা, তা স্পষ্ট বোঝা যায় প্রথম পাঠেই। এই সংকলনের প্রধান উদ্যোক্তা আবদুল আজীজ লেখেন ‘শরম লাগার ছড়া’ শিরোনামে একটি ছড়া; কয়েক চরণ উদ্ধৃত করছি : সরম লাগে সরম/‘বঙ্গবন্ধু’ নামটা নিতে/দারুণ লাগে সরম! শান্তিময় বিশ্বাসের ছড়ার শিরোনাম ছিল ‘পিতার জন্য’। জাফর ওয়াজেদের কবিতার নাম ছিল ‘একটি মুজিব’; তার কবিতা ছিল তিন স্তবকের, প্রতি স্তবকে দু লাইন করে। কবিতার শেষ স্তবক ছিল এমন : জয়বাংলা স্লোগান দিতে দিতে যেদিন তিনি শহীদ হলেন/সেদিনও হৃদয়ে আসীন প্রিয়তম মুজিব।


বিশিষ্ট ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটনের ছড়ার শিরোনাম ছিল ‘একটি ছেলের কথা’। ছড়ায় প্রকাশিত লুৎফর রহমান রিটনের দৃঢ় সংকল্প সেই সময়ে উচ্চারণ করা ছিল আসলেই দুঃসাহসিক ব্যাপার। ছড়ার শেষে রিটন বলছেন এমনটাই : করলি যারা বাংলাদেশের/এমনি তরো সর্বোনাশ/আজ শুনে রাখো- সুযোগ পেলেই/বংশ তোদের করবো নাশ। নূর-উদ্-দীন শেখের কবিতার শিরোনাম ছিল ‘সেই ছেলেটি’; ওয়াহিদ রেজা লেখেন ‘জাতির পিতা’ শিরোনামে। সেই সময় তরুণ কবি কামাল চৌধুরী লেখেন ‘একজন প্রেমিকের কথা’ শিরোনামে কবিতা।


তার কবিতায় জীবনানন্দের আমেজ ছিল; আর ছিল বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক আখ্যান-বিষয়-এই দুই মিলে কবিতাটি বিশেষ হয়েছে সংকলনে। সাত লাইনের এই কবিতা ছিল দুটি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রথম স্তবকে ছয় লাইন। আর শেষ স্তবকে এক লাইন। ‘পৃথিবীর ঘাস জুড়ে তার সেই বজ্রকণ্ঠ জেগে থাকে। ‘শেষের এই লাইনেই অবিনাশী বঙ্গবন্ধু মূর্ত হয়ে ওঠেন। কবি এই লাইনেই জানান দেন, বঙ্গবন্ধুর চিরন্তনতা সম্পর্কে। সংকলনের শেষ লেখাটি ছিল খালেক বিন জয়েন উদ্দীনের; শিরোনাম : ‘রাখাল রাজার জন্য’। স্পষ্ট নেমেরিক-স্তবকের পাঁচ স্তবকে বিভক্ত এই কবিতা। প্রত্যেক স্তবক বহন করছে ভিন্ন মর্মার্থ।
এই সংকলনের সাহিত্যিক মূল্য যে আকাশচুম্বী, তা বলছি নে। কিন্তু সেই দুঃসময়ে, যে সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়া একরকম নিষিদ্ধ ছিল, সেই সময় এরকম সংকলন প্রকাশ করা ছিল দুঃসাহসিক ব্যাপার! সেই কাজটি যে সেই সময়কার কাঁচা বয়সের এই তরুণেরা করে দেখিয়েছিলেন, তা আসলেই প্রশংসার দাবিদার এবং একইসাথে ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ এই সংকলন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এ সংকলনের ব্যাপারে তেমন কেউই কিছু জানে না; যেমন জানে একুশের প্রথম সংকলন একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে। তাছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন মুদ্রিত আকারে বাজারে পাওয়া যায়, এ সংকলনটি কিন্তু বাজারে তেমনভাবে সহজপ্রাপ্য নয়। সবদিক থেকে বিবেচনায় বলা যায় যে, এ লাশ আমরা রাখবো কোথায় বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুর ওপর প্রথম সংকলন; এবং যার ঐতিহাসিক মূল্যও অপরিসীম।


লেখক : সোহানুজ্জামান, প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।


বিবার্তা/রবি

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com