বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে
প্রকাশ : ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১৮:২১
বিচার বিভাগের পৃথক সচিবালয়ের প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নির্দেশনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন আজ রবিবার একটি ধারণাপত্রসহ এই প্রস্তাব পাঠায়।


২৭ অক্টোবর, রবিবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের স্বাক্ষরের পর এই প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয় বলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।


নির্বাহী থেকে বিচার বিভাগ পৃথককরণ সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আংশিক বাস্তবায়ন করা হয় ২০০৭ সালে। ওই বছর এক অধ্যাদেশ জারি করে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করা হয়। কিন্তু বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।


সারা দেশের অধস্তন আদালতের বিচারকদের উদ্দেশে গত ২১ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক অভিভাষণে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ বলেছিলেন, একটি ন্যায়ভিত্তিক বিচারব্যবস্থার কাজ হলো নিরপেক্ষভাবে স্বল্প সময় ও খরচে বিরোধের মীমাংসা নিশ্চিত করে জনগণ, সমাজ, রাষ্ট্রকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ ও আইন সভা থেকে পৃথক ও স্বাধীন করা সবচেয়ে জরুরি।


প্রধান বিচারপতি আরও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের মতো বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পরিপূর্ণ প্রস্তাব প্রস্তুতক্রমে আমরা শিগগিরই আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করব।’


অভিভাষণের এক মাস ছয় দিনের মাথায় প্রধান বিচারপতির নির্দেশনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজ রবিবার আইন মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর ধারণাপত্র ও কিছু সংযুক্তিসহ ওই প্রস্তাব পাঠালেন।


২৭ অক্টোবর, রবিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন, অভিভাষণের ধারাবাহিকতায় বিচার বিভাগের জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিদের মতামত গ্রহণ করে ওই প্রস্তাবনা আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।


ধারণাপত্রে যা বলা হয়েছে


আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার পৃথক্‌করণ কার্যকররূপে বাস্তবায়িত না হলে রাষ্ট্রে সংবিধানের সুসংহত চর্চা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয় বলে ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়, এর ফলে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগসমূহের মধ্যে ক্ষমতার সূক্ষ্ম ভারসাম্য বজায় রাখার যে প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, তা একদিকে যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।


ধারণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে দীর্ঘদিন যাবৎ বিচার বিভাগের ওপর নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব প্রয়োগের প্রবণতার যে চর্চা অব্যাহত রয়েছে, তা রোধ করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে এর ফলে স্বাধীনতার পর থেকে অদ্যাবধি আমাদের দেশে আইনের শাসন ও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা চর্চার সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণ নিশ্চিতকরণকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।’


ধারণাপত্রে আরও বলা হয়, ‘দেখা যাচ্ছে যে আমাদের সংবিধানে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক রাখার কথা বলা হলেও সমকালীন রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ দেশে বিচার বিভাগের কার্যকর পৃথক্‌করণ অসম্পূর্ণই থেকে গেছে। তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে এমন একটি প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৭৯/১৯৯৯ নম্বর সিভিল আপিল মামলার রায়ে (মাসদার হোসেন মামলা নামে পরিচিত) নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণের পূর্ণ রূপরেখা তুলে ধরার মাধ্যমে ক্ষমতার পৃথক্‌করণ নীতির বাস্তবায়নের পথকে সুগম করে দিয়েছে।’


ধারণাপত্রের ভাষ্য, ওই রায়ে ক্ষমতার পৃথক্‌করণের যে রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছে, তার অন্যতম মৌলিক ভিত্তি হলো দেশের বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। মাসদার হোসেন মামলার রায়ে একাধিকবার বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণে বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের প্রসঙ্গ এসেছে। আর বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের সর্বোত্তম কার্যকর উপায় স্বাধীন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা। এ কারণে ওই মামলার রায়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বর্তমানে প্রচলিত দ্বৈত-শাসন কাঠামো তথা অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ, বদলি, শৃঙ্খলা প্রভৃতি বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের যে যৌথ এখতিয়ার রয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বিলোপ করে বিচার বিভাগের জন্য একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠাকে ক্ষমতার পৃথক্‌করণের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করেছেন।



ধারণাপত্রে বলা হয়, ‘আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বিভাগের অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ওপর অর্পণ করা হয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রি অধস্তন আদালতের বিভিন্ন বিষয় পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট তথা হাইকোর্ট বিভাগকে সাচিবিক সহায়তা প্রদান করে থাকে। কিন্তু হাইকোর্ট বিভাগের এই তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ নয়। কেননা, বিদ্যমান কাঠামোতে আইন মন্ত্রণালয় হতে অধস্তন আদালতসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব আসার পর হাইকোর্ট বিভাগ তার তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কিন্তু আমাদের সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের মর্ম অনুসারে অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ হাইকোর্ট বিভাগের একচ্ছত্র অধিকার। তাই সাংবিধানিক এই বাধ্যবাধকতা সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যক।’


ধারণাপত্রের শেষাংশে বলা হয়, এ ছাড়া বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টের মামলার সংখ্যা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বৃদ্ধি, অধস্তন আদালতের বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন কারণে সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মপরিধি আগের তুলনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলেও বিচার বিভাগের জন্য পৃথক একটি সচিবালয় স্থাপন জরুরি হয়ে পড়েছে। তাই সার্বিক বিশ্লেষণে কেবল পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলা, বদলি, পদোন্নতি, ছুটি ও অন্যান্য বিষয়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব।


বিবার্তা/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2024 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com