আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে নতুন শিক্ষাক্রম: উঠেছে বাতিলের দাবিও!
প্রকাশ : ২৫ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৭
আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে নতুন শিক্ষাক্রম: উঠেছে বাতিলের দাবিও!
বিবার্তা প্রতিবেদক
প্রিন্ট অ-অ+

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে শিক্ষাবর্ষের শেষদিকে এসেও ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের তিনটি শ্রেণিতে চলতি শিক্ষাবর্ষে (২০২৩) নতুন শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে। এ তিনটি শ্রেণি হলো– প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম। আগামী বছর আরও চারটি শ্রেণিতে চালু হবে এই শিক্ষাক্রম। পরবর্তী বছরগুলোতে অন্যান্য শ্রেণিতেও এই শিক্ষাক্রম চালু করার কথা রয়েছে।



তবে নতুন এই শিক্ষাক্রম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা যেন থামছেই না। এই শিক্ষাক্রমে পাঠদান প্রক্রিয়াকে বাস্তবসম্মত নয় অভিযোগ এনে, এটাকে বাতিল দাবিতে মাঠে নেমেছেন অভিভাবকরা। এদিকে শিক্ষাক্রম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিভাবকরা না বুুঝে এই শিক্ষাক্রমের বিরোধিতা করছেন। শিক্ষার্থীদের মঙ্গলের কথা ভেবে এই শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে।



শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে নতুন শিক্ষা কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল, নম্বরভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি চালু এবং শিক্ষার্থীদের দলগত কাজে ডিভাইসমুখী হতে নিরুৎসাহিত করাসহ ৮ দফা দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেছে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন নামক একটি সংগঠন।


মানববন্ধনে সংগঠনটির আহ্বায়ক রাখাল রাহা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক নাসির আহমেদসহ ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শতাধিক অভিভাবক যোগ দেন।


তাদের ৮ দফা দাবিগুলো হলো—



১. শিক্ষানীতি বিরোধী নতুন কারিকুলাম সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে।


২. নম্বর ভিত্তিক ২টা সাময়িক লিখিত পরীক্ষা (৬০ নম্বর) চালু রাখতে হবে এবং ধারাবাহিক মূল্যায়ন হিসেবে ৪০ নম্বর রাখতে হবে।


৩. নবম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীর আগ্রহ অনুযায়ী বিষয় নির্বাচনের সুযোগ অথবা বিজ্ঞান বিভাগ রাখতে হবে।


৪. ত্রিভুজ, বৃত্ত, চতুর্ভুজ ইত্যাদি নির্দেশক বা ইন্ডিকেটর বাতিল করে নম্বর ও গ্রেড ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি রাখতে হবে।


৫. সকল সময়ে সকল শিখন, প্রজেক্ট ও অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ক্লাসের ব্যয় সরকারকে বহন করতে হবে এবং স্কুল পিরিয়ডেই সকল প্রজেক্ট সম্পন্ন হতে হবে।


৬. শিক্ষার্থীদের দলগত ও প্রজেক্টের কাজে ডিভাইসমুখী হতে অনুৎসাহিত করতে হবে এবং তাত্ত্বিক বিষয়ে অধ্যয়নমুখী করতে হবে।


৭. প্রতিবছর প্রতি ক্লাসে নিবন্ধন ও সনদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে, প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা চালু রাখতে হবে এবং এসএসসি ও এইচএসসি দুটি পাবলিক পরীক্ষা বহাল রাখতে হবে।


৮. সকল সময়ে সকল শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নের আগে অবশ্যই তা মন্ত্রী পরিষদ এবং সংসদে উত্থাপন করতে হবে।



মানববন্ধন করার বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনটির আহ্বায়ক রাখাল রাহা বিবার্তাকে বলেন, একটি কারিকুলাম কতটা শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী, সেটা ভাবা ও আলোচনা করা উচিত ছিল। এমনকি মহান জাতীয় সংসদেও এটা নিয়ে আলোচনা করা যেত। কিন্তু এসবের কোনটা হয়েছে বলে আমরা জানি না। আর এসব হলে এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হতো না।


তিনি বলেন,করোনার সময় দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থেকেছে। এই সময় অনলাইনে ক্লাস করানো হলেও শিক্ষার্থীরা এটাকে ঘিরে অতিমাত্রায় ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়েছিল, যদিও ক্লাস তেমন সফল হতো না। কিন্তু এখন যখন এটাকে কাটিয়ে আমরা মুক্তির দিকে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই নতুন এই কারিকুলামের কারণে শিক্ষার্থীরা আবার ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। তারা পড়ালেখায় তাত্ত্বিক যে বিষয়গুলো, সেগুলো শিখছে না। তারা কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস শিখছে। গুগল ব্রাউজ করে দেখে দেখে লেখা বা অ্যাসাইনমেন্ট করা তাদের ওপর চাপ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সার্বিক বিবেচনায় অবিলম্বে এই কারিকুলামের প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। আর এটার কোন বিকল্প নেই।


সামনের কর্মসূচির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ৮ দফা দাবি আদায়ে আগামী ৫ ডিসেম্বর প্রতিটি জেলার প্রশাসকদের কাছে স্মারকলিপি প্রদান করা হবে। আর যেকোনো দিন যার যার সুবিধামতো স্কুলের সামনে অভিভাবকদের অবস্থান কর্মসূচিও পালন করা হবে।


জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক নাসির উদ্দীন আহমেদ বিবার্তাকে বলেন, নতুন এই শিক্ষাক্রম সর্বজনীন নয়। এটা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে করা হয়েছে। কাজেই আমাদের দাবি থাকবে, সবার কথা চিন্তা করে শিক্ষাক্রম ঠিক করা।


রাজধানীর সেন্ট জোসেফ স্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক ডালিয়া আক্তার বিবার্তাকে বলেন, এই কারিকুলামে শিক্ষার্থীদের সঠিক মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা বাস্তবসম্মত শিক্ষা নয়। তাছাড়া নতুন এই কারিকুলামে আমাদের ব্যয়ও অনেক বেড়েছে, যা অনেকে কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। প্রতিদিন কাগজ, কলম ও পেনসিলের পাশাপাশি এখন নতুন নতুন সরঞ্জাম যুক্ত করা হচ্ছে। শিক্ষা ব্যয়ের দিকেও রাষ্ট্রকে নজর দিতে হবে।


চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর অভিভাবক শারমিন সুলতানা বিবার্তাকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিতে বছরের শুরুতেই অভিভাবক সমাবেশ করা হয়েছে। তবে সেটি ততটা কার্যকরী ছিল না। আবার স্কুল থেকেও অনেক সময় বাচ্চাদের অনেক কিছু ক্লিয়ার করে দেওয়া হয় না। ফলে বাচ্চারা ডিভাইসমুখী হচ্ছে। এমনকি ইউটিউব, গুগল থেকে বিভিন্ন তথ্য হুবহু কপি করছে।


চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মুশফিকুর রহমান অন্তর বিবার্তাকে বলেন, আমাদের শিক্ষকরা এখনো নতুন সিলেবাসের সঙ্গে নিজেরা ভালোভাবে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি। তারা কীভাবে আমাদের বুঝাবেন? এক্ষেত্রে শিক্ষকরা অনেকটা আন্দাজের ওপর গ্রুপ স্টাডি এবং প্রজেক্ট দিচ্ছে। ফলে আমরা তো অনেক কিছু বুঝি না, কখনও কখনও আমাদের অভিভাবকরাও বুঝেন না। তাই বাধ্য হয়ে ইন্টারনেটের সহায়তা নিতে হচ্ছে।


নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে চলতি মাসে সামষ্টিক মূল্যায়ন নিয়ে মাউশির নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, পারদর্শিতার সূচক (পারফরম্যান্স ইন্ডিকেটর) অনুযায়ী ফল প্রকাশ করা হবে। সূচক ধরে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে ত্রিভুজ, বৃত্ত ও চতুর্ভুজ চিহ্ন দেবেন শিক্ষকরা। এক্ষেত্রে নির্দেশিকার ‘শ্রেণি উন্নয়ন নীতিমালা’ অংশের তথ্যানুযায়ী একজন শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে দুটি বিষয় বিবেচনা করা হবে। প্রথমত, শিক্ষার্থীর স্কুলে উপস্থিতির হার এবং দ্বিতীয়ত, বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতা। ৭০ শতাংশ ক্লাসে উপস্থিতি থাকলে তাকে নিয়মিত শিক্ষার্থী হিসাবে ধরা হবে এবং পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা যাবে। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ তিনটি বিষয়ের ট্রান্সক্রিপ্টে সবগুলো পারদর্শিতার নির্দেশকে কোনো শিক্ষার্থীর অর্জনের মাত্রা যদি ‘চতুর্ভুজ’ স্তরে থাকে, তবে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণের জন্য বিবেচনা করা যাবে না। নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের ওপর পরীক্ষার চাপ কমানোর পাশাপাশি হাতে-কলমে শেখা। কিন্তু বছর শেষে যেন উল্টো চিত্র দেখছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রমে অভিভাবকদের আরও বেশি সংযুক্ত করা উচিত বলে মনে করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানরা।


রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কেকা রায় চৌধুরী বিবার্তাকে বলেন, নতুন কিছু এলে সেটা স্থায়ী হতে কিছুটা সময় লাগে। নতুন শিক্ষাক্রমের ক্ষেত্রেও সেটা হবে। এখন যে সমস্যাগুলো ধরা পড়েছে, আগামী বছর থেকে সেগুলো থাকবে না। তবে অভিভাবকদেরও এই কারিকুলামের সাথে ভালোভাবে পরিচিত করতে হবে।


উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আ ন ম শামসুল আলম খান বিবার্তাকে বলেন, আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে উদ্যোগ নিয়ে বেশ কয়েকবার অভিভাবকদের সাথে বসেছি, এমনকি তাদের শ্রেণিকক্ষেও নিয়ে গেছি। আমাদের যেটা মনে হয়েছে এই শিক্ষাক্রমে অভিভাবকদের সম্পৃক্ত করতেই হবে। নয়তো পুরো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।


নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনা ও বাতিলের দাবির বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বিবার্তাকে বলেন, আমরা যারা শিক্ষার সাথে যুক্ত তারা নানা গবেষণা ও বিচার বিশ্লেষণ করে নতুন শিক্ষাক্রম ঠিক করেছি। এক্ষেত্রে অভিভাবকদেরও অভিভাবক হিসেবে মতামত থাকতে পারে। তবে তাদের সেই মতামতে অবশ্যই পরিসংখ্যানগত ও যুক্তির উপর্যুক্ততা থাকতে হবে। সেটা না থেকে যদি এমনিতেই বলার জন্য বলা হয়ে থাকে, তাহলে সেটা ঠিক না। আর আমরা ইতোমধ্যে তাদের অভিযোগের বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম শুরু বিভিন্ন জায়গায় জবাব দিয়েছি। আমরা আশা করছি, তারা বিষয়টি বুঝতে পারবেন।


তিনি বলেন, অভিভাবকরা যদি এই বিষয়ে না বুঝে কথা বলেন, সেটা একটা বিষয়। আর যদি বুঝেও এমন করেন তাহলে তাদের দর্শনগত সমস্যাও থাকতে পারে। মোটকথা, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে তাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নাই। শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এটা করা হয়েছে। তাছাড়া এখানে শিক্ষার্থীদেরও কোনো বাড়তি চাপ নেই।


সার্বিক বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক উইং) বেলাল হোসাইন বিবার্তাকে বলেন, চলতি বছর সংস্কারযোগ্য করে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হয়েছে। এক্ষেত্রে এই বছর যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি, আগামী বছর সেগুলো থাকবে না। আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করছি।


তিনি বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়ে ধারণা দিতে আমরা স্কুলগুলোতে লিফলেট বিতরণসহ মাউশি থেকেও সার্বিক বিষয়ে করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছি। শুধু তাই নয়, টিচার্স গাইডেও শিক্ষকদের করণীয় সম্পর্কে বলা হয়েছে। অভিভাবকদের নতুন শিক্ষাক্রম সম্পর্কে ‍বুঝাতেও আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। মোটকথা, নতুন শিক্ষাক্রম ফলপ্রসূ করতে আমাদের সার্বিক কাজ চলমান রয়েছে।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com