বই উৎসবে বিনামূল্যের সব বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা!
প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:২৮
বই উৎসবে বিনামূল্যের সব বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা!
মহিউদ্দিন রাসেল
প্রিন্ট অ-অ+

১ জানুয়ারি সরকার ঘোষিত বই উৎসবের দিন। ইতোমধ্যে সেই লক্ষ্যে কাজও চলছে। তবে বই উৎসবের এই দিনে বিতরণের জন্য চাহিদা অনুযায়ী সব বই দেশের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।


জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সব বই পৌঁছানোর কথা বললেও এখনো প্রায় ১৮ কোটি বই ছাপানো বাকি। ফলে বই উৎসব নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।


সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গতবারের মতো এবারও বই উৎসবের দিন সব শিক্ষার্থী বিনামূল্যের বই পাওয়া নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে। তবে এই বিষয়ে এনসিটিবি আশাবাদী হলেও মুদ্রণ শিল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হতাশার কথা।


তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৯৮৩ সাল থেকে শুরু হয় বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ। যেখানে ২০০৯ সালের আগ পর্যন্ত প্রাথমিক স্তরের নির্ধারিত কয়েকটি বিষয়ের বই শিক্ষার্থীদের দেয়া হতো। ওই সময়ে একজন শিক্ষার্থীকে অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক পুরোনো বই দেয়া হতো। তখন শিক্ষার্থীদের সব বই পাওয়ার জন্য মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। পরে ঝরে পড়া রোধসহ শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখার নিমিত্তে ২০০৯ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণের যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার। পরে ২০১০ শিক্ষাবর্ষ থেকে বছরের প্রথম কর্মদিবসে পাঠ্যপুস্তক উৎসব দিবস পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১০ সাল থেকে ২০২২ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ১৩ বছরে মোট ৪শ’ ৩৫ কোটি ২৪ লাখ ৯০ হাজার ৪১ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই বিতরণ করা হয়েছে। বিনামূল্যে বই বিতরণ করার এই মহাযজ্ঞ দেশ-বিদেশে কুড়িয়েছে প্রশংসা। শুধু তাই নয়, সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে করোনাকালীন বই উৎসব না হলেও নতুন বই বিতরণ ঠিকই হয়েছে। ফলে বৈশ্বিক এই সংকটের সময়েও হাসি ফুটেছে কচিকাঁচাদের মুখে। তবে ব্যত্যয় ঘটেছে গত বছর। এই বছর কাগজ ও বিদ্যুতের সংকটের কারণে বই উৎসবের দিন শিক্ষার্থীরা সব বই পায়নি। পরে অবশ্যই ধারাবাহিকভাবে তাদের বই পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে চলতি বছর কাগজসহ কোন সংকটের কথা আলোচনায় না আসলেও বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের সব বই পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।


এনসিটিবির তথ্য অনুসারে, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের ২০২৪ শিক্ষাবর্ষের ৩ কোটি ৮১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৩০ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ৫১৭ কপি বই ছাপানো হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক থেকে প্রাথমিক স্তরের বই ৯ কোটির বেশি আর মাধ্যমিকে ২১ কোটি ৩২ লাখ। চলতি বছর প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বই দেয়া হয়েছিল। আগামী বছর এটা যাবে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে। নতুন শিক্ষাক্রমে প্রতিটি শ্রেণিতে ১০টি করে বই হওয়ায় এবার তিন কোটি বই কম ছাপা হচ্ছে। গত বছর প্রায় ৩৩ কোটি বই ছাপানো হয়েছিল।


মুদ্রণ সমিতি সূত্রে জানা যায়, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আর মাত্র দেড় মাস অবশিষ্ট থাকলেও এখনো প্রায় ১৮ কোটি বই ছাপানো বাকি। এরমধ্যে ২য় ও ৩য় শ্রেণির বইয়ে সংশোধনী থাকায় দেরিতে ছাপা শুরু হয়েছে। এছাড়া প্রথম ও ৫ম শ্রেণির ৮০ শতাংশ বই ছাপা শেষ হয়েছে। এতে প্রাথমিকের ৩ কোটির বেশি বই এখনো ছাপা বাকি রয়েছে। এছাড়া ৯ম শ্রেণির বইয়ের ওয়ার্ক অর্ডার হয়নি। এটির ছাপা শুরু হতেও সময় লাগবে। ষষ্ঠ আর সপ্তম শ্রেণির মোট বইয়ের অর্ধেক ছাপানো হয়েছে। এছাড়া অষ্টম শ্রেণির বইও ছাপা শুরু হয়নি। সব মিলিয়ে মাধ্যমিকে ১৪ কোটি বই এখনো ছাপা বাকি রয়েছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণীর সামাজিক বিজ্ঞান ও ইতিহাস বইতে সংশোধনের কাজ চলছে। সব মিলিয়ে ১৮ কোটি বই এখনও ছাপা হয়নি। ফলে নতুন বছরের প্রথমদিনে সব শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই উঠবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।


এই বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বিবার্তাকে বলেন, বই উৎসবে সব শিক্ষার্থীকে বই দেয়া সম্ভব হবে না। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, নভেম্বরে বই পৌঁছানো দূরের কথা, ডিসেম্বরেও তা সম্ভব না। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরের বই নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।


অনেক বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাত্রই দেওয়া হয়েছে। ছাপার সার্বিক অগ্রগতি বিবেচনায় এটা অকপটে বলাই যায়, কোনোভাবেই বছরের প্রথম দিনে সব বই স্কুল পর্যায়ে পৌঁছা তো দূরের কথা, ছাপাই সম্ভব না।


বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির বর্তমান সভাপতি শহিদ সেরনিয়াবাত বিবার্তাকে বলেন, নতুন বছরের শুরুতেই আংশিক বই শিক্ষার্থীরা পেলেও পুরো সেট বই তারা পাবে না। এছাড়া বইয়ের মানটা খারাপ যাচ্ছে। অনেক প্রেসে নিউজপ্রিন্টে বই ছাপানো চলছে। এনসিটিবির উচিত এসব বিষয়ে তদারকি করা।


একই বিষয়ে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, এখনো ১৮ কোটি বই ছাপানো বাকি। যেগুলোর অর্ডার করতে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত লাগবে। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে সব বই পৌঁছানোর প্রশ্নই আসে না।


বইয়ের মান নিয়ে তিনি বলেন, এনসিটিবি যেটা বলেছে আসলেই কি তাই? শুধু শুধু বাড়িয়ে বললে তো হবে না। বাস্তবতা যেটাই সেটাই বলতে হবে। তারা সবসময় বইয়ের মানের কথা বলেছে। অথচ এবার উজ্জ্বলতায়ও নিম্নমানের বই হচ্ছে। এটা খুবই হতাশার বিষয়। অনেকটা নিউজপ্রিন্টের মতো হয়ে যায় কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। আর এটা হলে বিষয়টা ভাবাই যায় না!


এই বিষয়ে অবগত করে মন্তব্য জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) অধ্যাপক লুৎফর রহমান বিবার্তাকে বলেন, নভেম্বরের মধ্যে প্রাথমিকের সব বই উপজেলায় পৌঁছে যাবে। আর মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বই যাবে ২০ নভেম্বরের মধ্যে। এছাড়া অন্যান্য শ্রেণির বই যাবে ডিসেম্বরের মধ্যে। এক্ষেত্রে মাধ্যমিকের বইয়ের মান নিয়ন্ত্রণের কারণে আমাদের কিছুটা দেরি হচ্ছে।


বই উৎসবের আগে বিতরণের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাইলে এনসিটিবি চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম বিবার্তাকে বলেন, এবার কাগজ ও বিদ্যুতের সংকট নেই। ফলে বলা যায় আমরা অনেকটা ভালো অবস্থার মধ্যে আছি। আশা করছি, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব বই উপজেলায় চলে যাবে।অষ্টম ও নবম শ্রেণির নতুন কারিকুলামের বই লিখতে একটু দেরি হয়ে গেছে। তাই পৃষ্ঠার সংখ্যা নির্ধারণ করতে না পারায় টেন্ডার করতে একটু দেরি হয়েছে। ইতোমধ্যে অষ্টম শ্রেণির বই ছাপা শুরু হয়েছে। নবম শ্রেণির বইয়ের টেন্ডার হয়ে গেছে। সেটা নিয়েও আমরা কাজ করছি।


বিবার্তা/রাসেল/এসবি/জবা

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com