কে শুনবে বোবা গাছের লুকানো কান্না!
প্রকাশ : ০৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৯:৫৬
কে শুনবে বোবা গাছের লুকানো কান্না!
কুড়িগ্রাম থেকে আতাউর রহমান বিপ্লব
প্রিন্ট অ-অ+

কে শুনবে বোবা গাছের লুকানো কান্না! বিজ্ঞাপন আর রাজনৈতিক প্রচারণায় ছেয়ে গেছে কুড়িগ্রামে মহাসড়কে দুইপাশের বৃক্ষসারি। গাছের শরীর বিদীর্ণ করেছে ধাচালো পেরেকে- আর সেখানে শোভা পাচ্ছে পোস্টার, ফেস্টুন। প্রশাসনের নাকের ডগায় ঘটছে এসব। জীব ও প্রকৃতির অকৃত্রিম বন্ধু গাছের উপর এই নির্যাতনকে সচেতন মহল দাবী করেছেন সংশ্লিষ্ট মানুষের বিকৃত মানসিকতাকে।


জেলা জুড়ে বিভিন্ন সড়কগুলোর গাছ বিজ্ঞাপন বোর্ডে সয়লাব। শুধু গাছ নয় বিজ্ঞাপনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সীমানা প্রচীরও। এতে করে পরিবেশের সৌন্দর্য্য নষ্ট হবার পাশাপাশি পরিবেশ ভারসাম্যের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।




মানুষের পরম বন্ধু। গাছ প্রকৃতিকে অক্সিজেন দেয়। সেই অক্সিজেনে প্রাণীকুল বেঁচে থাকে। জীবন বাঁচানো সেই গাছেরই ক্ষতি করছে কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষ। গাছ শুধু আমাদের জীবনই বাঁচায় না বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগ থেকেও আমাদের জীবন, জীবিকা ও আবাসনকে রক্ষা করে। অবস্থা এখন উপকারীকে বাঘে খায়-এর মতো! এখন মানুষের নির্যাতনের স্বীকার হয়ে সেই গাছ নিজেই নিজের দূর্যোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে।



শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা সড়কে পাশে ছোট বড় গাছের গায়ে লোহার পেরেক দিয়ে আটকানো হয়েছে অসংখ্য সাইন বোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড। বিভিন্ন গাছে ঝুলছে ব্যবসায়িক, চিকিৎসক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণার অসংখ্য ছোট-বড় সাইন বোর্ড, ব্যানার, ফেস্টুন। পিছিয়ে নেই বিভিন্ন স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং সেন্টারগুলোও। এসব ব্যানার, ফেস্টুন, বিজ্ঞাপন ঝোলানো হয়েছে পেরেক ঠুকে। এক একটি গাছ যেন এক একটি বিজ্ঞাপন বোর্ডের খুঁটি। কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই যে যেখানে পারছে পেরেক ঠুকে গাছকে বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করছে। এতে বর্ষা মৌসুমে ছোট-বড় দুর্ঘটনার কবলে পড়তে হয় পথচারী ও যানবাহনগুলোকে।


সরেজমিনে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম বিজিবি-২২ ব্যাটলিয়ন ক্যাম্প এবং আনসার ভিডিপি কার্যালয়ের সামনে চিলমারী-কুড়িগ্রাম সড়কের দু'পাশে সারিবদ্ধ ভাবে লাগানো রয়েছে বড় বড় গাছ। আম, মেহগনি, ইউক্যালিপটাস, অর্জুনসহ বিভিন্ন বৃক্ষের গায়ে অসংখ্য পোস্টার, ফেস্টুনে ছেয়ে গেছে। সারিবদ্ধ এসব গাছের সারিতে একটি মৃত আম গাছের গায়ে লাগানো হয়েছে বিজ্ঞাপনের পোস্টার।


নাগেশ্বরী উপজেলা পরিষদ চত্বরে নারকেল গাছসহ বিভিন্ন গাছে সরকার দলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের ফেস্টুন পেরেক দিয়ে লাগানো হয়েছে।



রাজারহাট উপজেলা নাজিমখা সড়কে রাজারহাট পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং মীর ইসমাঈল ডিগ্রি কলেজে ভিতরে ও রাস্তার দু’ধারে ছোট-বড় এবং মোটা-চিকন বিভিন্ন মূল্যবান গাছে শত-শত পোস্টার, ফেস্টুন এবং রাজনৈতিক দলের ব্যানারে ভরে গেছে।


নাগেশ্বরী উপজেলার বাসিন্দা মাহাবুব আলম বিবার্তাকে বলেন, পুরো উপজেলার বিভিন্ন অফিস এবং গাছে শুধু নেতাদের ছবি দিয়ে পোস্টারে সাটানো। এতে করে সরকারি অফিসের সৌন্দর্যটাই নষ্ট হয়ে গেছে। শুধুমাত্র প্রতিবছরের জুন মাস আসলেই নামমাত্র রঙ করলেও কিছুদিন পর আবার একই চিত্র।


রাজারহাট উপজেলার বাসিন্দা কলেজ ছাত্র সাব্বির বিবার্তাকে বলেন, নাজিমখা সড়কে প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে আনুমানিক পাঁচশতাধিকেরও বেশি গাছে পেরেক দিয়ে পোস্টার,ফেস্টুন লাগানো। অবৈধভাবে গাছে পেরেক দিয়ে পোস্টার ফেস্টুন লাগিয়ে মারাত্মক ভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করা হচ্ছে।


পরিবেশবিদ ও কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মির্জা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বিবার্তাকে বলেন, পেরেক লাগানোর কারণে গাছের গায়ে যে ছিদ্র হয়, তা দিয়ে পানি ও তার সঙ্গে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও অণুজীব প্রবেশ করে। এতে গাছে দ্রুত পচন ধরে। ফলে তার খাদ্য ও পানি শোষণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এতে করে গাছটি মারাও যেতে পারে। তাই কোনো গাছে পেরেক ঠোকা মানে ওই গাছের চরম ক্ষতি করা। গাছের পরিচর্যা করার বদলে উল্টো বিজ্ঞাপনের নামে গাছের চরম ক্ষতি করা হচ্ছে। গাছের প্রতি এই নিষ্ঠুর আচরণ দেশের বন আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়ার জোর দাবী জানাই।



কুড়িগ্রাম সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসান হাবীব নীলু বিবার্তাকে বলেন, শহরের সৌন্দর্য রক্ষা ও পরিচ্ছন্নতা বিধানে সরকার ২০১২ সালে দেয়াল লিখন ও পোষ্টার লাগানো (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১২পাশ করে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া পোস্টার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড লাগালে অর্থদণ্ডসহ বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেবার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগ না থাকায় দিন দিন বিজ্ঞাপনের নামে সৌন্দর্য নষ্ট করার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। গাছের জীবন বাঁচাতে এবং জেলার সৌন্দর্য রক্ষায় স্থানীয়ভাবে নিয়মিত ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনার দাবী করেন তিনি।


এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক সাইদুল আরীফ বিবার্তাকে জানান, জেলার মাসিক সমন্বয় সভায় অবৈধভাবে গাছে পোস্টার, ফেস্টুন ইত্যাদি লাগানোর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা শুরুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এগুলো অপসারণে দ্রুত কার্যকরি পদক্ষেপ নেয়া হবে।


বিবার্তা/রোমেল/মাসুম

সর্বশেষ খবর
সর্বাধিক পঠিত

সম্পাদক : বাণী ইয়াসমিন হাসি

এফ হক টাওয়ার (লেভেল-৮)

১০৭, বীর উত্তম সি আর দত্ত রোড, ঢাকা- ১২০৫

ফোন : ০২-৮১৪৪৯৬০, মোবা. ০১৯৭২১৫১১১৫

Email: [email protected], [email protected]

© 2021 all rights reserved to www.bbarta24.net Developed By: Orangebd.com