শিরোনাম
যেভাবে মিললো নাখালপাড়ায় নিহত তিন জঙ্গির পরিচয়
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০১৮, ২১:২৯
যেভাবে মিললো নাখালপাড়ায় নিহত তিন জঙ্গির পরিচয়
খলিলুর রহমান
প্রিন্ট অ-অ+

রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়াস্থ রুবি ভিলার জঙ্গি আস্তানায় নিহত তিন জঙ্গির পরিচয় মিলেছে। তবে সবার পরিচয় পেতে সময় লেগেছে ১০ দিন। এর আগে দুই জনের পরিচয় পাওয়া গেলেও আজ সর্বশেষ জনের পরিচয় মিলেছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব।


র‌্যাব জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাতে জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে নাখালপাড়ার 'রুবি ভিলা' ঘেরাও করে র‍্যাব। এসময় ছয়তলা ওই ভবনের পঞ্চম তলা থেকে জঙ্গিরা গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে র‌্যাব ও জঙ্গিদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। এতে তিন জঙ্গি নিহত হয়। পরদিন শুক্রবার বিকালে তাদের লাশ উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে নেয়া হয়।


১৪ জানুয়ারি তিন জঙ্গির একজনের পরিচয় সনাক্ত করে র‌্যাব। তারা তার ছবিযুক্ত দু'টি জাতীয় পরিচয়পত্র পায়, যার একটিতে নাম ছিল জাহিদ হাসান, অন্যটিতে মো. সজিব মিয়া। এমনকি পরিচয়পত্র দুটিতে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য-উপাত্ত (নাম, পিতা-মাতার নাম ও ঠিকানা) থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক পরিচয় নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হয়।


পরে ফিংগার প্রিন্ট অনুসন্ধানে জাহিদের ফিংগার প্রিন্ট একটি জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে মিলে যায়। ওই পরিচয়পত্র অনুযায়ী তার মূল নাম মেজবা উদ্দিন। সে কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার বাদুয়ারা গ্রামের বাসিন্দা এনামুল হকের ছেলে।


এ তথ্যের ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার পিতা-মাতা ও পরিবারের কয়েকজন সদস্যকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। এ সময় জঙ্গি মেজবা সম্পর্কে তার পরিবারের সদস্যরা বিস্তারিত জানিয়েছে বলে দাবি করেছে র‌্যাব। তবে বাকি দুই জঙ্গির পরিচয় না পাওয়াতে গত ১৮ জানুয়ারি তাদের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ছবি প্রকাশের একদিন পর গত শুক্রবার নিহত আরেক জনের পরিচয় পাওয়া য়ায়।


র‌্যাব জানায়, শুক্রবারে পরিচয় পাওয়া জঙ্গির নাম মো. নাফিস উল ইসলাম (১৬)। সে চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকার বাসিন্দা নজরুল ইসলামের ছেলে। এছাড়া চট্টগ্রাম নগরের কাজেম আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিল নাফিস। ছবি প্রকাশের পর নজরুল ইসলাম রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। পরে মর্গে লাশ দেখে নাফিসকে শনাক্ত করেন তিনি।


এদিকে, নিহত তিন জঙ্গির মধ্যে অবশিষ্ট অপর জনের পরিচয় মিললো রবিবার। পরিচয় পাওয়া জঙ্গির নাম রবিন মিয়া বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান।


এদিন সন্ধ্যায় তিনি জানান, ছবি দেখে রবিনের ভাই গোলম মোস্তফা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসেন। পরে মর্গে লাশ দেখে রবিনকে শনাক্ত করেন তিনি।


র‌্যাব জানিয়েছে, রবিন মিয়ার গ্রামের বাড়ি শেরপুরের নকলা উপজেলায়। সে ওই উপজেলার মৃত ফজর মিয়ার ছেলে। তারা তিন ভাই, এক বোন। ভাই-বোনদের মধ্যে রবিন সবার ছোট। এক বছর বয়সে রবিন বাবাকে হারিয়েছে। পরে শেরপুরে মা ও বড় ভাইদের সাথে বসবাস করতো।


র‌্যাব আরো জানায়, বড় ভাই গোলাম মোস্তফা শেরপুরে চাউলের ব্যবসা করে। দ্বিতীয় ভাই হাফেজ রফিকুল ইসলাম কাপড়ের ব্যবসায়ী।


এছাড়া রবিন ৬ষ্ট শ্রণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। সে ২০১৩ সালে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে ভাইয়ের ব্যবসার সাথে যুক্ত হয়। দীর্ঘ ৫ বছর যাবত মোবাইল ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করত সে। এ সময় ফেসবুকে কিছু উগ্রপন্থী জঙ্গিগোষ্ঠির তার সাথে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।


রবিনের বড় ভাই গোলাম মোস্তফার বরাত দিয়ে র‌্যাব আরো জানায়, নাখালপাড়ায় নিহত জঙ্গি নাফিস তাদের বাড়িতে এক রাত থেকেছে। রবিন তাকে বন্ধু পরিচয় দিয়ে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল। নাফিসের ছবি দেখে রবিনের ভাই এমনটা জানিয়েছে। এমনকি সেই নাফিস রাজধানীর পুরান ঢাকায় থাকতো বলেও জানিয়েছিল রবিন।


ছয় মাস পূর্বে প্রথমবারের মতো বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই রবিন ঢাকায় আসে। সেসময় অজ্ঞাত এক যুবককে নিয়ে সে তার গাজীপুরের বোনের বাসায় উঠে। তখন তার বোন ও দুলাভাই তাকে বকাবকি করেছিল। পরদিন সে বাড়ি চলে যায়। পরে সে গত ৭ জানুয়ারি বড় ভাইয়ের ক্যাশ বাক্স থেকে ৫ হাজার টাকা চুরি করে নিখোঁজ হয়। এরপর ২০ জানুয়ারি থানায় সাধারণ ডায়েরী করেন রবিনের বড় ভাই। ঘটনাক্রমে রবিবার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে লাশ দেখে রবিনকে শনাক্ত করেন গোলাম মোস্তফা।


যেভাবে নিখোঁজ হয়েছিল নাফিস:


র‌্যাব আরো জানায়, নাফিস তিন মাস থেকেই নিখোঁজ। সে বাড়ি ছাড়ার আগে বাসার লকার থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে এসেছিল।


নাফিসের বাবা নজরুল জানিয়েছেন, নাফিস নিখোঁজের পর চট্টগ্রামের চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন তিনি। এরপর পুলিশের তদন্তে জানা যায়, সে জেএমবিতে যোগদান করেছে। সেখানে সে আব্দুল্লাহ বলে পরিচিত।



যেভাবে নিখোঁজ হয় জঙ্গি মেজবা:


রাজধানীর পশ্চিম নাখালপাড়ায় তিন জঙ্গির মধ্যে প্রথমেই পরিচয় পাওয়া যায় জঙ্গি মেজবার। মেজবার পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে র‌্যাব জানায়, মেজবার বাবা এনামুল হক চাঁদপুর কাদরা মাদ্রসার শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে স্থানীয় এক মসজিদের মোহাদ্দেস তিনি। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মেজবা চতুর্থ (ভাইদের মধ্যে বড়)। সে মনোহরগঞ্জের আলীনকিপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করে। ২০০৭ সালে সে ঢাকার সায়েদাবাদে একটি মোটর গ্যারেজে কাজ নেয়। আরো পরে সে যাত্রাবাড়ী জনপদ মোড়ে মেজবা টায়ার শপ্ নামে নিজেই একটি মোটর গ্যারেজ চালু করে।


২০১৫ সালের দিকে মেজবার মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। সে ধর্মকর্মের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে ওঠে। সে নিজ গ্রামে গিয়ে স্থানীয় মসজিদের ইমামের ইমামতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং পরবর্তীতে একা একা নামাজ আদায় শুরু করে।


র‌্যাব জানায়, মেজবা ২০১৭ সালের ২৮ মে পাশের গ্রামের শারমিন আক্তার নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে। বিয়ের কিছুদিন পর সে স্ত্রীর কাছে স্বীকার করে যে সে উগ্রবাদে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে।


সর্বশেষ গত বছরের ২০ অক্টোবর সে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। এসময় সে অপরিচিত দুই যুবককেও সঙ্গে নিয়ে যায়। মেজবার পরিবার অপরিচিত যুবকদের পরিচয় জানতে চাইলে সে জানায়, এই যুবকরা তার মায়ের পেটের ভাইয়ের চেয়েও আপন। ২৬ অক্টোবর সে গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে।


গত ১০ নভেম্বরের পর হতে মেজবা তার পরিবারের সাথে সকল প্রকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে। তবে ১৫-২০ দিন আগে হঠাৎ একদিন অজ্ঞাত স্থান থেকে স্ত্রী ও মাকে ফোন করে ক্ষমা চায় এবং 'জান্নাতে দেখা হবে' বলে বিদায় নেয়। এ সময়ে তার স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা বলে জানালে সে আল্লাহর রাস্তায় চলে যাচ্ছে বলে জানায়। এ সংবাদে ভীত হয়ে মেজবার পরিবার গত ১৯ ডিসেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি জিডি করে।


নিখোঁজ হওয়ার আগে মেজবার পরিবারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী তার সর্বশেষ ঠিকানা ছিল দক্ষিণ সায়েদাবাদ রবিন মিয়ার মেস। ওই সূত্র ধরে ওই মেসের ম্যানেজার রিপনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, মেজবা গত ৫ আগস্ট তার মেস ভাড়া নেয়। সে নিয়মিত নামাজ পড়তো। তার আচার-আচরণও ভালো ছিলো। তবে সে মাঝে মধ্যে তাবলীগের কথা বলে নিরুদ্দেশ থাকত বা মেসে ফিরতো না। সে গত ৭ নভেম্বর তাবলিগে যাচ্ছে বলে সর্বশেষ মেস ত্যাগ করে। এরপর আর ফিরে আসেনি। গত ৩ জানুয়ারি মেজবার ভাই ও বাবা ঢাকায় এসে মেস থেকে তার সমস্ত জিনিসপত্র নিয়ে যায়।


বিবার্তা/খলিল/শাহনেওয়াজ

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com