'স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য একুশের চেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ'
প্রকাশ : ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২৩:৫৬
'স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করার জন্য একুশের চেতনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ'
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ মানে চেতনার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে যাওয়া। একুশে ফেব্রুয়ারি, মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালির জাতীয় জীবনে সংগ্রামের ও গৌরবময় ঐতিহ্যের বড় একটি অধ্যায় এই দিনটি। আজ, বিনম্র শ্রদ্ধা আর যথাযোগ্য মর্যাদায় রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে পালিত হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।


একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ মিনারের বেদিতে রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসটির কর্মসূচি শুরু করেন। এরপর, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের স্মরণ করা হয়। দিবসটিতে ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভাগীয় শহর, জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা এবং নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে একুশের মহান শহীদদের স্মরণ করা হয়।


১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতিকে শক্তি দিয়েছিল। চেতনা দিয়েছিল একটি স্বাধীন, স্বার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জনের। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে গতিময়। উন্নয়নের পথে বেগবান হতে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন প্রেরণা জোগায়, ঠিক একইভাবে প্রেরণা দেয় আমাদের ভাষা। ভাষা আন্দোলনই আমাদের জাতীয়তাবোধ ও চেতনার উৎস। কারণ আমরাই সেই জাতি, যারা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। বিশেষত তরুণরাই এনেছিল ভাষার অধিকার। ভাষা আন্দোলনের বাহাত্তর বছর পেরিয়ে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়, একুশের চেতনা এখন কতটা ধারণ করছি আমরা এবং কতটা ধারণ করলে কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব? বর্তমান প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে ভাষা আন্দোলনের চেতনা কতটুকুই বা প্রতিফলিত হচ্ছে?


বিশিষ্টজনেরা বলছেন, একুশ মানে মাথা নত না করা, কখনো অন্যায়-মিথ্যা-অপকর্মের সাথে আপস না করা। মূলত একুশের চেতনার পথ ধরেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছেছি এবং সেই স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ করার জন্যই একুশের চেতনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে এই চেতনাটি সঞ্চারিত করাটাই এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি।


প্রসঙ্গত, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধিকার আদায়ের দাবিতে প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিল বাঙালি জাতি। এরপর থেকে পূর্ব বাংলার অধিকারবঞ্চিত মানুষের প্রতিটি গণআন্দোলনে প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল ভাষা আন্দোলন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তাসী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয় মাসের যুদ্ধ শেষে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। এসব লড়াই, সংগ্রামে অনুঘটক হিসেবে প্রেরণা জুগিয়েছিল বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।


বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বরকত সালামকে আমরা ভালোবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত, সালাম আমাদের ভালোবাসে। ওরা আমাদের ভালোবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃতরসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’


এদের আত্মদানের মধ্যদিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে: তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা বরকত, সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।


জানতে চাইলে শিক্ষাবিদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকোমল বড়ুয়া বিবার্তাকে বলেন, জন্মগ্রহণ করার পর প্রথম যে বর্ণমালা আমরা শ্রবণ করি, অর্থাৎ ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যখন বোধহীন তখন থেকেই যে শব্দ বা বাক্য আমরা শুনতে পাই এরচেয়ে বড় সম্পদ আর কিছুই হতে পারে না। এইজন্যই মাতৃভাষা জীবনের জন্য পরম সম্পদ। এই সম্পদকে রক্ষা করতে বা লালন করতে বিবেক-বোধের প্রয়োজন।


তিনি আরো বলেন, বাংলা ভাষা এসেছে পালি থেকে, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। বাংলা ভাষা এখন আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত, জাতিসংঘ, ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে বাংলাকে সপ্তম ভাষা হিসেবে পরিগ্রহ করা হয়েছে, বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা যে মর্যাদা পাচ্ছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের নিজেদের দেশে অবহেলিত। আমরা ইংরেজিকে যেভাবে প্রাধান্য দেই, বাংলাকে সেভাবে দেই না। জাপান, চীন নিজেরা এত পণ্ডিত কিন্তু নিজের ভাষা ছাড়া কথা বলবে না, প্রধানমন্ত্রীও যদি আসেন নিজের ভাষাতেই কথা বলেন, উনি কি ইংরেজি জানেন না? জানেন কিন্তু বলেন না। ইংরেজি মাধ্যম-বাংলা মাধ্যম করে আমরা ছাত্র-শিক্ষার্থীদের দুর্বল করে ফেলছি। একজন ইংরেজির ছাত্র নিজেকে সুপিরিয়র মনে করে। এটা ইংরেজি মাধ্যমের দোষ না, দোষ শিক্ষা কমিশনের। আমরা অভিভাবকরাই নতুন প্রজন্মকে দুর্বল করে দিচ্ছি, ভাষার প্রতি অনীহা তৈরি করে দিচ্ছি। আমরা চাই আমাদের সন্তান বাসাতেও ইংরেজিতে কথা বলবে, একটা স্মার্টনেস হিসেবে গণ্য করা হয়। শুধু একুশে ফেব্রুয়ারি পালন, একুশে বইমেলা করা বা একুশে পদক দেয়া এর মাধ্যমে ভাষা রক্ষা পায় না। যদি, নতুন প্রজন্মকে বাংলা ভাষায় সমাদৃত করতে পারি তাহলে বাংলা ভাষা রক্ষা পাবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, একুশ মানেই মাথা নত না করা। সেটাই তরুণ প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রত্যয়। আমরাও প্রত্যাশা করবো, আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও সার্বভৌমত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তরুণ প্রজন্ম উদ্বুদ্ধ হবে। তারা কখনো অপশক্তির কাছে মাথা নত করবে না।


একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা বাংলাকে পেয়েছি। একুশের চেতনা এখন কতটা ধারণ করছি আমরা এবং কতটা ধারণ করলে কাঙ্ক্ষিত সমৃদ্ধশীল বাংলাদেশ পাওয়া সম্ভব প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে আজ ২০২৪ সালে এসে আমরা যখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করছি, আমাদের শহীদ দিবস পালন করছি, মূলত সেই চেতনার পথ ধরেই আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছেছি এবং সেই স্বাধীন বাংলাদেশকে উন্নত এবং সমৃদ্ধ করার জন্যই একুশের চেতনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


তিনি আরো বলেন, একুশ মানে মাথা নত না করা, অর্থাৎ কখনো মিথ্যার সাথে আপস না করা, দুর্নীতির সাথে আপস না করা, নির্লোভ হিসেবে চলা, সকল রকম অন্যায় অপকর্ম ঠেকে নিজেকে দূরে রাখা। সমাজকেও দূরে রাখা। এই চেতনা একুশের এবং এই চেতনাকে শানিত করার প্রয়োজন আছে। ভাষা আন্দোলনের সময় চার বা সাড়ে চার কোটি মানুষ ছিল, এখন সতেরো কোটি মানুষ, এই চেতনাটি সবার মাঝে সঞ্চারিত করাটাই জরুরি।


বিবার্তা/এসবি/রোমেল/লিমন

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com