এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল
কমেছে পাসের হার, সাফল্যে এগিয়ে মেয়েরা
প্রকাশ : ২৬ নভেম্বর ২০২৩, ২৩:৫৩
কমেছে পাসের হার, সাফল্যে এগিয়ে মেয়েরা
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

২০২৩ সালের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই গত বছরের চেয়ে কমেছে। এদিকে প্রকাশিত এই ফলাফলের মাঝেও জিপিএ-৫ ও পাসের হারে ছেলেদের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা।


মেয়েদের এই সাফল্যের বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকারের নারী উন্নয়নমুখী নানা উদ্যোগ বাস্তবায়নের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। দেশ ও জাতির উন্নয়নে মেয়েদের এই সাফল্য ধরে রেখে ছেলে শিক্ষার্থীদেরও পিছিয়ে পড়ার কারণ বের করে সেই বিষয়েও সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে।



রবিবার, ২৬ নভেম্বর সকাল ১০ টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এইচএসসির ফলাফল হস্তান্তর করা হয়। পরে তিনি সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে কম্পিউটার বোতাম চেপে এই ফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেন। পরে এই দিন দুপুরে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।



প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেছে, এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ৯ হাজার ১৮৭টি প্রতিষ্ঠান থেকে সর্বমোট ১৩ লাখ ৫৭ হাজার ৯১৫ জন পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল ২ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৮৫২ জন পরীক্ষার্থী উত্তীর্ণ হন। এতে করে মোট পাসের হার দাঁড়ায় ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এরমধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৯২ হাজার ৫৯৫ জন পরীক্ষার্থী।


এদিকে পরীক্ষায় অংশ নেওয়া মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে ছাত্রী ৬ লাখ ৬৮ হাজার ৮৯২ জন, তাদের মধ্যে পাস করেছে ৫ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৩ জন। আর ৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৩ জন ছাত্রের মধ্যে পাস করেছেন ৫ লাখ ২৮ হাজার ৯১৯ জন। ফলে প্রকাশ হওয়া ফলে ছাত্রীদের পাসের হার ৮০ দশমিক ৫৭ শতাংশ; আর ছাত্রদের মধ্যে পাস করেছে ৭৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ অর্থাৎ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পাসের হার ৩ দশমিক ৮১ শতাংশ বেশি।


শুধু তাই নয়, জিপিএ ৫ এর ক্ষেত্রেও ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে মেয়েরা। চলতি বছর ছাত্রীদের মধ্যে জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪৯ হাজার ৩৬৫ জন; আর ছাত্রদের মধ্যে পেয়েছে ৪৩ হাজার ২৩০ জন অর্থাৎ ছাত্রদের চেয়ে ৬ হাজার ১৩৫ জন বেশি ছাত্রী জিপিএ ৫ পেয়েছেন এবার।


পাসের হার ও জিপিএ ৫ -এ মেয়েদের এগিয়ে থাকার বিষয়ে ফল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ছাত্রীদের পাসের হার বেশি। এটার জন্য ধন্যবাদ। কারণ সবসময় আমাদের শুনতে হয় জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি, এখন তো উল্টোদিকে…।


এছাড়া ছেলেদের পিছিয়ে থাকার কারণ খতিয়ে দেখার তাগিদ দিয়ে সরকার প্রধান বলেন, প্রতিবারই দেখি মেয়েদের পাসের হার বেড়ে যাচ্ছে। একসময় তো মেয়েদের পড়াশোনাই করতে দিত না। এখনো অনেক দেশে মেয়েদের পড়াশোনা করতে দেয় না। আমাদের দেশের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা কেন পিছিয়ে থাকল, সেটাই খুঁজে বের করতে হবে।


তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ২০২২ সালের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ছিল ৮৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ, এবার তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৮ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এদিকে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯২ হাজার ৫৯৫ জন, যা ২০২২ সালে ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ২৮২ জন। সেই হিসাবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৮৩ হাজার ৬৮৭ জন।


চলতি বছর পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমে যাওয়ার বিষয়ে, ফলাফলের বিস্তারিত তুলে ধরার সময় শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, গতবার পরীক্ষা সহজ ছিল। কম বিষয়, কম সময় ও কম নম্বরের প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেয়া হয়েছিল। এবার পূর্ণ নম্বর ও পূর্ণ সময়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এজন্য পরীক্ষাটাও তুলনামূলক কঠিন হয়। এজন্য পাসের হার ও জিপিএ-৫ কিছুটা কমেছে।


এই বিষয়ে জানতে চাইলে নটরডেম কলেজের অধ্যক্ষ ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও বিবার্তাকে বলেন, গতবার দুই বিষয়ে পরীক্ষা ছিল, এবার সব বিষয়ে হয়। এ ছাড়া এবার যারা পাস করেছে, তারা যখন করোনার সময়ে নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ত, অনলাইনে সে সময়ে ক্লাসের কারণে অনেকেরই ভিত্তি একটু দুর্বল ছিল। তবে আমাদের কলেজে শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে নজর দেয়া হয়েছে। এজন্য ফলাফল বরাবরের মতো ভালো হয়েছে।


চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ মোজাহেদুল ইসলাম চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, নানা কারণে পাসের হার ও জিপিএ ৫ কমেছে। প্রশ্নপত্র আগের চেয়ে কঠিন হওয়া, সব বিষয়ে পরীক্ষা হওয়া, শিক্ষার্থীদের কোভিড পরিস্থিতির কারণে মনোযোগ নষ্ট হওয়াসহ প্রভৃতি। তাছাড়া শিক্ষার্থীদের অনেকে গাইড বইমুখী বেশি থাকে। এদিকে প্রশ্ন বোর্ড বই থেকে হওয়ায় তারা ভালো করতে পারেননি। এক্ষেত্রে আমরা আশাবাদী শিক্ষার্থীরা গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করলে সামনে ফলাফল অবশ্যই ভালো হবে।


পাসের হার ও জিপিএ ৫ -এ মেয়েদের এগিয়ে থাকার বিষয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই সাফল্য প্রশংসনীয় এবং একইসাথে খুবই ইতিবাচক দিক। আগামী দিনেও নারীদের এগিয়ে যেতে এই সাফল্যগুলো অনুপ্রেরণা জোগাবে। তবে বিশিষ্টজনেরা সতর্কও করেছেন এই বলে যে, সাফল্য ধরে রাখা সহজ কাজ নয়। সেক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন থেকে সাফল্য পাওয়ার প্রক্রিয়াগুলোতে কাজ করে যেতে হবে। এদিকে ছেলেদের বিষয়েও সজাগ ‍দৃষ্টি রাখার পরামর্শ তাদের।


এইচএসসিতে মেয়েদের সাফল্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বিবার্তাকে বলেন, এইচএসসির ফলে মেয়েদের এভাবে এগিয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় দিক। এখনো এই দেশের অনেক মেয়েরা নিপীড়িত,নিগৃহীত এবং নির্যাতিত। মেয়েদের এই অর্জন তাদেরও সামনে এগিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জোগাবে। তাছাড়া এখন শুধু এইচএসসি পরীক্ষা নয়, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব জায়গায় মেয়েদের সাফল্য ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা খুবই শুভ লক্ষণ, শুভ সূচনা। তবে আমাদের অর্জনের এই ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে।


শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি সাধনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক জোর দিয়েছেন। এমনকি নারী শিক্ষার উন্নয়নে তিনি উপবৃত্তিসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে বাস্তবায়নও করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব ভূমিকা রেখেছেন। যার ফলে আজকের মেয়েরাও নানা সুযোগ সুবিধা পেয়ে নিজেদের সাফল্যের প্রমাণ দিয়েই চলেছে।


মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়ে এই শিক্ষাবিদ বলেন, বর্তমানে অর্থনৈতিকসহ নানা কারণে অনেক ছেলে শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ছে। এদিকে মেয়েদের মধ্যে বাল্য বিবাহসহ নানা কারণেও এখন অবধি অনেকের পড়াশোনা বন্ধ হচ্ছে। এই বিষয়গুলোর দিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি দিতে হবে। মোটকথা, মেয়েদের অর্জনের ধারা অব্যাহত রেখে ছেলেদের পিছিয়ে পড়ার বিষয়েও সতর্ক হতে হবে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বিবার্তাকে বলেন, এইচএসসির ফলে মেয়েরা জিপিএ ৫ ও পাসের হারে এগিয়ে যাওয়া খুবই ইতিবাচক দিক। আমি এই অর্জনের জন্য মেয়েদের অভিভাবক তথা পিতা-মাতাকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। একইসাথে মেয়েদের এই অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও অভিনন্দন জানাই। এটা এজন্য যে তিনি মেয়েদের এগিয়ে যেতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। উপবৃৃত্তি, শিক্ষা ঋণের ব্যবস্থা, মধ্যাহ্নভোজসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছেন। এছাড়া সরকারি বেসরকারি নানা কার্যক্রমও মেয়েদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করেছে। মোটকথা, সবকিছুর সামষ্টিক প্রতিফলন মেয়েদের এই অর্জন।


বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মেয়েদের অংশগ্রহণের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমার বিভাগে (সমাজবিজ্ঞান) একটা ডাটাবেজ করা হয়েছে। সেখানে আমরা দেখলাম বিভাগে ১ম ও ২য় বর্ষে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। কিন্তু আপেক্ষের বিষয় হলো এম এ ( মাস্টার্স) এ গিয়ে দেখা যায়- মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কম অর্থাৎ বিয়ে হয়ে যাওয়াসহ নানা কারণে এখানে অংশগ্রহণ কমছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত। মোটকথা, মেয়েদের সাফল্যের কাহিনীগুলোসহ ছিটকে পড়ার বিষয়ে গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।


শিক্ষায় মেয়েদের এই সাফল্য ও সরকারের উদ্যোগ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন এন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক বিবার্তাকে বলেন, দেখুন-মেয়েদের অর্জন তো হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু এতোদিন তারা সুযোগ-সুবিধা পায়নি, এজন্য পিছিয়ে ছিল। তবে একটা আক্ষেপের বিষয়- এখনো অনেকক্ষেত্রে মেয়েদের মেয়ে বা নারী হিসেবে চিন্তা করা হয়। এটা ঠিক না। এক্ষেত্রে আস্তে আস্তে এটারও পরিবর্তন হচ্ছে। আজকে শহরের ন্যায় গ্রামেও মেয়েদের চিন্তাভাবনা, চালচলনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এটা খুবই ইতিবাচক দিক।


তিনি বলেন, আগে গ্রামের মানুষকে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়া লাগত। কিন্তু যুগ বদলে গেছে। এখন গ্রামের মেয়েরাও প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতাও কম নয়। নানামুখী উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে মেয়েদের এগিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। এখন গবেষণায়ও নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। সামনেও আরও এগিয়ে যাবে। মোটকথা, মেয়েদের সাফল্যের এই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com